খাণ্ডববন পুড়ে খাক হলেও দগ্ধ হয়নি চারটি খঞ্জনপাখি৷ খঞ্জনপাখিগুলি মন্দপালমুনির সন্তান ছিল৷ জরিতানামের খঞ্জিনীর সঙ্গে খঞ্জনের রূপে মিলিত হয়েছিলেন মুনি৷ ভোগী মুনি একসময় মা সন্তানদের ত্যাগ করেই অপর খঞ্জিনীর কাছে চলে যান৷ এইসময় খাণ্ডববনদহনের মতো ভয়ংকর কাণ্ড ঘটছিল৷ মুনি আর তাঁর বর্তমান সঙ্গিনী সুরক্ষিত স্থানে থাকলেও সন্তানদের জন্য তাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠে৷ অগ্নিদাহের ভয়াবহতা কল্পনা করে তিনি করজোড়ে অগ্নিদেবের স্তুতি করে সন্তানদের প্রাণভিক্ষা করেন৷ অগ্নিকৃপায় বেঁচে যায় খঞ্জনশিশুক’টি৷ ময়দানবও রেহাই পেল৷ কৃতজ্ঞ দানব যুধিষ্ঠিরের জন্য একটি সাততলা অপূর্ব সভা তৈরি করে দিল৷ এমন সভা যে দেবতা দানবেরাও দেখে চমকে উঠতে পারেন! এমন সভা দেখে মুগ্ধ হলেন দেবর্ষি নারদও৷ যাবার আগে বলে গেলেন, মর্তলোকের এই সভা দেবরাজ ইন্দ্রের সভা, যমরাজের সভা কুবেরের সভা এমনকী স্বয়ং ব্রহ্মার সভাকেও টেক্কা দিতে পারে৷ তাই এমন সভা যাঁর রয়েছে, তিনি শ্রেষ্ঠ রাজা হবার যোগ্যতা রাখেন৷ আর একমাত্র রাজসূয় যাগ করলেই সে যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে৷ আর তাছাড়া যুধিষ্ঠিরের স্বর্গগত পিতা পাণ্ডুও চাইতেন, ছেলে রাজসূয়যজ্ঞ করুক৷ এতে প্রজারা আর অন্যান্য প্রতিবেশী রাজারাও মান্যিগণ্যি করবে৷ শুধু তাই নয়, বংশের আর পিতৃপুরুষের নামও উজ্জ্বল হবে এতে৷ সভাসদ আর আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে যুধিষ্ঠির অবশেষে রাজসূয়নামের এই সর্বজিৎ যজ্ঞ করবার জন্য মনস্থির করলেন৷ এদিকে অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রার বিবাহের পর কৃষ্ণার্জুনের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়েছিল৷ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁকে জানানোটাও কর্তব্য বিবেচনা করে দ্বারকায় কৃষ্ণের কাছে দূত পাঠালেন যুধিষ্ঠির৷ খবর পেয়ে কৃষ্ণ স্বয়ং এসে উপস্থিত হলেন পাণ্ডবদের কাছে, ইন্দ্রপ্রস্থে৷ তিনি এসে বললেন, রাজসূয়যজ্ঞ করবার আগে প্রতিবেশী রাজাদের অবস্থান জেনে নেওয়া জরুরি৷ এ তো আর যে সে যজ্ঞ নয়! এ যাগ যে করবে সে সম্রাট হবে৷ তাই প্রতিবেশী রাজাদের ক্ষমতা, কার্যকলাপ ইত্যাদি বিষয়ে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে ওয়াকিবহাল করলেন৷ বুদ্ধিমান কৃষ্ণের নখদর্পণে ছিল এই সমস্ত রাজাদের সাম্প্রতিক অবস্থান৷ পাণ্ডবদের শুভানুধ্যায়ী তিনি৷ তাই চাইতেন, যেহেতু জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির কুরুবংশের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সম্রাট হবার যোগ্যতা রাখেন, তাঁকে সহায়তা করা তাঁর কর্তব্য৷ যুধিষ্ঠিরকে কৃষ্ণ জানালেন, এই মুহূর্তে একমাত্র প্রবল পরাক্রমী রাজা জরাসন্ধই যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের প্রস্তুতিতে বাধা হতে পারেন৷ বহু বাধাবিপত্তির পর সদ্য ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরেছেন যুধিষ্ঠির৷ মা, চারভাই আর দ্রৌপদীকে নিয়ে তাঁর আপাতসুখের সংসার শুরু হয়েছে সদ্য৷ আপাতসুখই মনে করেন তিনি, কারণ নিকটআত্মীয় কৌরবেরাও আদতে শত্রুই৷ আড়ালে কীভাবে সর্বনাশসাধনের চেষ্টা করছে তারা, তাও জানেন না৷ এমতাবস্থায়, একমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তৃত হলেই আরও বন্ধু রাজাদের পাশে পাবেন৷ পরাক্রমী বিরোধী রাজাদের জয় করতে পারলে নিজেদের শক্তিপরীক্ষার সে পথ আরও সুগম হবে৷ কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে দেবর্ষি নারদের সাবধানবাণী, ‘বড় রক্তক্ষয়ের পথ এই রাজসূয়ের যজ্ঞের পথ, সাম্রাজ্যলাভের পথ৷’
কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেন যুধিষ্ঠির, কে এই জরাসন্ধ? জরাসন্ধের পরাক্রমের কথা বিশদে জানতে চান তিনি৷ কৃষ্ণ বলে চলেন সে কথা৷ মগধদেশে বৃহদ্রথ নামে এক বিক্রমশালী রাজা ছিলেন৷ তাঁর যেমন ছিল সৈন্যবল তেমনই সম্পদশালী ছিলেন তিনি৷ যুদ্ধে তিনি অপরাজেয় ছিলেন৷ অত্যন্ত ধার্মিক সেই প্রজানুরঞ্জক রাজা কাশিরাজের দুই যমজ কন্যাকে বিবাহ করেন৷ দুই স্ত্রীর প্রতি তাঁর সমান ব্যবহার ছিল৷ এমন রূপবান্, ধার্মিক, সর্বগুণের আধার রাজার কোনও সন্তান হল না৷ নিঃসন্তান রাজা বড় মনোকষ্টে ভুগতেন আর নানারকম মাঙ্গলিক যাগযজ্ঞের আয়োজন করতেন, যদি এসবের আচরণে সন্তানলাভ হয়! প্রায় যখন হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন, তখন একদিন খবর পেলেন, ঋষি কাক্ষীবানের পুত্র চণ্ডকৌশিক মুনি এপথে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে তাঁরই রাজপ্রাসাদের কাছে একটি গাছের তলায় বিশ্রাম করছেন৷ সে খবর পেয়ে রাজা ছুটে গেলেন মুনির কাছে৷ ঋষি গৌতমের বংশধর মহাতপা এই মুনি৷ যদি তাঁর কৃপায় বংশধরের অভাব ঘোচে! নিঃসন্তান রাজার একান্ত অনুরোধ মুনি ফিরিয়ে দিলেন না৷ যথাসময়ে রাজার দুই পত্নীই গর্ভবতী হলেন৷ রাজ্যে আনন্দের বান বয়ে গেল৷ কিন্তু রানিদের প্রসবকালে দেখা গেল, উভয়েই দুইটি শরীরখণ্ড প্রসব করেছেন৷ দুই বোনেই অত্যন্ত দুঃখিত আর আশাহত হলেন৷ সেই জীবন্ত শরীরখণ্ড দুটি ত্যাগ করলেন দুজনেই৷ রানিদের আদেশে ধাত্রী সেই খণ্ডদুটিকে কাপড়ে মুড়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে রেখে এল৷ এদিকে জরানামের এক রাক্ষসী এই সমস্ত কিছু প্রত্যক্ষ করছিল৷ রাক্ষসী সে৷ নানারকম জাদুবিদ্যা জানে৷| রানিদের ত্যাগ করা শরীরের দুটো টুকরো সে যত্ন করে নিয়ে এল নিজের ডেরায়৷ তারপর সেই টুকরো দুটোকে নিখুঁতভাবে জুড়ল৷ জুড়ে গিয়ে সেটি যখন একটি হৃষ্টপুষ্ট শিশুর আকার নিয়ে কেঁদে উঠল, রাক্ষসীও মুগ্ধ হয়ে গেল৷ মায়ায় ভরে উঠল তার কঠোর মন৷ সে মনে মনে ভাবল, ‘এতকাল তো কেবল অপরের ক্ষতি করে এসেছি৷ কিন্তু নিরপরাধ এই শিশুটিকে হত্যা করা কখনও উচিত নয়!’ সে এবার মানুষের বেশে শিশুটিকে কোলে নিয়ে রাজার কাছে উপস্থিত হল৷ ফিরিয়ে দিল রাজার সন্তান৷ রাজা রাক্ষসীর পরিচয় জানতে চাইলেন৷ সে বলে উঠল নিজের কথা৷
প্রতি মানুষের ঘরে গৃহদেবী নামধারী রাক্ষসীর বাস৷ এরা মানুষের সুখশান্তি বিধান করে৷ প্রাচীনকালে ব্রহ্মা এদের সৃষ্টি করে দেবতার রূপ দিয়েছিলেন৷ আর তারপর মানুষের ঘরে থাকবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন৷ নাম দিয়েছিলেন গৃহদেবী৷ সেই থেকে যে বাড়িতে এদের ছবি এঁকে পুজোপাঠ করা হয়, সেই বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হয়৷ রাজার বাড়িতে এতকাল থেকে এসেছে৷ দুবেলা ধূপধুনো দিয়ে পূজালাভও হয়েছে তার৷ আজ তাই রাজাকে তার উপকার ফিরিয়ে দেওয়ার পালা৷ রাজা সেসব শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন৷ দুঃখের কালো মেঘ কেটে গিয়ে খুশির ঝলমলে রোদ উঠল সে রাজ্যে৷ যথাসময়ে শিশুর জাতকর্ম নামকরণাদি সংস্কার সম্পন্ন হল৷ জরার জন্যই পুত্রকে ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়েছে৷ রাজা পুত্রের নাম দিলেন, জরাসন্ধ৷ পুত্রজন্মের খবর পেয়ে চণ্ডকৌশিক মুনি রাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন৷ শিশুকে দেখামাত্র সত্যদ্রষ্টা ঋষির চোখের সামনে ভবিষ্যৎ যেন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল৷ রাজাকে তিনি বলে গেলেন, ‘এ যে সে শিশু নয়! ভবিষ্যতে প্রবলপ্রতাপে এ সন্তান সমস্ত রাজাদের প্রভাবিত করবে৷ এর আদেশ মেনে চলবে সমস্ত রাজারা৷ যারা এর বিরোধিতা করবে তারা বিনষ্ট হবে৷’ বৃহদ্রথরাজা পুত্রগর্বে এতটাই গর্বিত ছিলেন যে মুনির কথার গূঢ়ার্থ তিনি ধরতে পারলেন না৷ যথাসময়ে জরাসন্ধের ওপর রাজ্যের ভার দিয়ে দুই পত্নীর সঙ্গে রাজা বাণপ্রস্থে চলে গেলেন৷ মগধের রাজা হলেন জরাসন্ধ৷
মুনির কথাই সত্যি হল৷ ধীরে ধীরে জরাসন্ধ এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন যে তাঁকে কোনও রাজা অতিক্রম করতে পারছিলেন না৷ রাজাদের মধ্যেও দুটো ভাগ হয়ে গেল৷ একদল জরাসন্ধের প্রভাব স্বীকার করে নিলেন৷ জরাসন্ধ পাশে বন্ধু হিসেবে পেলেন হংস আর ডিম্বক নামের দুই রাজাকে৷ ধীরে ধীরে পাঞ্চাল, বঙ্গ, পুণ্ড্রক ইত্যাদি সমস্ত দেশের রাজা মগধরাজ জরাসন্ধের অধীনতা মেনে নিলেন৷ যাঁরা জরাসন্ধকে শ্রেষ্ঠরাজা বলে স্বীকার করলেন না, তাঁরা জরাসন্ধের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন৷ কৃষ্ণের অত্যাচারী মাতুল কংসের সঙ্গে জরাসন্ধের কন্যার বিবাহ হয়েছিল৷ কংসকে কৃষ্ণ বধ করেছিলেন৷ কৃষ্ণের কংসবধে ক্রুদ্ধ হলেন জরাসন্ধ৷ নিজের শত্রুর তালিকাভুক্ত করলেন কৃষ্ণসহ দ্বারকাবাসীকে৷ কৃষ্ণের তৎপরতায় জরাসন্ধের বন্ধুরাজা হংস ও ডিম্বকের মৃত্যু হলেও কৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন, জরাসন্ধকে অতিক্রম করা, শায়েস্তা করা অসম্ভবপ্রায়৷ তাই বুদ্ধিমান, বলবান পাণ্ডবভাইদের কথাই তাঁর সর্বাগ্রে মনে এল৷ পাণ্ডবেরাই পারেন জরাসন্ধের প্রবলপ্রতাপ থেকে তাঁকে এবং অন্যান্য রাজাদের রক্ষা করতে৷ যেভাবে জরাসন্ধ একের পর এক রাজ্যকে প্রভাবিত করছেন তাতে তিনি হয়তো একদিন ভারতবর্ষের একচ্ছত্র সম্রাট হবেন৷ তার চেয়েও বড় আর ভয়ানক বিষয় হল, যাঁরা জরাসন্ধের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, সেইসব রাজাকে তিনি গোপন এক পর্বতগুহায় বন্দি করে রেখেছেন৷ কানাঘুষো শোনা যায়, তিনি নাকি সংকল্প করেছেন, পুরুষমেধ যজ্ঞ করবেন৷ যদিও এই যজ্ঞে পুরুষবধের কোনও বিধান নেই, কিন্তু দুরাচারী প্রবলপ্রতাপ জরাসন্ধ সেসব মানলে তো! তিনি নিজেই হয়তো বিধান দেবেন পুরোহিতদের৷ তারপর একদিন সকলের চোখের আড়ালে অনাথ হবে সেইসব রাজ্য, যেসব রাজ্যে সিংহাসনে আসীন ছিলেন কিছু হার না মানা রাজা, যাঁরা তাঁদের শিরদাঁড়াকে শক্ত রেখে নির্ভয়ে এগিয়েছেন, বন্দি হয়েছেন কিন্তু পরাধীনতা মেনে নেননি৷ শত্রুদের নির্মূল করে শত্রুহীন সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হবেন তিনি, এই তাঁর অভিলাষ৷
যুধিষ্ঠিরকে জরাসন্ধের বৃত্তান্ত বলতে বলতে কৃষ্ণ নিজেই উন্মনা হয়ে পড়ছিলেন৷ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের জন্য ব্যগ্রতা তাঁর মনেও কিছুটা আশার আলো এনে দিয়েছে৷ পাণ্ডবেরাই এ ঘোর বিপদে উদ্ধারকর্তা হতে পারেন৷ যদি যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ করার বাসনা তীব্র হয়! যদি আবার পাণ্ডবেরা একজোট হয়ে যজ্ঞের কাজে কৃতসংকল্প হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন! সবার আগে প্রয়োজন জরাসন্ধনামধারী পথের কাঁটাকে দূর করা৷ আর তারও আগে পাণ্ডবদের স্বপ্নদেখানো দরকার! সাম্রাজ্যের স্বপ্ন৷ কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের সংলাপ এগিয়ে চলে…
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেন যুধিষ্ঠির, কে এই জরাসন্ধ? জরাসন্ধের পরাক্রমের কথা বিশদে জানতে চান তিনি৷ কৃষ্ণ বলে চলেন সে কথা৷ মগধদেশে বৃহদ্রথ নামে এক বিক্রমশালী রাজা ছিলেন৷ তাঁর যেমন ছিল সৈন্যবল তেমনই সম্পদশালী ছিলেন তিনি৷ যুদ্ধে তিনি অপরাজেয় ছিলেন৷ অত্যন্ত ধার্মিক সেই প্রজানুরঞ্জক রাজা কাশিরাজের দুই যমজ কন্যাকে বিবাহ করেন৷ দুই স্ত্রীর প্রতি তাঁর সমান ব্যবহার ছিল৷ এমন রূপবান্, ধার্মিক, সর্বগুণের আধার রাজার কোনও সন্তান হল না৷ নিঃসন্তান রাজা বড় মনোকষ্টে ভুগতেন আর নানারকম মাঙ্গলিক যাগযজ্ঞের আয়োজন করতেন, যদি এসবের আচরণে সন্তানলাভ হয়! প্রায় যখন হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন, তখন একদিন খবর পেলেন, ঋষি কাক্ষীবানের পুত্র চণ্ডকৌশিক মুনি এপথে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে তাঁরই রাজপ্রাসাদের কাছে একটি গাছের তলায় বিশ্রাম করছেন৷ সে খবর পেয়ে রাজা ছুটে গেলেন মুনির কাছে৷ ঋষি গৌতমের বংশধর মহাতপা এই মুনি৷ যদি তাঁর কৃপায় বংশধরের অভাব ঘোচে! নিঃসন্তান রাজার একান্ত অনুরোধ মুনি ফিরিয়ে দিলেন না৷ যথাসময়ে রাজার দুই পত্নীই গর্ভবতী হলেন৷ রাজ্যে আনন্দের বান বয়ে গেল৷ কিন্তু রানিদের প্রসবকালে দেখা গেল, উভয়েই দুইটি শরীরখণ্ড প্রসব করেছেন৷ দুই বোনেই অত্যন্ত দুঃখিত আর আশাহত হলেন৷ সেই জীবন্ত শরীরখণ্ড দুটি ত্যাগ করলেন দুজনেই৷ রানিদের আদেশে ধাত্রী সেই খণ্ডদুটিকে কাপড়ে মুড়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে রেখে এল৷ এদিকে জরানামের এক রাক্ষসী এই সমস্ত কিছু প্রত্যক্ষ করছিল৷ রাক্ষসী সে৷ নানারকম জাদুবিদ্যা জানে৷| রানিদের ত্যাগ করা শরীরের দুটো টুকরো সে যত্ন করে নিয়ে এল নিজের ডেরায়৷ তারপর সেই টুকরো দুটোকে নিখুঁতভাবে জুড়ল৷ জুড়ে গিয়ে সেটি যখন একটি হৃষ্টপুষ্ট শিশুর আকার নিয়ে কেঁদে উঠল, রাক্ষসীও মুগ্ধ হয়ে গেল৷ মায়ায় ভরে উঠল তার কঠোর মন৷ সে মনে মনে ভাবল, ‘এতকাল তো কেবল অপরের ক্ষতি করে এসেছি৷ কিন্তু নিরপরাধ এই শিশুটিকে হত্যা করা কখনও উচিত নয়!’ সে এবার মানুষের বেশে শিশুটিকে কোলে নিয়ে রাজার কাছে উপস্থিত হল৷ ফিরিয়ে দিল রাজার সন্তান৷ রাজা রাক্ষসীর পরিচয় জানতে চাইলেন৷ সে বলে উঠল নিজের কথা৷
প্রতি মানুষের ঘরে গৃহদেবী নামধারী রাক্ষসীর বাস৷ এরা মানুষের সুখশান্তি বিধান করে৷ প্রাচীনকালে ব্রহ্মা এদের সৃষ্টি করে দেবতার রূপ দিয়েছিলেন৷ আর তারপর মানুষের ঘরে থাকবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন৷ নাম দিয়েছিলেন গৃহদেবী৷ সেই থেকে যে বাড়িতে এদের ছবি এঁকে পুজোপাঠ করা হয়, সেই বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হয়৷ রাজার বাড়িতে এতকাল থেকে এসেছে৷ দুবেলা ধূপধুনো দিয়ে পূজালাভও হয়েছে তার৷ আজ তাই রাজাকে তার উপকার ফিরিয়ে দেওয়ার পালা৷ রাজা সেসব শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন৷ দুঃখের কালো মেঘ কেটে গিয়ে খুশির ঝলমলে রোদ উঠল সে রাজ্যে৷ যথাসময়ে শিশুর জাতকর্ম নামকরণাদি সংস্কার সম্পন্ন হল৷ জরার জন্যই পুত্রকে ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়েছে৷ রাজা পুত্রের নাম দিলেন, জরাসন্ধ৷ পুত্রজন্মের খবর পেয়ে চণ্ডকৌশিক মুনি রাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন৷ শিশুকে দেখামাত্র সত্যদ্রষ্টা ঋষির চোখের সামনে ভবিষ্যৎ যেন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল৷ রাজাকে তিনি বলে গেলেন, ‘এ যে সে শিশু নয়! ভবিষ্যতে প্রবলপ্রতাপে এ সন্তান সমস্ত রাজাদের প্রভাবিত করবে৷ এর আদেশ মেনে চলবে সমস্ত রাজারা৷ যারা এর বিরোধিতা করবে তারা বিনষ্ট হবে৷’ বৃহদ্রথরাজা পুত্রগর্বে এতটাই গর্বিত ছিলেন যে মুনির কথার গূঢ়ার্থ তিনি ধরতে পারলেন না৷ যথাসময়ে জরাসন্ধের ওপর রাজ্যের ভার দিয়ে দুই পত্নীর সঙ্গে রাজা বাণপ্রস্থে চলে গেলেন৷ মগধের রাজা হলেন জরাসন্ধ৷
মুনির কথাই সত্যি হল৷ ধীরে ধীরে জরাসন্ধ এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন যে তাঁকে কোনও রাজা অতিক্রম করতে পারছিলেন না৷ রাজাদের মধ্যেও দুটো ভাগ হয়ে গেল৷ একদল জরাসন্ধের প্রভাব স্বীকার করে নিলেন৷ জরাসন্ধ পাশে বন্ধু হিসেবে পেলেন হংস আর ডিম্বক নামের দুই রাজাকে৷ ধীরে ধীরে পাঞ্চাল, বঙ্গ, পুণ্ড্রক ইত্যাদি সমস্ত দেশের রাজা মগধরাজ জরাসন্ধের অধীনতা মেনে নিলেন৷ যাঁরা জরাসন্ধকে শ্রেষ্ঠরাজা বলে স্বীকার করলেন না, তাঁরা জরাসন্ধের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন৷ কৃষ্ণের অত্যাচারী মাতুল কংসের সঙ্গে জরাসন্ধের কন্যার বিবাহ হয়েছিল৷ কংসকে কৃষ্ণ বধ করেছিলেন৷ কৃষ্ণের কংসবধে ক্রুদ্ধ হলেন জরাসন্ধ৷ নিজের শত্রুর তালিকাভুক্ত করলেন কৃষ্ণসহ দ্বারকাবাসীকে৷ কৃষ্ণের তৎপরতায় জরাসন্ধের বন্ধুরাজা হংস ও ডিম্বকের মৃত্যু হলেও কৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন, জরাসন্ধকে অতিক্রম করা, শায়েস্তা করা অসম্ভবপ্রায়৷ তাই বুদ্ধিমান, বলবান পাণ্ডবভাইদের কথাই তাঁর সর্বাগ্রে মনে এল৷ পাণ্ডবেরাই পারেন জরাসন্ধের প্রবলপ্রতাপ থেকে তাঁকে এবং অন্যান্য রাজাদের রক্ষা করতে৷ যেভাবে জরাসন্ধ একের পর এক রাজ্যকে প্রভাবিত করছেন তাতে তিনি হয়তো একদিন ভারতবর্ষের একচ্ছত্র সম্রাট হবেন৷ তার চেয়েও বড় আর ভয়ানক বিষয় হল, যাঁরা জরাসন্ধের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, সেইসব রাজাকে তিনি গোপন এক পর্বতগুহায় বন্দি করে রেখেছেন৷ কানাঘুষো শোনা যায়, তিনি নাকি সংকল্প করেছেন, পুরুষমেধ যজ্ঞ করবেন৷ যদিও এই যজ্ঞে পুরুষবধের কোনও বিধান নেই, কিন্তু দুরাচারী প্রবলপ্রতাপ জরাসন্ধ সেসব মানলে তো! তিনি নিজেই হয়তো বিধান দেবেন পুরোহিতদের৷ তারপর একদিন সকলের চোখের আড়ালে অনাথ হবে সেইসব রাজ্য, যেসব রাজ্যে সিংহাসনে আসীন ছিলেন কিছু হার না মানা রাজা, যাঁরা তাঁদের শিরদাঁড়াকে শক্ত রেখে নির্ভয়ে এগিয়েছেন, বন্দি হয়েছেন কিন্তু পরাধীনতা মেনে নেননি৷ শত্রুদের নির্মূল করে শত্রুহীন সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হবেন তিনি, এই তাঁর অভিলাষ৷
যুধিষ্ঠিরকে জরাসন্ধের বৃত্তান্ত বলতে বলতে কৃষ্ণ নিজেই উন্মনা হয়ে পড়ছিলেন৷ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের জন্য ব্যগ্রতা তাঁর মনেও কিছুটা আশার আলো এনে দিয়েছে৷ পাণ্ডবেরাই এ ঘোর বিপদে উদ্ধারকর্তা হতে পারেন৷ যদি যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ করার বাসনা তীব্র হয়! যদি আবার পাণ্ডবেরা একজোট হয়ে যজ্ঞের কাজে কৃতসংকল্প হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন! সবার আগে প্রয়োজন জরাসন্ধনামধারী পথের কাঁটাকে দূর করা৷ আর তারও আগে পাণ্ডবদের স্বপ্নদেখানো দরকার! সাম্রাজ্যের স্বপ্ন৷ কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের সংলাপ এগিয়ে চলে…
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে