সগররাজা রাজ্যের ভার পৌত্র অংশুমানের ওপর সঁপে দিয়ে যান। আর অংশুমানের পর সেই রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন রাজা দিলীপ। দিলীপের পুত্র ছিলেন ভগীরথ। দিলীপ পিতৃপুরুষদের উদ্ধার করবার জন্য, গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে দায়িত্বের জন্য হয়তো ভগীরথই নির্বাচিত ছিলেন। পিতা দিলীপ সিংহাসনে আসীন হওয়া যাবত চিন্তা করে এসেছেন জল আনয়নের কথা। কপিলের অভিশাপে যাদের মৃত্যু হয়েছিল, সেই সগররাজার পুত্রদের সদ্গতি সম্ভব হতে পারে একমাত্র যদি গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসা সম্ভবপর হয়, তবেই।
হিমালয়ের দুর্গমতম প্রদেশে দীর্ঘযাত্রা, সে পথে তীব্র তপস্যা, আর পরিশেষে স্বর্গবাসিনী গঙ্গার মর্ত্যে আসার পথ তৈরি করা, এক ভগীরথের জন্যই যেন এসমস্ত কিছু নির্দিষ্ট হয়ে ছিল। এমন অসম্ভব কাজ তিনি সম্ভব করলেন। ভগীরথের স্তবে তুষ্ট মহাদেব গঙ্গার তীব্র বেগকে জটায় ধারণ করলেন। সেখান থেকে গঙ্গা মর্ত্যে এলেন। ধুয়ে মুছে গেল সমস্ত গ্লানি, পাপ। মুক্ত হলেন সগররাজার ছেলেরা। সমুদ্র আবার জলপূর্ণ হল।
আরও পড়ুন:
পর্ব-৪৩: সমুদ্রশোষণ তো হল, এবার পূরণ করবে কে?
কিম্ভূতকাণ্ড, পর্ব-১: পোড়া গাছের ডাল থেকে নেমে এল সে! ভাটার মতো সবজে চোখ, ধোঁয়াটে শরীর…
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৫: বনবাসের সঙ্গী সীতা
এ ভাবে লোমশমুনির কাছে ভগীরথের গঙ্গানয়নবৃত্তান্ত শুনে যুধিষ্ঠির অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তীর্থযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে এমন ভাবে তীর্থমাহাত্ম্য শোনার সৌভাগ্য আর ক’জনের ভাগ্যেই বা ঘটে! একের পর এক তীর্থে গমন, নদীস্নান একই সঙ্গে চলতে লাগল যুধিষ্ঠিরের। নন্দানদী, অপরনন্দানদী দর্শন আর স্নান সেরে সেদিন যুধিষ্ঠির ভাইদের সঙ্গে কৌশিকীনদীর তীরে এসেছেন। লোমশমুনিও রয়েছেন সঙ্গে। এই কৌশিকীনদীই আজকের কোশি নদী যা কাটিহারের কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিলেছে। পুণ্যতোয়া কৌশিকীনদীর তীরে শোভা পাচ্ছে মনোরম আশ্রমপদ।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৬: ‘সত্যেরে লও সহজে’—রাজসুখ ছেড়ে কি তবে বনবাসী মন?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪১: ঠাকুরবাড়িতে এসে সাহেব খেতেন ভাজা চিঁড়ের সঙ্গে কড়াইশুঁটি
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১২: সে এক ‘বউঠাকুরাণীর হাট’ [১০/০৭/১৯৫৩]
লোমশমুনি যুধিষ্ঠিরকে বলে ওঠেন, ‘হে রাজন এই হল রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের আশ্রম। আর ওই দিকে যে রমণীয় বৃক্ষরাজিতে ঘেরা আশ্রমস্থলী দেখা যাচ্ছে, সেটা হল বিভাণ্ডকমুনির আশ্রম। আর তাঁর পুত্র ছিলেন মহাতপা ঋষ্যশৃঙ্গমুনি।’ যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করেন, ‘হে মুনিপ্রবর! আপনি দয়া করে বিভাণ্ডকমুনির কথা বিস্তারিতভাবে বলুন। ঋষ্যশৃঙ্গমুনির তপস্যার প্রভাব কেমন ছিল, আমি এও জানতে উৎসুক।’ লোমশমুনি ধীরে ধীরে যুধিষ্ঠিরের কৌতূহল নিরসন করেন। যাত্রাপথে শুরু হয় আর এক আখ্যান। বিভাণ্ডক আর ঋষ্যশৃঙ্গমুনির কথা।
আরও পড়ুন:
বিনোদন: ‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২
খাই খাই: ভোজবাজি এ বার বাড়িতেই, রইল লোভনীয় স্বাদের নবাবি ফিরনি-র রেসিপি
বিভাণ্ডকমুনি কোন একসময় তপস্যা করতে করতে পরিশ্রান্ত হয়ে তপস্থলীর পাশের এক সরোবরে স্নান করতে নামেন। সেই পথে স্বর্গের অপ্সরাশ্রেষ্ঠা উর্বশীকে যেতে দেখে তাঁর তপঃক্লান্ত মন উচাটন হয়। স্নানরত অবস্থাতে জলের মধ্যেই মুনির শুক্রস্খলন হয়। সেই সরোবরে জল খেতে এসেছিল এক হরিণী। হরিণীটি শুক্রপান করে।
আরও পড়ুন:
বাইরে দূরে: বাংলা— পৌরাণিক অনন্যতায় ঘুড়িষা
ইংলিশ টিংলিশ: Transitive, Intransitive Verb এবং Object চেনা দিয়ে শুরু হোক Voice Change-এর প্রথম ধাপ
এই হরিণী ছিল এক শাপগ্রস্ত দেবকন্যা। হরিণীর গর্ভে জন্ম নেন ঋষ্যশৃঙ্গমুনি। আর হরিণীর শাপমুক্তি ঘটে। মহাভারতের গল্পকথার আড়ালে এমন কতশত কথা লুকিয়ে রয়েছে। লোমশমুনি বলে যাওয়া সে অদ্ভুত আখ্যান শুনতে শুনতে যুধিষ্ঠির ভেবে চলেন, এও কি সম্ভব? হরিণীর গর্ভে মানুষের জন্ম কী করে সম্ভব হতে পারে? তবে কী সেই দেবকন্যা দেবসুলভ স্থিরতা হারিয়ে শাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যে স্থান পেয়েছিল? মুনিপুত্রের জন্ম দিয়ে হরিণীর চাপল্যকে পিছনে ফেলে মুক্তি হল তার? তবে কী?….যুধিষ্ঠির আশ্চর্যচিত্তে ভেবেই চলেন। লোমশমুনির গল্পও এগিয়ে চলে নিজের গতিতে।