শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অকৃতব্রণ বলে চলেন জমদগ্নির কথা, রামের কথা। সত্যবতীর পুত্র জমদগ্নি আপন মেধাবলে বেদাদিশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়ে উঠলেন। শাস্ত্রের সাথে সাথে শস্ত্রবিদ্যাও তাঁর আয়ত্তে এল। শস্ত্রশাস্ত্রে কৃতবিদ্য তপোভাবাপন্ন জমদগ্নিরও একসময় সংসার করবার বাসনা জাগল। কোনও একদিন প্রসেনজিত্রাতজার কন্যা রেণুকা তাঁর দৃষ্টিপথে এলেন। মুগ্ধ হলেন জমদগ্নি। পাণিপ্রার্থী হয়ে তিনি রাজার কাছে গেলেন। রাজা সব শুনে বুঝলেন, তাঁর কন্যার জন্য ভৃগুবংশজাত জমদগ্নির মতো এমন উপযুক্ত পাত্র দুর্লভ। রাজা সানন্দে জমদগ্নির এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। বিবাহের পর জমদগ্নি আর রেণুকার দাম্পত্যজীবন সরলরৈখিক পথে এগুতে লাগল। মুনির ধর্মকর্মে রেণুকা যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠলেন। জমদগ্নির ঔরসে রেণুকার পাঁচটি পুত্রের জন্ম হল। রাম ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট কিন্তু তিনি বিদ্যায়, বুদ্ধিতে পিতামাতার শ্রেষ্ঠ সন্তান ছিলেন। এই পাঁচপুত্রকে নিয়ে মুনি আর মুনিপত্নীর জীবন সুখেই কেটে যেতে লাগল।
কিন্তু জীবন কি আর সবসময়ই একখাতে বয়? মুনি আর মুনিপত্নীর এমনধারা সরলরৈখিক সুখের জীবনও হঠাত্ইস বদলে গেল এক লহমায়। সেদিন আশ্রমে কেউই উপস্থিত ছিলেন না এক রেণুকা ছাড়া। ছেলেরা গেছেন ফলসংগ্রহে আর মুনিও বিশেষ কার্যবশতঃ কুটিরে অনুপস্থিত। রেণুকা রোজকার মত স্নান করতে বেরোলেন। কুটিরের কাছেই জলাশয়। এ পথে তাঁর নিত্য আসা যাওয়া একলাটিই। স্নান সেরে ফেরার পথে চোখে পড়ল দৃশ্যটা। রাজা চিত্ররথ তাঁর পত্নীর সঙ্গে জলকেলিতে মগ্ন ছিলেন। রেণুকা রাজার রূপ দেখে মুগ্ধ হলেন। ফিরে এলেন আশ্রমে। ঘরে ফিরে এলেও মন তাঁর কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। সত্যদ্রষ্টা মুনি জমদগ্নি পত্নীর এই অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করলেন। ধীরে তিনি সবটাই বুঝতে পারলেন। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন তিনি। একে একে মুনির ছেলেরা ফিরে এলেন আশ্রমে। জমদগ্নি তাঁদের সকলকেই আদেশ করলেন মাতৃবধ করবার জন্য। কিন্তু মায়ের প্রতি প্রবল স্নেহবশত কেউই পিতার কথায় সম্মত হলেন না।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৬: ভৃগুবংশে জন্ম নিলেন পরশুরাম— চরুবদলের ভুলে ক্ষত্রতেজ পেলেন তিনি

পর্ব-৪৯: বসুন্ধরা এবং…

একই হেয়ার স্টাইলে একঘেয়েমি? ফ্যাশনে চুলের বাহার আনতে জেনে নিন কোনটা আপনার?

ক্রুদ্ধ পিতা তাঁদের জড়বত হয়ে থাকার অভিশাপ দিলেন। পিতা এবার আদেশ দিলেন কনিষ্ঠ সন্তান রামকে। পিতার আদেশ শোনামাত্র রাম কুঠার হাতে সেই আদেশ পালন করলেন। জমদগ্নির ক্রোধ আর রইল না। রামের ওপর তিনি অত্যন্ত তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘হে প্রিয়পুত্র! তুমি কি বর চাও?’ রাম পিতার আদেশ অমান্য করেননি বটে। তবে ভাইদের জড়দশা কিংবা মাতৃবিয়োগ কোনোটাই তাঁকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। পিতার কাছে তিনি ভাইদের আর মাতাকে ঠিক আগের মতোই ফিরে পেতে চাইলেন। জমদগ্নির ইচ্ছেতে সপুত্র রেণুকা পূর্বশরীর ফিরে পেলেন। এছাড়াও পিতার বরে রাম প্রবলবলশালীও হলেন।
আরও পড়ুন:

ত্বকের পরিচর্যায়: যখন তখন হানা দিতে পারে ফাঙ্গাল ইনফেকশন, কী ভাবে বাঁচবেন? রইল উপায়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৬: সংসার সুখের হয় ‘চাঁপাডাঙার বৌ’-র গুণে

পাহাড়ের উপর ছবির মতো সুন্দর শ্রবণবেলাগোলা— চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এক অজানা অধ্যায়

আবার সমস্ত কিছু পূর্বের মত সরলরৈখিক পথে চলতে লাগল। সেদিন জমদগ্নির পুত্রেরা প্রতিদিনের মতো ফলসংগ্রহে বেরিয়েছেন, এমন সময় সহস্রবাহু রাজা কার্ত্তবীর্যার্জুন সেই আশ্রমে এলেন। রেণুকা অতিথিকে যথোচিত সত্কার করলেন। কিন্তু প্রবলবলশালী সহস্রবাহু রাজা তাতে তুষ্ট হলেন না। তিনি জোর করে আশ্রমের হোমধেনুটিকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে আশ্রমকে তছনছ করে দিয়ে গেলেন। ব্যথিতমনা জমদগ্নি পুত্রদের এ সমস্তকিছুই খুলে বললেন। কনিষ্ঠপুত্র রামই ছিলেন সেই সন্তান যিনি পূর্ব পুরুষদের কৃত ভুলে ব্রাহ্মণ হয়েও মনে মনে ক্ষত্রিয়তা বহন করে চলছিলেন। অন্য পুত্ররা না এগিয়ে এলেও রাম পিতার কথায় কার্ত্তবীর্যার্জুনকে আক্রমণ করলেন।
আরও পড়ুন:

বড়দিনের ডিম ছাড়া স্পেশাল ফ্রুট কেক এ বার বাড়িতেই! কী ভাবে বানাবেন? রইল সহজ রেসিপি

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৮: অযোধ্যাবাসীরাও কি সঙ্গী বনযাত্রায়?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৫: আমাদের পাতে মাছের বৈচিত্র্য থাকুক, আবার মৎস্যজীবিরাও রুই, কাতলার সঙ্গে এদের চাষের আওতায় আনুন

শুরু হল যুদ্ধ। প্রবল সে যুদ্ধে কার্ত্তবীর্যার্জুন মৃত্যুবরণ করলেন। অর্জুনের ছেলেরা এই সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হল। তারা জমদগ্নিমুনিকে আক্রমণ করল এবং হত্যা করল। রাম ফিরে এসে অমন প্রভাবশালী পিতার এমন মৃত্যু দেখে হতচকিত হলেন আর পিতার মরদেহকে জড়িয়ে ধরে নানান বিলাপ করতে লাগলেন। অবশেষে নিজেকে শক্ত করলেন তিনি আর কুঠারখানা হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন এই পৃথিবীকে তিনি ক্ষত্রিয়শূন্য করবেন। পিতার কাছে তিনি বর পেয়েছিলেন, তিনি যুদ্ধে অপরাজেয় হবেন। কার্ত্তাবীর্যাজুনের পুত্রেরা সকলে মিলেও একলা রামের মোকাবিলা করতে পারল। তাদের হত্যা করার পর ক্ষত্রিয়বিনাশের জেদ যেন ভর করল তাঁর মধ্যে। অপরাধী নিরপরাধ নির্বিশেষে ক্ষত্রিয়নিধনের নেশায় মেতে উঠলেন তিনি। এভাবে একুশবার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করলেন। ধীরে তাঁর ক্রোধ শান্ত হল।

অকৃতব্রণ যুধিষ্ঠিরকে বলে চলেন, ‘হে রাজন এই সেই পর্বত যেখানে পরশুরাম বাস করেন। তিনি এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন যার শেষে পুরোহিতদের প্রচুর দক্ষিণা দিয়েছিলেন। নিজের বাসযোগ্য ভূমিটুকুও তিনি কশ্যপমুনিকে দান করেন।’ এভাবে অকৃতব্রণের কাছে প্রবলবলশালী, বিদ্বান, দীর্ঘজীবী রামের আখ্যান, তাঁর পিতৃভক্তির কথা শুনে মুদ্ধ হলেন আর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মহেন্দ্রপর্বতে তাঁদের তীর্থাবাস এর কাল ফুরালো। এবার ঈপ্সিত দর্শনের পরই আবারও পথে চলার পালা।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content