বুধবার ১৩ নভেম্বর, ২০২৪


বনের পথে বহু পথ পেরিয়ে সেই বণিকেরা এক মনোরম সরোবরের তীরে উপস্থিত হল। সেই সরোবরের তীরে ছিল প্রচুর ঘাস আর সবোবরের জল ছিল নির্মল। আর সেখানেই রাত কাটাবে বলে স্থির করল। বণিকদের দলের সঙ্গে যে হাতিগুলি ছিল তাদেরও আপাত ঠাঁই এর ব্যবস্থা হল। রাত্রি হলে সকলে নিদ্রা গেলে সেই পথে নদীতে জল খেতে এল একদল বুনো হাতি। বণিকেরা হাতীদের যাতায়াতের পথ জুড়েই শয়ন করেছিল। ফলতঃ হাতিরা ক্ষুব্ধ হল। হাতিরা কাউকে দাঁতের আঘাতে , কাউকে আবার পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলল। শুঁড়ে তুলে আছড়ে ফেলল অনেককে। এ ভাবে বণিকদল তছনছ হয়ে গেল।

দময়ন্তীর হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হলে তিনি উঠে এসব কিছু দেখে ভয়ে বিহ্বল হলেন। বণিকদের দলে যারা তখনও অক্ষত ছিল তাদের অনেকেই শোকে উন্মত্তপ্রায় হল আর ধূলিধূসরিত দময়ন্তীকে এমন আকস্মিক বিপদের কারণস্বরূপিণী অপদেবতা বলে চিহ্নিত করল। তারা ঠিক করল দময়ন্তীকে কাছে পেলে হাতের কাছে যা পাবে তাই দিয়ে অবশ্যই হত্যা করবে। দময়ন্তী সেকথা শুনতে পেলেন। অত্যন্ত দুঃখিতা হলেন তিনি। উপর্যুপরি এমন বিপদে তিনি নিজের ভাগ্যকে দায়ী করতে লাগলেন। কখনও মনে করতে লাগলেন, এমন ভয়ানক বিপদেও কেন তাঁর মৃত্যু হল না। হাতিদের আকস্মিক আক্রমণে সে পথে যাত্রাকারী কিছু ব্রাহ্মণেরও মৃত্যু হয়েছিল। যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁদের সঙ্গে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন দময়ন্তী। এ ভাবে চলতে চলতে আধখানা মাত্র কাপড়ের টুকরো পরনে, ধূলিধূসরিত বিকট দেহে দময়ন্তী চেদিরাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন।
নগরের বাচ্চা ছেলেরা দময়ন্তীর এমন দশা দেখে পাগল বলে মনে করে কৌতুকবশে তাঁর পিছু পিছু যেতে লাগল। চেদি রাজার মা দূর থেকে রাজভবনের পথে চলতে থাকা দময়ন্তীকে দেখে দয়াপরবশ হলেন। ধূলধূসরিত দেহের আড়ালে দময়ন্তীর সুন্দর মুখখানি তাঁর নজর এড়াল না। নিজের ধাত্রীকে পাঠালেন এই বলে, ‘যাও, উন্মত্তার মত বেশধারিণী অনাথাকে নিয়ে এসে আমার কাছে।’ দময়ন্তী এইভাবে চেদিরাজার অন্তঃপুরে ঠাঁই পেলেন। এতকাল তিনি জনে জনে নিজের পরিচয় দিয়ে এসেছেন। তাতে না পেয়েছেন নলের খোঁজ, না কেউ তাঁর কথায় বিশ্বাস করেছে। রাজান্তঃপুরে তিনি আশ্বস্তবোধ করলেন। বনের বিভীষিকাময় দিনগুলো তাঁকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে।
আরও পড়ুন:

মুম্বইয়ের ভয়ংকর পথ দুর্ঘটনা, প্রয়াত টাটা সন্সের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রি

তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মীরা জ্যামে আটকে, পাঁচ ঘণ্টায় লোকসান ২২৫ কোটি টাকা!

রাজমাতার প্রশ্নের উত্তরে দময়ন্তী সত্য গোপন করলেন। নিজের পরিচয় গোপন করে বললেন, ‘পতি আমায় ত্যাগ করেননি। আমি সৈরিন্ধ্রীজাতীয়া রমণী, ফলমূলমাত্র ভোজন করি, একলাই থাকি, আর যেখানে রাত্রি হয়, সেখানে বাস করি।’ তিনি ধীরে নিজের জীবনের সমস্ত কথাই বলেন। শুধু নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন না। শোকার্ত্তা দময়ন্তী ভাগ্যবিপর্যয়ে বিপদ্গ্রস্ত স্বামী তাঁকে বিনা দোষে ত্যাগ করে চলে গিয়েছেন এ কথা বলতে বলতে ভেঙে পড়লেন কান্নায়। রাজমাতা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘তুমি আমার কাছে থাকো। আমার লোকেরাই তোমার পতিকে খুঁজে এনে দেবে।’ রাজমাতা নিজের কন্যা সুনন্দাকে ডেকে তার হাতে সৈরিন্ধ্রীকে সমর্পণ করলেন। তাকে বলে দিলেন, সৈরিন্ধ্রীর যেন কোনও অমর্যাদা না হয়। সুনন্দা সৈরিন্ধ্রীকে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হল। দময়ন্তী এতদিনে একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেলেন।
আরও পড়ুন:

উচ্চ মাধ্যমিকে ইংরেজিতে পাশ, ‘আমব্রেলা গার্ল’ সুদীপ্তা এখন অনার্সের ছাত্রী

বৃষ্টির পূর্বাভাস কলকাতায়, ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা দক্ষিণবঙ্গের চার জেলায়, ভিজবে উত্তরবঙ্গও

ওদিকে নলরাজার কী হল? যুধিষ্ঠিরের এ প্রশ্নের উত্তরে বৃহদশ্ব মুনি বলে চলেন… নলরাজা ঘুমন্ত দময়ন্তীকে পান্থশালায় ত্যাগ করে ঘন অরণ্যে প্রবেশ করলে এক ভয়ানক দাবদাহ তাঁর চোখে পড়ল। হঠাৎ বনের মধ্য থেকে কোনো এক প্রাণীর শব্দ তাঁর কানে এল। প্রাণীটিকে বাঁচানোর জন্য বিপদের পরোয়া না করেই তিনি তত্ক্ষণাৎ আগুনের মধ্যে প্রবেশ করলেন। সেখানে দেখলেন, এক বিশাল নাগ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রয়েছে। সেই নাগ মানুষের গলায় নিজের পরিচয় দিল, ‘হে মহারাজ আমার নাম কর্কোটক। কোনও এক সময় নারদমুনিকে আমি প্রতারিত করেছিলাম। তাই তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে আমায় অভিশাপ দেন, যতদিন অবধি নলরাজা তোমায় এই স্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে না যান, তুমি এখানেই স্থাবরের মতো হয়ে থাকো। তিনি এলে তবে তোমার শাপমুক্তি হবে।’

কর্কোটক নাগ বলে ওঠে, ‘হে মহারাজ, আমি তোমার বন্ধু হব। সদুপদেশ দেব। তুমি আমায় শাপমুক্ত করো।’ কর্কোটক নাগ বড় সাধারণ কোনও নাগ ছিলেন না। যোগবলে সেই নাগ নিজেকে অত্যন্ত লঘু করে ফেললেন। তাঁর পরামর্শক্রমে নলরাজা তাঁকে বহন করে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন, যেখানে দাবাগ্নির লেশমাত্র ছিল না। এই সমস্ত কিছু যে ভবিতব্য তা কর্কোটক নাগের হাবভাবেই স্পষ্ট ছিল। কিন্তু এর পরে যা ঘটল , নলরাজা তার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলেন না। কর্কোটক নাগ রাজাকে বলে উঠলেন, ‘রাজা, তুমি এক দুই করে দশ অবধি গণনা করতে করতে চলো, আমি তোমার যাতে পরম মঙ্গল হয়, তাই করব।’ রাজা সেইমত দশ অবধি গণনা করামাত্র কর্কোটক রাজাকে দংশন করলেন। রাজার সোনার বরণ শরীরখানা সেই মুহূর্তে বিকৃত হয়ে গেল।

Skip to content