রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


বাহুকের রথ বাতাসের বেগে চলতে লাগল বিদর্ভরাজ্যের দিকে। তাতে সওয়ার হলেন ঋতুপর্ণরাজা আর সারথি বার্ষ্ণেয়। এ দিকে বার্ষ্ণেয় নলরাজারই সারথি ছিল। নলরাজা রাজ্যহারা হলে সে অযোধ্যায় ঋতুপর্ণরাজার আশ্রয় নেয়। বার্ষ্ণেয় নলরাজার অশ্বচালনায় দক্ষতার কথা আগে থেকেই জানত। বাহুকের এমন দক্ষতা তাকে ধন্দে ফেলে দেয়। এমন দক্ষতা তো সে নলরাজা ছাড়া কারো মধ্যে দেখেনি। অথচ, এ কুদর্শন লোকটি কোনওভাবেই নল হতে পারেন না। তবে এ কে? এদিকে রাজাও বাহুকের অশ্বচালনায় এমন যত্ন দেখে মনে মনে ভাবছেন, তবে কি ইনি ইন্দ্রসারথি মাতলি? নাকি অশ্বতত্ত্বজ্ঞ শালিহোত্র? রাজা বা বার্ষ্ণেয় নলের বিকৃতরূপের কথা ভেবে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেন না।

এদিকে রথ এগিয়ে চলল তার নিজের গতিতে। পথে একটি বহেড়াগাছ দেখে ঋতুপর্ণরাজা বাহুককে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বাহুক, তুমি যেমন অশ্বচালনে সুদক্ষ, ঠিক তেমনি আমি গণনায় সুনিপুণ। এই যে গাছটি দেখছ, এতে কটি পাতা আর কটি ফল রয়েছে, তা আমি দূর থেকেই বলে দিতে পারি অনায়াসে।’ বাহুক সে কথা শুনে মনে মনে একটু আশ্চর্য হয়। তার রথ থেকে নেমে সেই গাছের একখানি ডাল ভেঙে রাজার সামনে এনে বলে, ‘মহারাজ এই ডালটির পাতা আর ফলের সংখ্যা যদি আপনি বলতে পারেন, তবে আমি স্বীকার করব যে আপনি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী।’ তারপর ঋতুপর্ণরাজা সেই অসাধ্যসাধন করলে, বাহুকরূপী নল অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন আর সেই বিদ্যা শিখতে উৎসুক হলেন।
ঋতুপর্ণরাজা তাঁকে জানালেন যে তিনি অক্ষবিদ্যা জানেন আর দ্রুতগণনায় সুদক্ষ। বাহুকের কছে ঋতুপর্ণরাজা অশ্ববিদ্যা শিখলেন আর বাহুকরূপী নলরাজা অক্ষবিদ্যালাভ করলেন ঋতুপর্ণরাজার কাছ থেকে।
কলি কর্কোটকনাগের বিষে জর্জরিত হয়ে এতকাল অতি কষ্টে নলের দেহে বাস করছিল। যেই মাত্র নলরাজা অক্ষবিদ্যালাভ করলেন, কলি নলের শরীর থেকে বেরিয়ে এল। কলির প্রভাবমুক্ত নলও প্রকৃতিস্থ হলেন।

তবে কর্কোটকনাগের বিষের প্রভাবে তাঁর শরীরের বিকৃতি রয়েই গেল। এদিকে কলির শাপমুক্তি হল। কলির কাতর প্রার্থনায় নলরাজা তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন। নলরাজার সঙ্গে কলির এই কথোপকথন সকলের আড়ালেই হল। তারপর যথাসময়ে ঋতুপর্ণরাজা দুই সারথির সঙ্গে বিদর্ভরাজ্যে এসে পৌঁছলেন। বিদর্ভদেশের রাজা ভীম তাঁকে যথাযথ আপ্যায়ন করে তাঁর আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। আর এদিকে ঋতুপর্ণরাজাও চারপাশে স্বয়ংবরসভার কোন আয়োজন না দেখে মনে মনে বিবেচনা করে বললেন, ‘আপনাকে অভিবাদন করতে এসেছি।’ এতদূর দেশ থেকে শুধু অভিবাদনের উদ্দেশ্যে এসেছেন ঋতুপর্ণরাজা? ভীমরাজা একথা শুনে মনে মনে অবাক হলেও মুখে তা প্রকাশ করলেন না। রাজার যথোচিত বিশ্রামের বন্দোবস্ত হল। আর সারথিরাও ঘোড়াশালে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৫: বাহুকরূপী নলের রথ ঋতুপর্ণরাজাকে নিয়ে তীব্র বেগে বিদর্ভের পথে চলল

ছোটদের যত্নে: শিশু পেটের ব্যথায় ভুগছে? তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি মেনে চলুন

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৭: অপেক্ষার অবসান — অযোধ্যায় চার রাজকুমার

ত্বকের পরিচর্যায়: হঠাৎ শিশুর জ্বর আর মুখে-হাতে দানাদানা? কোন রোগের উপসর্গ? জানুন বিশেষজ্ঞের মতামত

এদিকে দময়ন্তী ঋতুপর্ণরাজা প্রবেশের সময়, নলরাজা অশ্বধারণ করলে যেমন শব্দ হয, সেইরকম রথের শব্দ শুনে নলকে দেখার আশায় উতলা হয়েছিলেন। কিন্তু ঘোড়াশালে আড়াল থেকে দুই সারথিকে দেখে বার্ষ্ণেয়কে চিনতে পারলেও বেঁটেখাটো নলকে চিনতে পারলেন না তিনি। কিন্তু তাঁর মনের সন্দেহ গেল না। তিনি ভাবলেন, কিছু একটা রহস্য অবশ্যই রয়েছে। সাতপাঁচ ভেবে কেশিনী নামের এক দূতীকে তিনি পাঠালেন ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞাসাবাদ করে আসবার জন্য। কেশিনী দময়ন্তীর কথামতো বাহুকের সঙ্গে আলাপ করল আর তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ জিজ্ঞেস করল। বাহুকরূপী নল তার কথার জবাব দিলেও নিজের পরিচয় প্রকাশ করলেন না। কেশিনী তখন দময়ন্তী যেমনটি শিখিয়ে দিয়েছিলেন সেই সুরে বলতে লাগল, ‘এক ব্রাহ্মণ যখন অযোধ্যায় গিয়েছিলেন, তখন তাঁকে আপনি যে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তারই প্রেক্ষিতে বলি, আপনি দয়া করে দময়ন্তীর কোনও প্রিয় সংবাদ দিন। নলের খবর দিয়ে আমাদের রাজকন্যার প্রাণ রক্ষা করুন।’
আরও পড়ুন:

ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৬: বসুন্ধরা এবং…

মনের আয়না: আপনার সন্তান কি মোবাইলে আসক্ত? এর থেকে মুক্তি পেতে জানুন মনোবিদের পরামর্শ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১৭: শোকস্তব্ধ কবি সারারাত ছাদে পায়চারি করেছিলেন

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩১: স্বাদ-বৈচিত্র্যে অতুলনীয় মাছ চাষে উদ্যোগী হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

একথা শুনে বাহুকরূপী নলরাজা আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি ব্রাহ্মণকে যেমনটি বলেছিলেন তেমন সুরেই বলতে বলতে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলেন না। দাসী এসমস্তই লক্ষ্য করছিল। সে দময়ন্তীকে সবকথা জানাল। দময়ন্তীর নির্দেশে দাসী আরও লক্ষ্য করে এসে জানাল যে নলরাজা রন্ধনবিদ্যাতেও নিপুণ। দময়ন্তী বাহুকই নল এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিজের পুত্রকন্যাকে বাহুকরূপী নলের কাছে পাঠালেন। নলরাজা পুত্রকন্যাকে পেয়ে তাদের কোলে নিয়ে কেঁদে ভাসালেন। কিন্তু তবুও নিজের পরিচয় প্রকাশ করলেন না। মুখে বললেন, ‘এই ছেলেমেয়েরা আমার নিজের ছেলেমেয়ের মতো। তাদের আমি অনেকদিন দেখিনি। তাই এদের কাছে পেয়ে মন ভারাক্রান্ত।’

দাসীর মুখে দময়ন্তী এসমস্ত কিছু শুনলেন আর আরো নিশ্চিত হলে নলের বিষয়ে। তবে বাহুকরূপী নলরাজার রূপ নিয়ে একটা খটকা রয়েই গেল তাঁর। তিনি অনন্যোপায় হয়ে নিজের মায়ের কাছে উপস্থিত হয়ে নলের সাথে সরাসরি কথা বলবার আর্জি জানালেন। মেয়ের মনোকষ্ট রাজারানি উভয়েই এতকাল দেখেছেন। আজ বিকৃতদেহী নলের পরিচয় যথাযথভাবে না জেনেও শুধুমাত্র কন্যার ইচ্ছার মর্যাদা রাখবার জন্য বাহুকরূপী নলের সাথে সাক্ষাৎ করবার অনুমতি দিলেন তাঁরা।

Skip to content