শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

হস্তিনাপুরের পাশাখেলার আসর যেন পরীক্ষাক্ষেত্র ছিল। এতকাল নিজেদের স্বভাবের গলদটুকু তবুও বা রেখে ঢেকে চলছিলেন সকলে। মনে বিষ থাকলেও মুখে মধুর প্রলেপটা ছিল। সেটুকুও ঘুচে গেল। শকুনির প্ররোচনায় একে একে সব হারিয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য যুধিষ্ঠির নিজেকেই পণ রেখে বসলেন। সেই পণও হারলেন। আর তারপরই ঘটল মহান অনর্থ। শকুনি উস্কে দিলেন, ‘রাজা, তোমার কাছে আর তো কিছু নেই যা দিয়ে তুমি খেলতে পারো। তুমি বরং দ্রৌপদীকে পণ রাখো।’ যুধিষ্ঠির তখন পাশার বশে। বিচারবোধটুকুও লোপ পেয়েছে। দ্রৌপদীকেই পণ রাখলেন তিনি। সামনে দর্শকাসনে বসে থাকা কুরুবৃদ্ধদের দেহ ঘর্মাক্ত, মুখে কষ্টের ছায়া। কিন্তু কেউ টুঁ শব্দটি করলেন না। খেলা হল। শকুনির কপটচালে যুধিষ্ঠির যথারীতি আবার হারলেন।

ঠিক এই সময়ে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের লোভী হিংসুটে মনের পরিচয় নগ্নভাবে সামনে চলে এল। আপাতভাবে যে মনে হয়েছিল, ধৃতরাষ্ট্র অনিচ্ছাসত্ত্বেও পাশাখেলায় সম্মতি দিয়েছেন, সে মিথ্যে ঢেকে দিল, যুধিষ্ঠিরের পণ হারার পর আনন্দে বলে ওঠা শব্দগুচ্ছ, ‘কি জয় করলে? কি জয় করলে?’ মনে হল যেন, এতে তাঁর পুরোপুরি সায় ছিল।

বৈশম্পায়নের মুখে এযাবৎ সবটুকু শুনে জনমেজয়সহ উপস্থিত সকলের মনে এ প্রশ্ন দোলা দিয়ে গেল, তবে ধৃতরাষ্ট্র এতকাল অন্তরে ঈর্ষা লালন করছিলেন? তবে কি তাঁর অন্ধত্বের জন্য, নিজের ভাগ্যের পাণ্ডুর সিংহাসনে বসা, আর তারপর রাজা হওয়ার পরেও পাণ্ডুর ছেলেদের প্রতি সকলের ভালোবাসা তিনি মেনে নিতে পারেননি? যা এতদিন অবচেতনে লালন করছিলেন, আজ তা পাশার সভায় প্রকাশ পেয়ে গেল? আর কুরুবৃদ্ধেরা? এক বিদুর ছাড়া তো কেউই কিছু বললেন না? কেন? পাণ্ডবদের প্রতি মনে মনে সকলের সমর্থন ছিল, একথা সকলে বুঝতে পারছিলেন বিলক্ষণ। কিন্তু স্নেহ, আত্মীয়তা একজায়গায়, আর রাজনীতির স্থান সম্পূর্ণ অন্যত্র। যুদ্ধ যে হবে এমন আশংকা সকলেই করেছিলেন। হস্তিনাপুরের কৌরবদের পক্ষেই থাকবেন, ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতির এই মনের বাসনা যেন স্পষ্ট হয়ে গেল পাশার সভায়। তাই বিদুর ছাড়া কেউই কোনও প্রতিবাদ করলেন না।অর্থাৎ প্রবলের পক্ষ নিলেন তাঁরা, নিলেন কৌরবদের পক্ষ। তাঁদের সমবেত নীরবতা যেন এ কথা স্পষ্ট বলে দিল।

একমাত্র বিদুর সর্বনাশের আশংকা করে বারংবার সাবধান করতে লাগলেন দুর্যোধনকে। দুর্যোধনের বুদ্ধিনাশ হতে পারে। সে এই পাশার সভায় উপস্থিত রাজন্যবর্গের সামনে দ্রৌপদীকে ডেকে এনে তাঁকে দাসীবৃত্তি করানোর কথা ভাবতে পারে, কিন্তু তা বলে তাঁর তো আর বুদ্ধিভ্রংশ হয়নি, যে এমন ঘটনা দেখেশুনেও না দেখাশোনার ভান করবেন? কিন্তু সে কথা দুর্যোধন শুনলে তো? উল্টে তিনি অপমানিত করলেন বিদুরকে। বিদুরকে অগ্রাহ্য করে ডাকলেন সুতপুত্র প্রাতিকামীকে। আদেশ করলেন দ্রৌপদীকে সভামধ্যে নিয়ে আসবার জন্য।

যজ্ঞের আগুন থেকে জন্ম দ্রৌপদীর। আর দ্রুপদের সন্তানকামনাই তো ছিল সব ছারখার করে দেবার মানসে। সেই দ্রৌপদী যে মনে আগুন লালন করবেন এ আর নতুন কি! যুধিষ্ঠির পণে দ্রৌপদীকে হারার পর যখন দুর্যোধন সভার মধ্যে ডেকে পাঠালেন দ্রৌপদীকে, দূত প্রাতিকামীকে দ্রৌপদী আকুল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন বারংবার, সত্য ঘটনা কি? সত্যিই কি যুধিষ্ঠির তাঁকে পণে হেরেছেন? যুধিষ্ঠির কি আগে নিজেকে হেরেছেন? যদি নিজেই হেরে থাকেন, তবে তাঁর কি আর পণ দিয়ে পাশাখেলার অবকাশ থাকে? কে দেবে এসমস্ত প্রশ্নের উত্তর? দুর্যোধনের পাঠানো দূত প্রাতিকামীও দ্রৌপদীর উদ্বেগ, দুঃখকে অনুভব করতে পারল। কিন্তু সে তো সামান্য দূত মাত্র। খবর পৌঁছে দেওয়া ছাড়া তার আর কিই বা কাজ? সে আবার ফিরে গেল সভায়। যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো দ্রৌপদীর বলা কথাগুলো। যুধিষ্ঠির তখন কি কথা বলবার মতো দশায় রয়েছেন? উত্তর দিলেন দুর্যোধন। কাল তাঁকে গ্রাস করেছিল। তিনি আবার আদেশ দিলেন, শীঘ্র এই সভায় নিয়ে আসা হোক দ্রৌপদীকে। এখানেই সে সবার সামনে যাবতীয় প্রশ্ন করুক। সামান্য সুতপুত্র দূত যে কথা বুঝতে পেরেছিল, তা দুর্যোধন প্রভৃতিরা, অন্যান্য কুরুবৃদ্ধেরা কেউই কি বোঝেননি, যে সর্বনাশ আসন্নপ্রায়! দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন কীভাবে তাঁকে চুল ধরে টেনে আনতে পারল? রজস্বলা তিনি, একবস্ত্রপরিহিতা। সেকথা জানা সত্ত্বেও কীভাবে দাসী বলে অপমান করতে পারল।

মৃদু, পরিশীলিত অথচ স্পষ্ট স্বরে গর্জে উঠলেন দ্রৌপদী। দ্রৌপদীর ধিক্কার যেন অভিশপ্ত পাশার সভায় উপস্থিত সকলের মর্মে বিঁধল। বলে উঠলেন তিনি, ‘ভরতবংশের ধর্ম লোপ পেয়েছে, এমনকী ক্ষত্রিয়দেরও চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে’। এমন ভয়ানক অধর্ম যে দেখেও সকলে এমন নিশ্চেষ্ট কীভাবে হতে পারেন? ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, রাজা ধৃতরাষ্ট্র সকলে কি প্রাণহীন হয়ে পড়েছেন? কেন এমন অধর্মের কেউ কোনো প্রতিবাদ করছেন না?

কেন? কেন? কেন? দ্রৌপদীর প্রশ্নগুলো যেন সভার দেওয়ালগুলিতে অনুরণিত হয়ে ফিরতে লাগল। আর সেই প্রায় প্রাণহীন সভায় মূর্তিমতী সর্বনাশ দুর্যোধন, শকুনি আর দুঃশাসনের উল্লাস আর কর্ণের অট্টহাসির শব্দের রূপ ধরে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। ক্রোধে ক্ষোভে লজ্জায় আরক্ত দ্রৌপদীর দিকে আর তাকাতে না পেরে পাণ্ডবেরা আরও অধোবদন হলেন।

দুঃশাসনের আকর্ষণে দ্রৌপদীর খোঁপার সাজ খুলে গেল, এলিয়ে পড়ল চুল, পরনের কাপড় আলুথালু হল। দ্রৌপদীর চোখে জল, আগুনপারা মুখখানা। তীক্ষ্ণ স্বরে দুঃশাসনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ওরে নৃশংস! যে সভায় এমন গুরুজনেরা রয়েছেন, সে সভায় তুই এমনভাবে অপমান করিস না! শয়তানের প্রতিমূর্তি দুঃশাসন অচেতনপ্রায় দ্রৌপদীকে ধাক্কা দিয়ে দাসী বলে ডেকে উঠে অট্টহাস্য করে উঠল।
এমন যার তেজ, এমন যার রূপ তাকে পাওয়ার আশাতে দ্রুপদরাজার আয়োজিত স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন দুর্যোধন, কর্ণ। তাঁকে না পাওয়ার জ্বালাটা আজও ক্ষত হয়ে রয়ে গিয়েছে হৃদয়ে। কথায় বলে, জোর যার মুলুক তার। আজ গোটা হস্তিনাপুর নীরব দর্শক। এক পাশাখেলায় পাণ্ডবদের হাতের মুঠোয় এনে ফেলা গিয়েছে। আজ দ্রৌপদীকে কে রক্ষা করবে? কেই বা তার পাশে দাঁড়াবে। কেই বা তাঁর সম্মান রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। সুতরাং পাশাখেলার রণভূমে বিজয়ের উল্লাস করে চলল পিশাচবুদ্ধি।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

Skip to content