দুঃশাসনের এমন আচরণে দ্রৌপদী স্পষ্ট অনুভব করতে পারলেন, এই সভায় এমন একজনও নেই যিনি তাঁর সম্মান রক্ষা করতে পারেন। নিজের পাঁচ পতির দুর্বলতা তিনি জানেন। তাঁদের দোষারোপ করেন না। আর এটা তো সে সময়ও নয়। তাঁর সমস্ত দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস যেন মুহূর্তের জন্য টলে যায়। কৃষ্ণ কোথায়? কোথায় তাঁর প্রিয়সখা? আকুল হয়ে মনে মনে তাঁকে ডাকতে থাকেন। অমন বুদ্ধিমান পুরুষই এই প্রবলদের দমিয়ে রাখতে পারেন। যার কোনও গতি নেই, দৈবই হয়তো তার রক্ষাকর্তা হয়। আচমকা সভাস্থিত সকলে প্রত্যক্ষ করলে সেই আশ্চর্য ঘটনা। দুঃশাসন দ্রৌপদীর পরনের কাপড় ধরে টানছে। কিন্তু দ্রৌপদীর পরনের কাপড় ফুরাচ্ছে না মোটেই। বেড়েই চলেছে। লজ্জানিবারণে যেন ধর্ম দ্রৌপদীর সহায় হলেন। সম্বিত ফিরল সভাস্থ সকলের। দুঃশাসনের নিন্দায় ফেটে পড়লেন সকলে। এতক্ষণ যুধিষ্ঠির সহ অন্য পাণ্ডবেরা প্রায় নির্বাক ছিলেন। প্রতিবাদের স্বর শোনা গিয়েছিল একমাত্র দ্বিতীয়পাণ্ডবের কণ্ঠে। এবারেও গর্জে উঠলেন ভীমসেন। দুঃশাসনকে উদ্দেশ্য করে জলদগম্ভীরস্বরে বলে উঠলেন, ‘রে দুর্বুদ্ধি! আমি যদি যুদ্ধে তোর বুক চিরে রক্ত পান না করি, তবে যেন আমার পিতৃপুরুষদের উপযুক্ত গতি না হয়!’
মানুষের মন বড় দুর্বোধ্য। তাও আবার সেটা যদি হয় কোনো রাজনীতিকের মন। মহাভারতের এ পাশারণের আসর কত মনের সাথে পরিচিত করালো পাঠককে, কত মনের পরতে পরতে কত না ধূর্ততা, অভিসন্ধির মারপ্যাঁচ তা স্পষ্ট করল, কত বুদ্ধিদীপ্ত মনের ঝাঁঝালো প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল তাবড় সমাজরক্ষকদের তার ইয়ত্তা নেই। হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যাঁর অধিষ্ঠান, সেই বিদুরই একমাত্র পাণ্ডবদের সঙ্গে না থেকেও তাঁদের প্রতি পক্ষপাতিত্ববশতঃ কেন দুর্যোধনের বিরোধিতা করেছেন ক্রমান্বয়ে? কেনই অন্য বা অন্য কুরুবৃদ্ধেরা সব দেখেশুনেও চুপ করে রইলেন। কেউ যুধিষ্ঠিরের হাতে ধর্মরাজ্য গড়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন আর কেউ চুপ করে থেকে যেন বুঝিয়ে দিলেন ধৃতরাষ্ট্র আর সেই সঙ্গে দুর্যোধনের রাজত্বেই থাকবেন তাঁরা।
রাজনীতিকের তো ছোটখাটো কথায় সাধারণ মানুষের মত অপমান বয়ে নিয়ে বেড়ালে চলে না। যে ধর্মরাজ্যের স্বপ্ন দেখেন বিদুর সে স্বপ্নকে জিইয়ে রেখে দুর্যোধনের অপমান গায়ে না মেখে আবারও বলে উঠলেন সভাস্থ সকলকে লক্ষ্য করে —‘দ্রৌপদীর বাক্যের কেউ কেন জবাব দিচ্ছেন না? দ্রৌপদী কি জিতা নাকি অজিতা?’ সভা তবুও চুপ করে রইল। সভাস্থ সকলে স্থির হয়ে দেখল দ্রৌপদীর তেজ, ব্যক্তিত্ব। তিনি বারংবার প্রশ্নে বিদ্ধ করলেন সকলকে। মেয়েদের সম্মান নিয়ে সে সমাজে বুঝি তত ভাবনাই ছিল না, নচেত্, স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম কিভাবে বলতে পারেন, যাঁর যে বস্তুতে স্বত্ত্ব থাকে না, তিনি সেটা পণ রাখতে পারেন না, এ সত্য। তবে এও সত্য স্ত্রীর প্রতি স্বামীর স্বত্ত্ব রয়েছে।’ কিভাবে এই বলে ভীষ্ম পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যেতে পারেন?
স্বয়ংবরসভায় অপমানের জ্বালা জুড়োতে দুর্যোধন অপমানসূচক কথায় বিদ্ধ করতে লাগলেন দ্রৌপদীকে। কর্ণ তাঁকে দাসীবৃত্তি করতে বললেন। দ্রৌপদীকে পণ রাখা যে অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে, এ আক্ষেপের সুর ঝরে পড়ল ভীমসেনের কণ্ঠ থেকে। এমন দুর্যোগের দিনে একমাত্র তিনিই আজ অকপট। দুর্যোধনের একের পর এক রসিকতা আর সবশেষে দ্রৌপদীকে লক্ষ্য করে নিজের বাম উরু দেখানোর মতো অশ্লীল আচরণ আর সহ্য করতে পারলেন না ভীম। ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে আবারো এক কঠোর প্রতিজ্ঞা করলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, যুদ্ধে তিনি দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করবেন। আবারও বিদুরের সাবধানবাণী শোনা গেল। শোনা গেল অর্জুনের ক্ষীণ প্রতিবাদ। চারপাশের প্রকৃতিতেও যেন নানা অমঙ্গল দেখা যেতে লাগল। দ্রৌপদীর অসম্মান কানে কানে পৌঁছাল রাজ অন্তঃপুরে। গান্ধারী ছিলেন স্পষ্টবাদিনী। নিজের পুত্রের আচরণে যুগপত্ লজ্জিত আর দুঃখিত হলেন তিনি। নির্বাক ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘এ অন্যায়ের অবিলম্বে প্রতিকার করুন আপনি।’ এতক্ষণ ধৃতরাষ্ট্রও ছিলেন নিশ্চুপ দ্রষ্টা। কোনওদিনই বা তিনি নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? অথবা শাসন করতে পারেন ছেলেকে| গান্ধারীর কথায়, সম্বিত্ ফিরল তাঁর। তিরস্কার করলেন ছেলেকে। আর দ্রৌপদীকে মধুরস্বরে বললেন, ‘বলো পাঞ্চালী, তুমি কি চাও? তুমি যা চাও, তাই দেবো আজ তোমায়।’
দ্রৌপদীর আর কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে নিজের পতিদের মুক্তি ছাড়া? তাই চাইলেন তিনি। শুধু তাই চাইলেন। তার চাইতে আর একটিও বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না তাঁর। অর্জুনের প্রতি অসূয়ায়, পাণ্ডবদের প্রতি ক্রোধে আর কতকটা দ্রৌপদীর অপমানসূচক কথায় কর্ণ মন্দ আচরণ করে ফেললেও দ্রৌপদীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা ছিলই। দ্রৌপদীর এমন বর প্রার্থনায় নিজের সে অনুরাগ কর্ণ গোপন করতে পারলেন না। বলে উঠলেন, ‘মানুষের এমন সুন্দরী স্ত্রী এমন দেখেছি বটে, তবে কোনও স্ত্রীর এমন কাজ দেখিনি। আজ সহায়সম্বলহীন পাণ্ডবদের এমন দুর্দিনের সাগরে দ্রৌপদীই যেন শেষ তরী।’ কর্ণের কথা যেন শেল হয়ে বিঁধল পাণ্ডবদের হৃদয়ে। ভীমসেনকে শান্ত করে সকলকে সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কাছে অনুমতি নিয়ে ফিরে চললেন ইন্দ্রপ্রস্থে। সব ফিরে পেলেন তাঁরা। শুধু রয়ে গেল তীব্র ক্ষত।
শুধুই কি তাই? পাশায় জিতে একচ্ছত্র রাজত্বের বিন্দুমাত্র লোভ কি যুধিষ্ঠিরের মনে ছিল না? যদি নাই থাকবে তবে, এতবড় অঘটনের পরেও যুধিষ্ঠির আবার কিভাবে পাশাখেলার ফাঁদে পা দিয়ে ফিরে গেলেন হস্তিনাপুরে? নিয়তিকে কেই বা খণ্ডাতে পারে! ধর্মপুত্রও দমন করতে পারলেন না প্রবৃত্তিকে। বুদ্ধিভ্রষ্টের মত কারো পরামর্শ ছাড়াই অন্ধকার সাগরে ঝাঁপ দিলেন।
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
মানুষের মন বড় দুর্বোধ্য। তাও আবার সেটা যদি হয় কোনো রাজনীতিকের মন। মহাভারতের এ পাশারণের আসর কত মনের সাথে পরিচিত করালো পাঠককে, কত মনের পরতে পরতে কত না ধূর্ততা, অভিসন্ধির মারপ্যাঁচ তা স্পষ্ট করল, কত বুদ্ধিদীপ্ত মনের ঝাঁঝালো প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল তাবড় সমাজরক্ষকদের তার ইয়ত্তা নেই। হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যাঁর অধিষ্ঠান, সেই বিদুরই একমাত্র পাণ্ডবদের সঙ্গে না থেকেও তাঁদের প্রতি পক্ষপাতিত্ববশতঃ কেন দুর্যোধনের বিরোধিতা করেছেন ক্রমান্বয়ে? কেনই অন্য বা অন্য কুরুবৃদ্ধেরা সব দেখেশুনেও চুপ করে রইলেন। কেউ যুধিষ্ঠিরের হাতে ধর্মরাজ্য গড়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন আর কেউ চুপ করে থেকে যেন বুঝিয়ে দিলেন ধৃতরাষ্ট্র আর সেই সঙ্গে দুর্যোধনের রাজত্বেই থাকবেন তাঁরা।
রাজনীতিকের তো ছোটখাটো কথায় সাধারণ মানুষের মত অপমান বয়ে নিয়ে বেড়ালে চলে না। যে ধর্মরাজ্যের স্বপ্ন দেখেন বিদুর সে স্বপ্নকে জিইয়ে রেখে দুর্যোধনের অপমান গায়ে না মেখে আবারও বলে উঠলেন সভাস্থ সকলকে লক্ষ্য করে —‘দ্রৌপদীর বাক্যের কেউ কেন জবাব দিচ্ছেন না? দ্রৌপদী কি জিতা নাকি অজিতা?’ সভা তবুও চুপ করে রইল। সভাস্থ সকলে স্থির হয়ে দেখল দ্রৌপদীর তেজ, ব্যক্তিত্ব। তিনি বারংবার প্রশ্নে বিদ্ধ করলেন সকলকে। মেয়েদের সম্মান নিয়ে সে সমাজে বুঝি তত ভাবনাই ছিল না, নচেত্, স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম কিভাবে বলতে পারেন, যাঁর যে বস্তুতে স্বত্ত্ব থাকে না, তিনি সেটা পণ রাখতে পারেন না, এ সত্য। তবে এও সত্য স্ত্রীর প্রতি স্বামীর স্বত্ত্ব রয়েছে।’ কিভাবে এই বলে ভীষ্ম পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যেতে পারেন?
স্বয়ংবরসভায় অপমানের জ্বালা জুড়োতে দুর্যোধন অপমানসূচক কথায় বিদ্ধ করতে লাগলেন দ্রৌপদীকে। কর্ণ তাঁকে দাসীবৃত্তি করতে বললেন। দ্রৌপদীকে পণ রাখা যে অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে, এ আক্ষেপের সুর ঝরে পড়ল ভীমসেনের কণ্ঠ থেকে। এমন দুর্যোগের দিনে একমাত্র তিনিই আজ অকপট। দুর্যোধনের একের পর এক রসিকতা আর সবশেষে দ্রৌপদীকে লক্ষ্য করে নিজের বাম উরু দেখানোর মতো অশ্লীল আচরণ আর সহ্য করতে পারলেন না ভীম। ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে আবারো এক কঠোর প্রতিজ্ঞা করলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, যুদ্ধে তিনি দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করবেন। আবারও বিদুরের সাবধানবাণী শোনা গেল। শোনা গেল অর্জুনের ক্ষীণ প্রতিবাদ। চারপাশের প্রকৃতিতেও যেন নানা অমঙ্গল দেখা যেতে লাগল। দ্রৌপদীর অসম্মান কানে কানে পৌঁছাল রাজ অন্তঃপুরে। গান্ধারী ছিলেন স্পষ্টবাদিনী। নিজের পুত্রের আচরণে যুগপত্ লজ্জিত আর দুঃখিত হলেন তিনি। নির্বাক ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘এ অন্যায়ের অবিলম্বে প্রতিকার করুন আপনি।’ এতক্ষণ ধৃতরাষ্ট্রও ছিলেন নিশ্চুপ দ্রষ্টা। কোনওদিনই বা তিনি নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? অথবা শাসন করতে পারেন ছেলেকে| গান্ধারীর কথায়, সম্বিত্ ফিরল তাঁর। তিরস্কার করলেন ছেলেকে। আর দ্রৌপদীকে মধুরস্বরে বললেন, ‘বলো পাঞ্চালী, তুমি কি চাও? তুমি যা চাও, তাই দেবো আজ তোমায়।’
দ্রৌপদীর আর কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে নিজের পতিদের মুক্তি ছাড়া? তাই চাইলেন তিনি। শুধু তাই চাইলেন। তার চাইতে আর একটিও বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না তাঁর। অর্জুনের প্রতি অসূয়ায়, পাণ্ডবদের প্রতি ক্রোধে আর কতকটা দ্রৌপদীর অপমানসূচক কথায় কর্ণ মন্দ আচরণ করে ফেললেও দ্রৌপদীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা ছিলই। দ্রৌপদীর এমন বর প্রার্থনায় নিজের সে অনুরাগ কর্ণ গোপন করতে পারলেন না। বলে উঠলেন, ‘মানুষের এমন সুন্দরী স্ত্রী এমন দেখেছি বটে, তবে কোনও স্ত্রীর এমন কাজ দেখিনি। আজ সহায়সম্বলহীন পাণ্ডবদের এমন দুর্দিনের সাগরে দ্রৌপদীই যেন শেষ তরী।’ কর্ণের কথা যেন শেল হয়ে বিঁধল পাণ্ডবদের হৃদয়ে। ভীমসেনকে শান্ত করে সকলকে সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কাছে অনুমতি নিয়ে ফিরে চললেন ইন্দ্রপ্রস্থে। সব ফিরে পেলেন তাঁরা। শুধু রয়ে গেল তীব্র ক্ষত।
শুধুই কি তাই? পাশায় জিতে একচ্ছত্র রাজত্বের বিন্দুমাত্র লোভ কি যুধিষ্ঠিরের মনে ছিল না? যদি নাই থাকবে তবে, এতবড় অঘটনের পরেও যুধিষ্ঠির আবার কিভাবে পাশাখেলার ফাঁদে পা দিয়ে ফিরে গেলেন হস্তিনাপুরে? নিয়তিকে কেই বা খণ্ডাতে পারে! ধর্মপুত্রও দমন করতে পারলেন না প্রবৃত্তিকে। বুদ্ধিভ্রষ্টের মত কারো পরামর্শ ছাড়াই অন্ধকার সাগরে ঝাঁপ দিলেন।
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে