রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


বৈশম্পায়নের গল্প বলার আসরে আজ বুঝি সূচ পড়লেও আওয়াজ হবে! স্তব্ধ হয়ে সকলে শুনছেন সেদিনের সেই পাশার আসরের কাহিনী। না চাইতেও কেমন করে ব্যসনের দাস হয়ে যুধিষ্ঠির সব বিকিয়ে দিলেন! পাণ্ডবদের এমন দুর্দশাতেও শকুনির ক্রূর মনে কোনওরকম সমানুভূতির স্পর্শমাত্র বোঝা গেল না। কেন? দুর্যোধন আর তাঁর সঙ্গী দুঃশাসনের তীব্র বিদ্বেষভরা আচরণের না হয় একটা যুক্তি রয়েছে। কিন্তু কর্ণ? শ্রোতাদের সঙ্গে কর্ণের পরিচয় ইতিপূর্বেই হয়েছে। কর্ণও কি তবে কোনও বিষ পুষে রেখেছেন মনে? এ প্রশ্ন আজ শ্রোতাদের মনে মনে।

কর্ণের ইতিহাস তো কম বঞ্চনার নয়। আর অদ্ভুতভাবে যাদেরই এমন বঞ্চনার ইতিহাস তাঁদেরই দেখা যাচ্ছে অন্যায়ের পক্ষে সামিল হতে। ন্যায়ের কোনও পথই তাঁদের পছন্দ নয়। পাহাড়ী শকুনির পাথুরে কঠোর মুখ দেখে আন্দাজ করা কঠিন যে তাঁর মনে কী চলছে। কিন্তু কোনওভাবে কুরুবংশধ্বংস কি তাঁরও কাম্য ছিল না? অমন বিদুষী যে তাঁর বোন তাঁর এমন অন্ধরাজার সঙ্গে বিবাহ আর চিরকালের জন্য অন্ধকারকে বরণ করে নেওয়া, এ কি তিনিও খুব ভালো মনে মেনে নিয়েছিলেন? আর কর্ণ? তাঁকে তো আজন্ম বঞ্চনার শিকার হয়ে চলতে হচ্ছে। ক্ষত্রিয়ের রক্ত তাঁর শরীরে। সে কথা তাঁর আজও অজানা। কিন্তু একথা তো মিথ্যে নয়, যে তিনি অস্ত্রবিদ্যা শিখতে চেয়েছিলেন গুরু দ্রোণের কাছে। দ্রোণ ফিরিয়ে দিলেন, কেবল সুতের ছেলে বলে। কিন্তু তিনি কি আর বোঝেননি যে এটা দ্রোণের অর্জুনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব! অর্জুনের প্রতি, সেই সাথে পাণ্ডবদের প্রতি কবে থেকে ক্রোধ পুষে রেখেছেন তিনি। অবশ্য কৌরবপাণ্ডবদের শস্ত্রবিদ্যাশিক্ষার শেষে শিক্ষাপ্রদর্শনীতে একথা সকলেই জেনে গিয়েছেন যে, অর্জুনের প্রতিস্পর্ধী যোদ্ধা যদি কেউ হতে পারেন, তবে তিনি কর্ণ। একথা দুর্যোধন সেদিনই বুঝেছিলেন বলেই কর্ণের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্ব করেছিলেন, অঙ্গরাজের রাজা করেছিলেন তাঁকে। দুর্যোধনের কাছে এজন্য তিনি চিরকৃতজ্ঞ। তারপর বন্ধু দুর্যোধনের আহ্বানে দ্রুপদরাজার কন্যাকে পাওয়ার আশায় পাঞ্চালরাজ্যেও উপস্থিত হয়েছিলেন। স্বয়ংবরসভার সে আসরে লক্ষ্যবেধের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ধনু অর্জুন ছাড়া একমাত্র কর্ণের পক্ষেই তোলা সম্ভব ছিল। একথা কর্ণ নিজেও জানতেন। কিন্তু সেখানেও অপমানিত হলেন। এবার অপমান করলেন দ্রৌপদী। সুতপুত্রের কণ্ঠে বরমাল্য দেবেন না তিনি। অর্জুনের ওপর ঈর্ষা ছিলই। সেদিন থেকে দ্রৌপদীর অপমানের দাহ জুড়ে গেল তার সঙ্গে।

সেই দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী হলেন। আর সকলের অগোচরে কর্ণের মনে তীব্র বিদ্বেষবিষবৃক্ষ বেড়ে উঠতে লাগল। পাশার সভায় তাই শকুনি দুর্যোধনের সাথে হাত মিলিয়ে অন্যায়ে সামিল হলেন কর্ণ। পাণ্ডবদের অপমানে যোগ দিলেন। বিদুরের ধর্মকথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন। আজ অবশেষে হাতের নাগালে পাওয়া গিয়েছে পাণ্ডবদের এমনকি দ্রৌপদীকেও। এ সুযোগ কি ছাড়া যায়!
দুঃশাসন দ্রৌপদীকে ধাক্কা দিয়ে দাসী সম্বোধন করলে কর্ণ অত্যন্ত আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে হেসে উঠলেন। দ্রৌপদী আবারো জিজ্ঞাসা করলেন, যুধিষ্ঠির কি আদৌ এমন পণ রাখতে পারেন? তিনি কি পণ রাখবার যোগ্য? ভীষ্ম একবারই মাত্র বলে উঠলেন, দ্রৌপদীর এমন প্রশ্নের যথার্থ যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে তিনি নারাজ।

এমন অন্যায়ের মাঝেও ছিল ন্যায়ের স্বর। ক্রমাগত অন্যায় হতে দেখে, দ্রৌপদীর প্রায় অচেতনদশায় করুণ নীরব কান্না দেখে, পাণ্ডবদের দুঃখে ভরা মুখগুলো দেখে স্থির থাকতে পারলেন না বিকর্ণ। বিকর্ণ অষ্টম কৌরব, দুর্যোধনের ভাই। দ্রৌপদীর এমন লাঞ্ছনা, তাও আবার তাঁরই ভাইদের হাতে, তাঁকে বড় বাজল। সটান উঠে দাঁড়িয়ে সভার বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্বোধন করে বললেন, আজ আপনারা দ্রৌপদীর কথার উত্তর দিতে বাধ্য। এমন অন্যায়ে কীভাবে আপনারা বাক্যহারা হয়ে থাকতে পারেন! যে কথা কেউ বলতে পারেননি, সে কথা বিকর্ণের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, ‘এই অন্যায় পাশাখেলার সভায় আমিও উপস্থিত। সুতরাং সকলের সঙ্গে আমিও প্রত্যক্ষ করেছি যে যুধিষ্ঠির একে একে সব হারিয়ে, সকল ভাইকে এবং সবশেষে নিজেকে পণ রেখে পরাস্ত হয়ে তবে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন। নিজেকে যিনি হারিয়েছেন, তিনি কীভাবে স্ত্রীকে পণ রাখতে পারেন? এতো স্পষ্টতঃই শকুনির চাল যার প্রভাবে যুধিষ্ঠির এমন পণ রেখেছেন’। প্রবল অন্যায়কারীদের এই সভায় বিকর্ণের প্রতিবাদ স্পর্শ করে গেল উপস্থিত রাজন্যবর্গকে। যে কথা তাঁরা বলতে পারেননি, যে অন্যায় দেখেও প্রবলের ভয়ে মুখ বুঁজে থাকতে হয়েছে, এ স্পষ্টভাষী বালক গর্জে উঠেছে সে কথা বলে। বিকর্ণের প্রশংসা করলেন তাঁরা অনেকে। কিন্তু বিকর্ণের প্রতিবাদী স্বর চাপা পড়ে গেল কর্ণের তীব্র তিরস্কারে। সে তিরস্কারে হিংসা, বিদ্বেষের সুর মিলেমিশে একাকার। সে তিরস্কারের একটাই লক্ষ্য, যেভাবেই হোক না কেন প্রতিবাদীর কণ্ঠরোধ করতে হবে। বিকর্ণকে ‘বিকারগ্রস্ত’, ‘নির্বোধ’, ‘স্ববিরভাষী’, ‘প্রাজ্ঞবাদিক বালক’ এমন নানা বিশেষণে বিদ্ধ করলেন কর্ণ। প্রতিবাদের স্বর রুখে দেওয়ার জন্য আপাতত এই শব্দগুলোই যথেষ্ট ছিল। এককালে দ্রৌপদীকে না পাওয়ার ক্রোধ, স্বয়ংবরসভায় অপমানিত হওয়ার জ্বালায় বলে উঠলেন তিনি, ‘পাঁচ জন স্বামী যার সে তো বেশ্যা বৈ আর কিছু নয়। তাই বেশ্যার এমন ব্যবহারই প্রাপ্য। এতে আর আশ্চর্যের কী আছে’! আদেশ করলেন দুঃশাসনকে, ‘দুঃশাসন, তুমি এই বালক বিকর্ণের কথায় কান না দিয়ে পাণ্ডবদের আর দ্রৌপদীর বস্ত্রগুলি হরণ কর।’

বিকর্ণের প্রতিবাদী স্পষ্টভাষণে দুর্জনেরা স্তব্ধ হয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। কর্ণের ইন্ধনে ভরা আদেশ শোনামাত্রই দুঃশাসন সভাস্থ সকলকে অগ্রাহ্য করে, নারীর মান রক্ষার দায় ভুলে, দ্রৌপদীর পরনের কাপড় ধরে টান দিল।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

Skip to content