ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
জরাসন্ধের নাম এ পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়া বড় সহজ নয়, একথা কৃষ্ণ জানতেন৷ কিন্তু এদিকে তাঁর প্রতিপত্তিও ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছিল৷ তাই পাণ্ডবদের উত্সাহিত করেছিলেন৷ আর এদিকে পাণ্ডবেরা জরাসন্ধের পরাক্রম সম্বন্ধে কতটুকুই-বা ওয়াকিবহাল ছিলেন! তাই হয়তো কৃষ্ণের উত্সাহেই তাঁরা উত্সাহিত হওয়ার চেষ্টা করেন৷ দুর্যোধন প্রভৃতির ষড়যন্ত্রে পাণ্ডবেরা ক্রমশ শ্রীহীন হয়ে পড়েছিলেন৷ অথচ ক্ষত্রিয়ের এমন নিভৃতযাপনের চেয়ে সম্মুখযুদ্ধে মৃত্যু বরং ভালো৷ জরাসন্ধ অসামান্য বীর৷ আর সেই তুলনায় পাণ্ডবেরা ছিলেন নিতান্ত নাবালক৷ তবে কৃষ্ণ এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে পাণ্ডবভাইয়েরা আসলে ছাইচাপা আগুন৷ তেমন ইন্ধন পেলে অসাধ্যসাধন করতে পারেন তাঁরা৷
নানান ভাগ্যবিপর্যয়েই হয়তো বা জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের তেমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা চোখে পড়ে না৷ হয়তো কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন৷ যেভাবে একের পর এক ভাগ্যবিপর্যয় চলছে! আগামীতেও কী অপেক্ষা করছে কে জানে! যুধিষ্ঠির নিজে থেকে ঠিক সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেন না৷ দেবর্ষি নারদের কথা মনে পড়ে৷ তিনিও পাণ্ডবদের যোগ্য মনে করেছিলেন নিশ্চয়ই নতুবা রাজসূয়যজ্ঞের পরামর্শ দেবেনই বা কেন? সাতপাঁচ ভাবেন যুধিষ্ঠির৷ কৃষ্ণের উৎসাব্যঞ্জক কথাগুলো মনে ঝড় তুলে যায়৷ এমন অবস্থায় কূটকৌশলী বুদ্ধিমান কৃষ্ণের ওপর ধীরে ধীরে অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েন৷ কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে মানসিক দৃঢ়তার পাঠ দেন৷ রাজসূয়যজ্ঞ করে সম্রাট হবার অভিলাষী যিনি তাঁর যুদ্ধে পিছপা হলে চলবে কেন? যুদ্ধই যে ক্ষত্রিয়ের আসল যজ্ঞ৷ যে যজ্ঞে কাঙ্ক্ষিত স্বর্গলাভ হয়৷ কৃষ্ণের কথায় যেন মনে মনে একটু করে সাহস সঞ্চয় করতে থাকেন৷ আর এদিকে তীক্ষ্ণবুদ্ধি কৃষ্ণও তাঁর নিজের উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথে আরও একধাপ এগিয়ে যান৷
বহুরাজা যাঁর অধীন, বহুরাজাকে যিনি বশে রেখেছেন তাঁকে সম্মুখসমরে পরাস্ত করা বড় সহজ কাজ নয়৷ যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে ভীম আর অর্জুনকে চেয়ে নিলেন কৃষ্ণ৷ বল আর কৌশল দুই-ই রইল সঙ্গে৷ জরাসন্ধের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের পর ঘটনার মোড় কোনদিকে ঘুরবে, তা কেই-বা বলতে পারে৷ তারপর এক নতুন দিনে ভীম অর্জুন রওনা দিলেন মগধের পথে, হৃতভাগ্যকে জয় করবার প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার মানসে৷ সঙ্গে চললেন কৃষ্ণ, পথ দেখিয়ে৷
প্রবল প্রতাপশালী রাজা জরাসন্ধ সেই সময় কোনও এক যজ্ঞে দীক্ষিত ছিলেন৷ ফলত তিনি ব্রহ্মচারী এবং উপবাসক্লিষ্ট ছিলেন৷ কৌশলী কৃষ্ণ মনে করলেন, এই হল উপযুক্ত সময়৷ শস্ত্রযুদ্ধের জরাসন্ধকে বধ করা দেবতা অথবা অসুরের পক্ষেও সম্ভব নয়৷ একমাত্র মল্লযুদ্ধে যদি তাঁকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়!
জরাসন্ধরাজা এক আশ্চর্য নীতি মেনে চলতেন৷ কোনও স্নাতক ব্রাহ্মণ তাঁর দর্শনার্থী হয়ে উপস্থিত হয়েছেন জানতে পারলে মাঝরাত্রেও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন৷ কৃষ্ণ সেকথা জানতেন৷ তাই অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে, ক্ষত্রিয়োচিত বেশবর্জন করে স্নাতক ব্রাহ্মণের বেশে উপস্থিত হলেন জরাসন্ধের যজ্ঞশালায়৷ কিন্তু তাতেও কি জরাসন্ধের তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টিকে এড়াতে পারলেন? কৃষ্ণের কথায় কপটবেশে এসেছেন ভীমার্জুনও৷ সেজেছেন ব্রাহ্মণের সাজে৷ কিন্তু ক্ষত্রিয়ের কাঠিন্যকে কি ঢাকতে পেরেছেন? ধরা পড়ে গেলেন জরাসন্ধের কাছে৷ কৃষ্ণকে জরাসন্ধ নামেমাত্র চিনতেন৷ আর পাণ্ডবেরা তাঁর অপরিচিত৷ তাঁর যেসমস্ত শত্রু আজও তাঁর বশে আসেনি, তাদের সকলের কথাই জরাসন্ধের নখদর্পণে৷ তবে সামনে এঁরা কারা? কেনই তাঁর আপ্যায়ন গ্রহণ না করলেন? কী চান? কেনই তাঁর ধর্মে ব্যাঘাত ঘটাতে উদ্যত হয়েছেন? জরাসন্ধ ভেবে কুলকিনারা করতে পারেন না৷
জরাসন্ধের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কৃষ্ণ দেন ধীরে ধীরে৷ তিনি তৈরি হয়েই এসেছিলেন৷ দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষোভ অথচ ক্ষোভের কোনও প্রতিকার করতে না পারার জ্বালা ঝরে পড়তে থাকে তাঁর কণ্ঠ থেকে৷ কৃষ্ণ জানান, জরাসন্ধ ক্ষত্রিয়সমাজকে রক্ষার কর্তব্য নিজে হাতে তুলে নিয়েছেন এক ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ৷ আজ তিনি সেই ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছেন৷ স্পষ্ট সুরে কৃষ্ণ নিজের অভিলাষ জানান, জরাসন্ধকে বধ করে রাজাদের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেওয়াই তাঁদের উদ্দেশ্য৷ নিজেদের পরিচয় দিয়ে জরাসন্ধকে উদ্দেশ করে বলে ওঠেন, আজ জরাসন্ধের কাছে দুটো পথ খোলা, হয় বিনা প্রতিবাদে বন্দি রাজাদের মুক্ত করা অথবা যুদ্ধ৷ জরাসন্ধ ক্ষত্রিয়সত্তা এসময় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে৷ এতক্ষণ ব্রাহ্মণজ্ঞানে তিনি যাঁদের সঙ্গে নরম সুরে কথা বলে এসেছেন, আজ যখন বোঝেন, তাঁরা তাঁর শত্রু, ক্ষণিকের মধ্যে নিজের মন তৈরি করে বলে ওঠেন তিনি প্রস্তুত৷ না, নিজের কৃতকার্যের জন্য কোনও অনুতাপ নেই তাঁর৷ যেসমস্ত রাজাদের যুদ্ধে তিনি জয় করেছেন, বন্দি করে রেখেছেন নিজের কাছে, তাঁদের ছেড়ে দিলে যে জরাসন্ধের ভীরুতা প্রতিষ্ঠিত হবে ! তাই এমন কাজ তিনি কখনও করবেন না৷ বরং তিনি যুদ্ধ করতে রাজি৷
জরাসন্ধের পৌরুষের অহংকারই যে তাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারে, একথা কৃষ্ণ আগে থেকেই বুঝেছিলেন৷ তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন, জরাসন্ধের সঙ্গে ভীমের মল্লযুদ্ধ হোক৷ ভীমের বলবত্তা সম্পর্কে জরাসন্ধ অজ্ঞ৷ তাই হয়তো বা যুদ্ধকালে তিনি মনে মনে ভীমকে যদি তাচ্ছিল্য করেন, সে সুযোগ ভীমসেন যেন হাতছাড়া না করেন, একথা ভীমসেনকে পইপই করে শিখিয়ে এসেছিলেন কৃষ্ণ৷
কৃষ্ণের অনুমানকে সত্যি করে জরাসন্ধ ভীমের সঙ্গে যুদ্ধের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন৷ যজ্ঞক্ষেত্র থেকে রণযজ্ঞের জন্য নিমেষে তৈরি করলেন মনকে৷ যুদ্ধের সাজে সেজে দুই বীর মুখোমুখি হলেন পরস্পরের৷ দুজনেই প্রবল বলশালী, দুজনেই জয়ের অভিলাষী৷ সে দেখবার মতো একটা যুদ্ধ হল বটে! মল্লবিদ্যায় নিপুণ দুই যোদ্ধার এমন আশ্চর্য যুদ্ধ দেখতে পুরবাসীরা উপস্থিত হল৷ ধীরে ধীরে সে খবর ছড়িয়ে গেল দিগ্বিদিকে৷ একসময় বহু জনসমাগমে তিলধারণের জায়গা থাকল না৷ আর এদিকে দুই যোদ্ধাও একে অপরকে পরাস্ত করবার ইচ্ছায় অপরের ছিদ্র খুঁজতে লাগলেন৷ যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে জরাসন্ধ সামান্য ক্লান্ত হলেন৷ ভীম এ সুযোগ ছেড়ে দিলেন না৷ প্রবল পরাক্রমে জরাসন্ধকে কাঁধে তুলে বহুবার ঘুরিয়ে তাঁর পিঠ ভেঙে ফেললেন৷ জরাসন্ধের বধের সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা যুগের অবসান হল৷ বন্দি রাজারা মুক্ত হলেন৷ চারদিকে খুশির আমেজ ছড়িয়ে গেল৷ আর এদিকে পাণ্ডবেরা জয়যাত্রাপথে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলেন৷ অলক্ষ্যে কৃষ্ণ কি মুচকি হাসলেন? যেমনটা তিনি ভেবেছিলেন, সেই পথেই যে এগোচ্ছে সব!
নানান ভাগ্যবিপর্যয়েই হয়তো বা জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের তেমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা চোখে পড়ে না৷ হয়তো কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন৷ যেভাবে একের পর এক ভাগ্যবিপর্যয় চলছে! আগামীতেও কী অপেক্ষা করছে কে জানে! যুধিষ্ঠির নিজে থেকে ঠিক সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেন না৷ দেবর্ষি নারদের কথা মনে পড়ে৷ তিনিও পাণ্ডবদের যোগ্য মনে করেছিলেন নিশ্চয়ই নতুবা রাজসূয়যজ্ঞের পরামর্শ দেবেনই বা কেন? সাতপাঁচ ভাবেন যুধিষ্ঠির৷ কৃষ্ণের উৎসাব্যঞ্জক কথাগুলো মনে ঝড় তুলে যায়৷ এমন অবস্থায় কূটকৌশলী বুদ্ধিমান কৃষ্ণের ওপর ধীরে ধীরে অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েন৷ কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে মানসিক দৃঢ়তার পাঠ দেন৷ রাজসূয়যজ্ঞ করে সম্রাট হবার অভিলাষী যিনি তাঁর যুদ্ধে পিছপা হলে চলবে কেন? যুদ্ধই যে ক্ষত্রিয়ের আসল যজ্ঞ৷ যে যজ্ঞে কাঙ্ক্ষিত স্বর্গলাভ হয়৷ কৃষ্ণের কথায় যেন মনে মনে একটু করে সাহস সঞ্চয় করতে থাকেন৷ আর এদিকে তীক্ষ্ণবুদ্ধি কৃষ্ণও তাঁর নিজের উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথে আরও একধাপ এগিয়ে যান৷
বহুরাজা যাঁর অধীন, বহুরাজাকে যিনি বশে রেখেছেন তাঁকে সম্মুখসমরে পরাস্ত করা বড় সহজ কাজ নয়৷ যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে ভীম আর অর্জুনকে চেয়ে নিলেন কৃষ্ণ৷ বল আর কৌশল দুই-ই রইল সঙ্গে৷ জরাসন্ধের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের পর ঘটনার মোড় কোনদিকে ঘুরবে, তা কেই-বা বলতে পারে৷ তারপর এক নতুন দিনে ভীম অর্জুন রওনা দিলেন মগধের পথে, হৃতভাগ্যকে জয় করবার প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার মানসে৷ সঙ্গে চললেন কৃষ্ণ, পথ দেখিয়ে৷
প্রবল প্রতাপশালী রাজা জরাসন্ধ সেই সময় কোনও এক যজ্ঞে দীক্ষিত ছিলেন৷ ফলত তিনি ব্রহ্মচারী এবং উপবাসক্লিষ্ট ছিলেন৷ কৌশলী কৃষ্ণ মনে করলেন, এই হল উপযুক্ত সময়৷ শস্ত্রযুদ্ধের জরাসন্ধকে বধ করা দেবতা অথবা অসুরের পক্ষেও সম্ভব নয়৷ একমাত্র মল্লযুদ্ধে যদি তাঁকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়!
জরাসন্ধরাজা এক আশ্চর্য নীতি মেনে চলতেন৷ কোনও স্নাতক ব্রাহ্মণ তাঁর দর্শনার্থী হয়ে উপস্থিত হয়েছেন জানতে পারলে মাঝরাত্রেও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন৷ কৃষ্ণ সেকথা জানতেন৷ তাই অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে, ক্ষত্রিয়োচিত বেশবর্জন করে স্নাতক ব্রাহ্মণের বেশে উপস্থিত হলেন জরাসন্ধের যজ্ঞশালায়৷ কিন্তু তাতেও কি জরাসন্ধের তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টিকে এড়াতে পারলেন? কৃষ্ণের কথায় কপটবেশে এসেছেন ভীমার্জুনও৷ সেজেছেন ব্রাহ্মণের সাজে৷ কিন্তু ক্ষত্রিয়ের কাঠিন্যকে কি ঢাকতে পেরেছেন? ধরা পড়ে গেলেন জরাসন্ধের কাছে৷ কৃষ্ণকে জরাসন্ধ নামেমাত্র চিনতেন৷ আর পাণ্ডবেরা তাঁর অপরিচিত৷ তাঁর যেসমস্ত শত্রু আজও তাঁর বশে আসেনি, তাদের সকলের কথাই জরাসন্ধের নখদর্পণে৷ তবে সামনে এঁরা কারা? কেনই তাঁর আপ্যায়ন গ্রহণ না করলেন? কী চান? কেনই তাঁর ধর্মে ব্যাঘাত ঘটাতে উদ্যত হয়েছেন? জরাসন্ধ ভেবে কুলকিনারা করতে পারেন না৷
জরাসন্ধের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কৃষ্ণ দেন ধীরে ধীরে৷ তিনি তৈরি হয়েই এসেছিলেন৷ দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষোভ অথচ ক্ষোভের কোনও প্রতিকার করতে না পারার জ্বালা ঝরে পড়তে থাকে তাঁর কণ্ঠ থেকে৷ কৃষ্ণ জানান, জরাসন্ধ ক্ষত্রিয়সমাজকে রক্ষার কর্তব্য নিজে হাতে তুলে নিয়েছেন এক ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ৷ আজ তিনি সেই ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছেন৷ স্পষ্ট সুরে কৃষ্ণ নিজের অভিলাষ জানান, জরাসন্ধকে বধ করে রাজাদের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেওয়াই তাঁদের উদ্দেশ্য৷ নিজেদের পরিচয় দিয়ে জরাসন্ধকে উদ্দেশ করে বলে ওঠেন, আজ জরাসন্ধের কাছে দুটো পথ খোলা, হয় বিনা প্রতিবাদে বন্দি রাজাদের মুক্ত করা অথবা যুদ্ধ৷ জরাসন্ধ ক্ষত্রিয়সত্তা এসময় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে৷ এতক্ষণ ব্রাহ্মণজ্ঞানে তিনি যাঁদের সঙ্গে নরম সুরে কথা বলে এসেছেন, আজ যখন বোঝেন, তাঁরা তাঁর শত্রু, ক্ষণিকের মধ্যে নিজের মন তৈরি করে বলে ওঠেন তিনি প্রস্তুত৷ না, নিজের কৃতকার্যের জন্য কোনও অনুতাপ নেই তাঁর৷ যেসমস্ত রাজাদের যুদ্ধে তিনি জয় করেছেন, বন্দি করে রেখেছেন নিজের কাছে, তাঁদের ছেড়ে দিলে যে জরাসন্ধের ভীরুতা প্রতিষ্ঠিত হবে ! তাই এমন কাজ তিনি কখনও করবেন না৷ বরং তিনি যুদ্ধ করতে রাজি৷
জরাসন্ধের পৌরুষের অহংকারই যে তাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারে, একথা কৃষ্ণ আগে থেকেই বুঝেছিলেন৷ তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন, জরাসন্ধের সঙ্গে ভীমের মল্লযুদ্ধ হোক৷ ভীমের বলবত্তা সম্পর্কে জরাসন্ধ অজ্ঞ৷ তাই হয়তো বা যুদ্ধকালে তিনি মনে মনে ভীমকে যদি তাচ্ছিল্য করেন, সে সুযোগ ভীমসেন যেন হাতছাড়া না করেন, একথা ভীমসেনকে পইপই করে শিখিয়ে এসেছিলেন কৃষ্ণ৷
কৃষ্ণের অনুমানকে সত্যি করে জরাসন্ধ ভীমের সঙ্গে যুদ্ধের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন৷ যজ্ঞক্ষেত্র থেকে রণযজ্ঞের জন্য নিমেষে তৈরি করলেন মনকে৷ যুদ্ধের সাজে সেজে দুই বীর মুখোমুখি হলেন পরস্পরের৷ দুজনেই প্রবল বলশালী, দুজনেই জয়ের অভিলাষী৷ সে দেখবার মতো একটা যুদ্ধ হল বটে! মল্লবিদ্যায় নিপুণ দুই যোদ্ধার এমন আশ্চর্য যুদ্ধ দেখতে পুরবাসীরা উপস্থিত হল৷ ধীরে ধীরে সে খবর ছড়িয়ে গেল দিগ্বিদিকে৷ একসময় বহু জনসমাগমে তিলধারণের জায়গা থাকল না৷ আর এদিকে দুই যোদ্ধাও একে অপরকে পরাস্ত করবার ইচ্ছায় অপরের ছিদ্র খুঁজতে লাগলেন৷ যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে জরাসন্ধ সামান্য ক্লান্ত হলেন৷ ভীম এ সুযোগ ছেড়ে দিলেন না৷ প্রবল পরাক্রমে জরাসন্ধকে কাঁধে তুলে বহুবার ঘুরিয়ে তাঁর পিঠ ভেঙে ফেললেন৷ জরাসন্ধের বধের সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা যুগের অবসান হল৷ বন্দি রাজারা মুক্ত হলেন৷ চারদিকে খুশির আমেজ ছড়িয়ে গেল৷ আর এদিকে পাণ্ডবেরা জয়যাত্রাপথে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলেন৷ অলক্ষ্যে কৃষ্ণ কি মুচকি হাসলেন? যেমনটা তিনি ভেবেছিলেন, সেই পথেই যে এগোচ্ছে সব!