বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


‘সূর্যস্য পশ্য শ্রেমাণং যো ন তন্দ্রযতে চরন’ ব্রাহ্মণের গল্পটির গাথাটিকে যুধিষ্ঠির যেন মনে গেঁথে নিয়েছিলেন। পথ চলতে চলতে আলস্যগ্রস্ত হলে চলবে না। নতুন দেশ, নতুন মানুষের সঙ্গলাভ, পথশ্রমে অভ্যস্ত হওয়া, তারপর আরও এগিয়ে যাওয়া…এই তো চলছিল। পূর্বভারত হয়ে তখন তাঁরা পশ্চিমের পথে বৈদুর্য্যপর্বতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। লোমশমুনি সঙ্গেই ছিলেন। যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্য করে মুনি বলে ওঠেন, ‘মহারাজ! এই হল বৈদুর্য্যপর্বত আর এখানেই রয়েছে প্রভাবশালী শর্যাতিরাজার যজ্ঞভূমি।’

মুনি আরও বলে চলেন, ‘এই সেই স্থান যেখানে চ্যবনমুনি শর্যাতিকন্যা সুকন্যাকে পত্নী হিসেবে লাভ করেন। শুধু তাই নয়! চ্যবনমুনিই অশ্বিনীকুমারযুগলকে যজ্ঞে সোমের ভাগ পাইয়ে দেন।’ মুনির কথা ফুরোতে না ফুরোতেই যুধিষ্ঠির বলে ওঠেন, ‘হে মুনিবর! এই সমস্ত আখ্যান আমি বিশদে শুনতে চাই। আপনি দয়া করে অবিলম্বে আমার কৌতূহল নিরসন করুন।’ গল্প বলাতে লোমশমুনির কোনো ক্লান্তিবোধ নেই। তিনি বলে চলেন নিজের ছন্দে।
ভৃগুমুনির চ্যবন নামে এক পুত্র ছিলেন। বৈদুর্য্যপর্বতে এক সরোবরের তীরে তিনি দীর্ঘ বহু বছর ধরে তপস্যা করছিলেন। এক সময় উইপোকা মাটি দিয়ে তাঁর শরীর ঢেকে দেয়। তার ওপর লতাপাতায় ঢেকে যায়। তাও তিনি অবিচল অবস্থায় ভয়ঙ্কর তপস্যায় ডুবেছিলেন। একদিন রাজা শর্যাতি তাঁর স্ত্রীকন্যা লোকজনসহ সেই সরোবরের তীরে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসেন। রাজকন্যা সুকন্যা সখীদের সঙ্গে নিয়ে পার্বত্য উপত্যকার অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন, ইতস্তত বেড়াচ্ছিলেন। কখনও গাছের ফুল ফল পাড়ছিলেন, সখীদের সাহায্য নিয়ে। সুকন্যা এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে কিছুক্ষণের জন্য একলা হয়ে পড়েন আর নিজের অজান্তেই চ্যবনমুনির উইয়ের ঢিবির সামনে এসে উপস্থিত হন। ঠিক সেই মুহূর্তে মুনির ধ্যান ভেঙেছিল।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৭: রামকথা শ্রবণ— তীর্থে বাসের পুণ্যলাভ করলেন পাণ্ডবেরা

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১: চায়ের দোকান থেকে বিশ্বজয়

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৯: নদীর তীর, বনের পথ, শোক সামলে ছুটল রথ…

ধ্যান ভাঙতেই মাটির স্তূপের মধ্য থেকে মুনি দেখতে পেলেন একলা সুকন্যাকে। মুগ্ধ হলেন মুনি। কতকাল তাঁর এভাবেই একলা কেটেছে। এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কটা লোকই বা আসে! ‘কে এই নারী?’ মুনি আপনমনেই বলে ওঠেন। তারপর ঢিবির অন্তঃস্থল থেকে প্রাণপণে কিছু বলে উঠতে চান। কিন্তু সেসব কথা মাঝপথেই আটকে পড়ে থাকে। সুকন্যার কোনওকিছুই চোখে পড়ে না। ততক্ষণে সুকন্যার সখীরা উপস্থিত। ঢিবিটি সকলের চোখে পড়ে। হঠাত্ই সুকন্যা দেখেন ঢিবির মধ্যে কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে। সখীদের সঙ্গে কৌতুক করতে করতেই কাঠি দিয়ে ঢিবির মাটিতে খুঁচিয়ে দেখতে যান যে সেটি কি! কাঠিটা মুনির চোখে বিদ্ধ হয়। মুনি রেগে গিয়ে তপোবলে রাজার সৈন্যসামন্তদের মলমূত্রাদি বন্ধ করে দেন।

এদিকে রাজার সৈন্যরা তো মহা আতান্তরে পড়ল। তারা রাজার কাছে গিয়ে সব বিশদে বলল। প্রথমটা রাজাও সব শুনে হতবাক হযে পড়লেন। তারপর সৈন্যদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ রয়েছো যে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতসারে কোনও মুনিকে অবজ্ঞা করেছো!’ সৈন্যরা সকলেই জানান, তারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
আরও পড়ুন:

ডায়াবিটিস ধরা পড়েছে? হার্ট ভালো রাখতে রোজের রান্নায় কোন তেল কতটা ব্যবহার করবেন? দেখুন ভিডিয়ো

সাবান দিয়ে মুখ ধুলে ত্বকের ক্ষতি হয়? নাকি অল্প বিস্তর ব্যবহার করাই যায়?

এদিকে রাজকন্যা সুকন্যার কানেও এই খবরটা পৌঁছেছিল। সুকন্যা স্বীকার করলেন উইয়ের ঢিবিতে তিনি একটি জ্বলজ্বলে বস্তুকে বিদ্ধ করেছেন। শর্যাতিরাজা বুঝতে পারলেন, একটি অনর্থ ঘটেছে। তিনি সকলকে সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষণাৎ সেই ঢিবির কাছে এসে উপস্থিত হলেন। তারপর ঢিবির মাটি সরিয়ে বৃদ্ধ চ্যবনকে দেখতে পেলেন। করজোড়ে স্বকন্যা সুকন্যার হয়ে ক্ষমা চাইলেন রাজা।

মুনি বললেন, ‘আমি আহত হয়েছি, এ সত্য। তবে আপনি যদি আপনার কন্যাকে আমার হাতে সম্প্রদান করেন, তবে আমি ক্ষমা করব।’ রাজা দ্বিধা করলেন না। বৃদ্ধ মুনির সঙ্গে রাজার সুন্দরী যুবতী কন্যার বিবাহ হয়ে গেল। রাজা রাজধানীতে ফিরে গেলেন। চ্যবনসুকন্যার সংসার উভয়ের তপোগুণে তপস্থলীতে পরিণত হল।
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content