মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

স্বর্গের সে পথ সকলের জন্য নয়। অথচ ভীমসেন চলেছেন সে পথে, নিজের অজান্তেই। আর বিশাল শরীর হনুমান কদলীবনের মধ্যে থেকে নিদ্রার ভান করে পড়ে রইলেন আর হাই তুলতে লাগলেন। মাঝে মাঝে তিনি তাঁর লেজখানি তুলে মাটিতে আছাড় দিতে লাগলেন। হনুমানের লেজের শব্দে চারপাশের পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হতে লাগল। সে শব্দ হাতিদের শব্দকেও ছাপিয়ে গেল।

একসময় ভীমসেনের কানে সেই শব্দ পৌঁছল। তাঁর শরীরে রোমাঞ্চ জন্মাল সেই শব্দ শুনে। তিনি সেই শব্দের খোঁজে কদলীবনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে অবশেষে বিশালদেহী হনুমানকে স্বর্গের পথরোধ করে শুয়ে থাকতে দেখলেন। ভীমসেন হনুমানের কাছে গিয়ে সিংহনাদ করলেন। চমকে উঠল পশু পাখিরা। হনুমান সেই আওয়াজ শুনে শান্ত সুরে শুয়ে শুয়েই ঈষৎ ঘাড় কাত করে বলে উঠেলেন, ‘কে তুমি? কেনই বা এমন হাঁকডাক করছ? আমি রুগ্ন, চলতে ফিরতে পারি না। তুমি যদি এপথে যেতে চাও, তবে আমায় পার হয়েই যেতে হবে।’
ভীমসেন সে কথা শুনে বলেন, ‘কে তুমি? কেনই বা এমন পথ জুড়ে শুয়ে রয়েছো?’ হনুমান যেন সে কথা শুনেও শোনেন না। বলে চলেন আপন মনে, ‘হে বীর! কেন তুমি এ পথে চলেছো? এ পথ তো ক্রমশ দুর্গমতর হবে। তুমি যে এ পথ অতিক্রম করতে পারবে না, তা নয়। কিন্তু এ পথ তো স্বর্গের পথ, দেবতারা, সিদ্ধ পুরুষেরা এ পথে যাতায়াত করেন। তাঁদের অসুবিধা সৃষ্টি হলে তোমার সমূহ বিপদ।’

ভীমসেন এ কথা শুনে বেশ বিরক্তই হলেন। বলে উঠলেন, ‘তুমি কে হে আমায় বারণ করবার! আমি ভীমসেন, পাণ্ডুপুত্র। বাযুদেবও আমার পিতা’ এই বলে হনুমানের ছড়িয়ে থাকা লেজখানি হাত দিয়ে সরিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও লেজখানি সরাতে পারলেন না। হনুমান ভীমের দর্পে ভরা কণ্ঠ শুনে মৃদু হাসেন। এদিকে তখন ভীমসেনের সম্বিৎ ফিরল। তিনি বুঝলেন যে ইনি কোনও সামান্য কেউ নন।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৯: দ্রৌপদীর জন্য স্বর্গীয় ফুলের খোঁজে ভীমসেন কোনও পথে পাড়ি দিলেন!

কালি-কলমের মেলা

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৩: সীতার মনে কি আশঙ্কার অশনি সংকেত?

ভীমসেন তখন করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে উঠলেন, ‘হে বীর! কে আপনি বানররূপধারী? দয়া করে নিজের পরিচয় দিন। শুনেছি আমার ভাই বীর হনুমান এমন ক্ষমতা ধরতেন। আপনার পরিচয় জানবার জন্য আমি অত্যন্ত আগ্রহী হয়েছি। আমার বোধ হচ্ছে, আপনি সাধারণ কেউ নন।’ হনুমান ধীরে ধীরে শান্ত স্বরে নিজের পরিচয় দেন।

হনুমানকে দেখে ভীমসেন অত্যন্ত তৃপ্ত হন। আরও খুশি হন একথা শুনে যে, রামপত্নী সীতার কাছে এমনি বর পেয়েছিলেন হনুমান যে, যতদিন রামকথা পৃথিবীতে প্রচলিত থাকবে লোকমুখে ততদিনই হনুমানও রয়ে যাবেন এই পৃথিবীতে। কিন্তু যুগের প্রয়োজনে যুগের সঙ্গে তাঁর দেহের অবস্থা বদলে যাবে। ভীম অত্যন্ত খুশি হলেও সাগর লঙ্ঘনের সময় হনুমান যে বিশাল আকৃতি ধারণ করেছিলেন, সে আকৃতি দেখবার সাধ জাগে তাঁর মনে। তিনি নিজের ইচ্ছার কথাটা বলেই ফেলেন।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫১: সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন, তবেই বাড়বে মাছ নিয়ে সচেতনতা, উপকৃত হবে আমজনতা

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!

হনুমান বলে ওঠেন, ‘হে বীর! এখন দ্বাপর যুগ। এ সময়ে আমার আকৃতি এ যুগের অনুরূপ। প্রতিটি যুগের নিজের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তুমি বিজ্ঞ পুরুষ। তাই তুমি এমন অযৌক্তিক আগ্রহ দেখিও না। তাতেই তোমার মঙ্গল।’ ভীমসেন সে কথা শুনে নিজেকে সংযত করেন। তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ভ্রাতঃ! আপনি যদি চার যুগের কথা বিশদে বলেন, বড় উপকার হয়।’ হনুমান ভাইয়ের এই আবদার আর ফিরিয়ে দিলেন না। বিদ্বান বুদ্ধিমান হনুমান ধীর স্বরে যুগচতুষ্টয় আর তাদের বৈশিষ্ঠ্যের কথা বলতে থাকেন। জনহীন বনের মাঝে শ্রোতা শুধু ভীমসেন।
আরও পড়ুন:

ত্বকের পরিচর্যায়: দাদের সমস্যায় জেরবার? এই সব মানলে সারবে অসুখ

স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬: রামচন্দ্রের আবির্ভাব ও বসুন্ধরাকন্যা সীতার অনুষঙ্গ

একসময় সেসব কথাও ফুরোয়। ভীমসেন আবারও আবদার করেন, হনুমানের সেই বিশালাকার দেখবার জন্য। ভাইয়ের আবদার পুরোপুরি ফেলেন না হনুমান। ধীরে ধীরে শরীরটাকে বিপুলাকার করে তোলেন হনুমান। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখে চলেন ভীমসেন। হনুমান বলে চলেন, ‘আমি চাইলে এর থেকেও বৃহদাকার ধারণ করতে পারি। তবে এটুকুই তুমি দেখতে পেলে। আর নয়।’

মহাবীর হনুমান কুবেরের উদ্যানের পথ, পদ্মবনে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেন। এও বলে দেন যে, সে পথ সকলের নয়। সে পথ দেবতাদের। তাই জোর করে সে বাগান থেকে ফুল তোলা উচিত নয়। তারপর হনুমান ভীমসেনকে ধর্মের উপদেশ দেন। আর ভীমসেনের হনুমানকে দেখে যেন আশ মেটে না। তিনি শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে অশ্রুতপূর্ব সেসব কথা শুনে চলেন।—চলবে
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content