পাঁচ ভাইয়ের এক পত্নী হলেন রমণীকুলদুর্লভ দ্রৌপদী৷ এতশত দুর্যোগ দুর্বিপাকেও ভাইয়ে ভাইয়ে ভালোবাসা বোঝাপড়া ছিল অটুট৷ দ্রৌপদীকে নিয়ে সকলে মিলে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগলেন৷ একদিন সেখানে এসে উপস্থিত হলেন দেবর্ষি নারদ৷ নারদ সাবধান করলেন তাঁদের৷ বললেন ভাইয়ে ভাইয়ে এমন সখ্যতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে যদি পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীর সঙ্গে থাকবার ক্ষেত্রে কোনও নিয়মে নিজেদের না বাঁধেন তবে৷ নারদ তাঁদের শোনালেন এক প্রাচীন গল্প, যাতে তাঁরা নারদের কথা মেনে নিয়ে সেই মতো কাজ করেন৷ বস্তুতপক্ষে দেবতারা ঋষিরা সকলেই চাইতেন হস্তিনাপুরের সিংহাসন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের হোক৷ তাঁরা চাইতেন অপর পাণ্ডব ভাইরাও সুস্থসবল থেকে ন্যায়পথে তাঁর সহযোগী হোন৷
দেবর্ষি নারদ গল্প বলতে লাগলেন৷ দৈত্যরাজ হিরণ্যশিপুর কথা ত্রিভুবনবিদিত৷ তাঁর বংশেই নিকুম্ভ নামধারী এক দৈত্যশ্রেষ্ঠের জন্ম হয়েছিল৷ সেই নিকুম্ভের সুন্দ আর উপসুন্দ নামে দুই পুত্র ছিল৷ দুই ভাই ছিল প্রবল বলবান, পরাক্রমশালী৷ দুইজনেই ছিল অতি নিষ্ঠুর৷ তাদের স্বভাবে যেমন মিল ছিল তেমনি ছিল মনের মিল৷ সব কাজ দুটিতে একসঙ্গে মিলেমিশে করত৷ তাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করার কথা কেউ কল্পনাতেই আনতে পারত না৷ এহেন সুন্দ উপসুন্দ মিলে একবার স্থির করল স্বর্গ মর্ত পাতাল এই তিন ভুবনকে নিজেদের বশে আনতে হবে৷ নইলে আর কীসের প্রতাপ! তারা দুজনে মিলে বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে ভয়ংকর তপস্যা আরম্ভ করল৷ সেই তপস্যা দেখে দেবতারাও ভয় পেয়ে গেলেন৷ নানাভাবে তাদের তপস্যা নষ্ট করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারলেন না৷ অবশেষে ব্রহ্মা তাদের তপোনিষ্ঠা দেখে খুশি হয়ে তাদের কাছে এলেন৷ তারা দুজনেতেই সমস্বরে অমরত্বের বর চাইল৷ ব্রহ্মা বললেন, ‘তোমরা যখন তিন ভুবনের প্রভুত্ব চেয়ে তপস্যা শুরু করেছিলে, তাই মৃত্যুকে তোমরা জয় করতে পারবে না৷ তবে ত্রিভুবনে কেউ তোমাদের মারতে পারবে না৷ একমাত্র তোমরা যদি না নিজেরা পরস্পরের মৃত্যুর কারণ হও৷’ দুই ভাই খুব নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল কারণ তারা নিজেদের অটুট বাঁধন সম্পর্কে এতটাই দৃঢ়নিশ্চিত ছিল৷ নিজেদের দেশে ফিরে তারা আমোদ আহ্লাদে বেশ কিছুদিন কাটাল আর তারপর বেরোল ত্রিভুবন জয় করতে৷ দেবতা, পাতালবাসী, ঋষি সকলের ত্রাসের কারণ হয়ে, সমস্ত দিগ্বিদিকে নিজেদের নিষ্ঠুরতায় ভরিয়ে তুলে তারা কুরুক্ষেত্রে নিজেদের রাজধানী তৈরি করল৷ এদিকে দেবতারা ঋষিরা সকলে আকুল হয়ে গেলেন ব্রহ্মার কাছে৷ বসল সভা৷ সভায় ডাকা হল বিশ্বকর্মাকে৷ ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা নিজের কল্পনায় অতিযত্নে তৈরি করলেন এক অপূর্ব রমণীকে৷ ব্রহ্মার আশীর্বাদে সেই রমণী ত্রিভুবনে দুর্লভ সৌন্দর্যের অধিকারিণী হলেন৷ নাম হল তাঁর তিলোত্তমা৷ এদিকে সুন্দ আর উপসুন্দ তখন বিন্ধ্যপর্বতসংলগ্ন এক মনোরম সমতলভূমিতে সুরানারীসহযোগে ত্রিভুবন জয়ের আনন্দ উপভোগে মত্ত৷ দেবতাদের নির্দেশে তিলোত্তমা রক্তবসনা হয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন৷ তাকে দেখে কামমত্ত হল দুই ভাই৷ দুজনেই ভুলে গেল তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন৷ দুজনেই কামনা করল এক নারীকে৷ মত্ত দুই ভাই পরস্পর বিবাদ করতে লাগল৷ সে বিবাদ ক্রমে প্রবল হল৷ কেউই এগিয়ে এল না তাদের বিবাদমুক্ত করতে৷ প্রবল পরাক্রমী দুই ভাই একনারীকে চেয়ে যুদ্ধ শুরু করল আর তার পরিণাম হল মৃত্যু৷
এ গল্প বলে নারদ সাবধান করলেন পাণ্ডবদের৷ দেবর্ষির পরামর্শে তাঁরই উপস্থিতিতে এক রফায় এলেন পাঁচ ভাইয়ে মিলে৷ কোনওমতে যাতে দ্রৌপদীকে ঘিরে তাঁদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি না হয়, তাই রফা৷ এমন অসময়ে পাঁচজনের একসঙ্গে থাকাটা খুব জরুরি৷ এমনিতেই দেশে বিবাদ সবই প্রায় ভাইয়ে ভাইয়ে৷ স্থির হল তাঁরা প্রত্যেকে এক বছর করে দ্রৌপদীর কাছে থাকবেন৷ আর সেইসময় যদি কোনও ভাই সেখানে প্রবেশ করেন তবে তাঁকে বারো বছর বনে থেকে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে৷ সকলেই মেনে নিলেন এই প্রস্তাব৷ তখন দ্রৌপদীর সঙ্গে সংসারবাস চলছে যুধিষ্ঠিরের৷ সেইসময় সে দেশে এক ব্রাহ্মণের বহুকষ্টের ধন গোরুগুলোকে চুরি করল কয়েকটি দস্যু৷ ব্রাহ্মণ এসে কেঁদে পড়লেন অর্জুনের কাছে৷ পাণ্ডবদের যে ঘরে অস্ত্রশস্ত্র থাকত সে ঘরেই যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর সঙ্গে থাকছিলেন৷ তাই অর্জুন পড়লেন ফাঁপরে৷ এদিকে ব্রাহ্মণের কাতর আর্তনাদ, আর অন্যদিকে ভাইয়ে ভাইয়ে স্থির হওয়া নিয়মের বেড়াজাল৷ শেষমেশ কর্তব্যের পাল্লাই ভারী হল৷ প্রতিজ্ঞাভাঙার অপরাধের শাস্তি মাথা পেতে নেবেন এই স্থির করে অর্জুন প্রবেশ করলেন দ্রৌপদী আর যুধিষ্ঠিরের ঘরে৷ ধনুর্বাণ নিলেন আর তারপর চোরেদের হাত থেকে ব্রাহ্মণের ধন উদ্ধার করলেন৷ তারপর রাজধানীতে ফিরে এসে যুধিষ্ঠিরকে জানিয়ে প্রতিজ্ঞাভাঙার অপরাধে শাস্তি স্বরূপ বারো বছর বনবাসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন৷ যুধিষ্ঠিরাদি অন্য ভাইরা একথা শুনে অত্যন্ত শোকার্ত হলেন৷ অর্জুনকে তাঁরা হারাতে চাইছিলেন না৷ অনিচ্ছাকৃত এ অপরাধ কোনওমতেই শাস্তিযোগ্য নয়৷ এসব নানা প্রবোধবাক্যেও অর্জুন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকলেন৷ তারপর একদিন বেরিয়ে পড়লেন বনবাসের পথে৷
অর্জুনের এই বনবাস ছিল বর্ণময়, নানা ঘটনাপরম্পরার সম্ভারে পূর্ণ৷ পিছনে ফেলে এসেছেন প্রিয় ভাইদের, ফেলে এসেছেন প্রিয়া দ্রৌপদীকে৷ হিসেবমতন বছরদুয়েক পরেই কাছে পেতেন দ্রৌপদীকে৷ সে সুখলাভের সৌভাগ্য আর হল না৷ ক্ষত্রিয় পুরুষ তিনি৷ এত সহজে কাতর হলে কি চলে? দ্রৌপদী তাঁকেই যে মনে মনে ভালোবেসেছিলেন, এ তিনি জানেন৷ সে সুখটুকুর রেশ মনে নিয়ে এগিয়ে চলেন সামনের দিকে৷ বহু দেশভ্রমণের পর গঙ্গাতীরে তিনি আশ্রম তৈরি করে থাকতে লাগলেন৷ অর্জুনের আগমনে মুনিঋষিরাও যেন নিশ্চিন্ত হয়ে সেই আশ্র্মকে বেছে নিলেন বসবাসের জন্য৷ এভাবে বহুজনপরিবৃত হয়ে সুখের বনবাসজীবন যাপন করতে লাগলেন অর্জুন৷ সেইস্থানেই একদিন গঙ্গাস্নানের সময় অর্জুনকে দেখে কামার্ত হলেন নাগকন্যা উলুপী৷ অর্জুনের সঙ্গ চাইলেন তিনি৷ কুরুকুলশ্রেষ্ঠ অর্জুনের বীরগাথা ততদিনে দিকে দিকে ব্যাপ্ত হয়েছে৷ উলুপীরও অজ্ঞাত নয় কোনও কথাই৷ মনে মনে অর্জুনকে ভেবে কতদিন কেটেছে৷ আজ অর্জুনকে এমন আচম্বিতে একান্তে পেয়ে তিনি প্রগল্ভা হয়ে উঠেছেন৷ নাগসুন্দরী যুক্তি দিলেন অর্জুনের ব্রহ্মচর্যযাপন কেবল দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেই৷ আর ক্ষত্রিয়ের তো একাধিক নারীসঙ্গে কোনও বাধা নেই৷ অর্জুন এরপর উলুপীর কথা আর ফেরাতে পারলেন না৷ বিবাহের পর কদিনই বা দ্রৌপদীকে কাছে পেয়েছেন! তারপর তো এমন নারীবর্জিত ব্রহ্মচর্যযাপন৷ বীর কুরুশ্রেষ্ঠের সঙ্গলাভের এতদিনের অভিলাষ পূর্ণ হল উলুপীর৷ নাগরাজকন্যা খুশি হয়ে অর্জুনকে বর দিলেন, সব জলজন্তু অর্জুনের বশীভূত হবে৷
নাগকন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গঙ্গাতীরের আশ্রমকে পিছনে ফেলে অর্জুন চললেন হিমালয়ের পথে৷ সেখানে নানা দেশ ভ্রমণের পর সমুদ্রতীরের রাজ্যগুলি বিচরণের সময় মণিপুর নামের এক রাজ্যে তিনি উপস্থিত হলেন৷ সে দেশের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে মুগ্ধ হলেন অর্জুন৷ সে দেশের রাজা চিত্রবাহন অর্জুনের চিত্রাঙ্গদার প্রতি প্রীতি জেনে আর তাঁর বংশপরিচয় জেনে খুশি হলেন৷ তবে চিত্রবাহন মেয়ের বিবাহের জন্য শর্ত স্থির করে রেখেছিলেন, তা জানালেন অর্জুনকে৷ তাঁর একমাত্র কন্যার সন্তান হবে এ বংশের উত্তরসূরি৷ সে-ই হবে এ রাজ্যের রাজা৷ এই শর্ত যদি পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ মেনে নেন, তবে রাজা সানন্দে নিজের আদরের কন্যাকে অর্জুনের হাতে সঁপে দেবেন৷ অর্জুনের মন তখন চিত্রাঙ্গদাতে আসক্ত৷ এ প্রস্তাব মেনে নিলেন তিনি৷ বিবাহ হল অর্জুন আর সমুদ্রপারের রাজকন্যার৷ বিবাহের পর চিত্রাঙ্গদাকে ভালোবেসে অর্জুন সে রাজ্যে বাস করলেন তিন বছরকাল৷ চিত্রাঙ্গদার গর্ভে আপন পুত্রসন্তান জন্ম নিলে তার মুখদর্শন করে বিদায় নিলেন অর্জুন৷ আরও দেশভ্রমণ তখনও বাকি যে!
দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে বিচরণ শেষ হলে তিনি চললেন পশ্চিমের দিকে৷ সেখানে প্রভাসতীর্থে কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল তাঁর৷ দ্বারকানগরীতে কৃষ্ণের বাসভবনের অর্জুনকে দেখবার জন্য বিপুল জনসমাবেশ হল৷ সে এক বিপুল উত্সঅবের আকার নিল ধীরে৷ বৃষ্ণি আর অন্ধকদের বার্ষিক উত্সসবের সময়ও তখন আসন্ন ছিল৷ রৈবতকপর্বতে সে আনন্দ উত্সকবকে কেন্দ্র করে পুরবাসীরা শামিল হল৷ সে অনুষ্ঠানে বসুদেবের কন্যা কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকে দেখলেন অর্জুন৷ আবারও মুগ্ধ হলেন তিনি৷ অর্জুনের এ ভাবান্তর বুদ্ধিমান কৃষ্ণের কিন্তু চোখ এড়াল না৷ তিনি মনে মনে খুশিই হলেন৷ মুচকি হেসে অর্জুনকে সুভদ্রাহরণের বুদ্ধি দিলেন৷ যদি স্বয়ংবরসভা হয়, তবে সুভদ্রা অপর কোনও পুরুষকে বরণ করতে পারেন৷ তাই একমাত্র আচমকা হরণ করলেই অর্জুনের পক্ষে সুভদ্রাকে লাভ করা সম্ভব৷ কারণ এমন হরণ ক্ষত্রিয়ের ক্ষেত্রে দোষের নয়৷ কৃষ্ণ মনে প্রাণে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠের সঙ্গে আত্মীয়তা চাইছিলেন৷ কৃষ্ণের অনুমতি পেয়ে অর্জুন মনে আরও সাহস সঞ্চয় করলেন৷ লোক মারফত যুধিষ্ঠিরকে জানালেন তাঁর পরিকল্পনার কথা৷ তারপর একদিন সকালে যখন স্নান সেরে রৈবতকপর্বতে দেবপূজার শেষে দ্বারকায় ফিরে আসছিলেন, অর্জুন বলপূর্বক অপহরণ করলেন সুন্দরী সুভদ্রাকে৷
বৃষ্ণিবংশীয় বীরেরা এমন ঘটনা শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন৷ ক্রুদ্ধ হলেন বলরামও৷ আর আশ্চর্যজনকভাবে কৃষ্ণকে নীরব, নিশ্চেষ্ট থাকতে দেখে অবাক হলেন তাঁরা৷ অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যখন তাঁরা তৈরি হচ্ছেন, তখন কৃষ্ণ মৌনতা ভাঙলেন৷ বুঝিয়ে বললেন সমস্ত কথা৷ অর্জুন কোনও অন্যায় করেননি৷ অপমান করেননি তাঁদের৷ বরং ক্ষত্রিয়জনোচিত কাজ করেছেন তিনি৷ সুভদ্রার এমন পতিভাগ্য বরং খুবই আনন্দের৷ ধীর স্থির কৃষ্ণের কথা বুঝলেন সকলে৷ অর্জুনকে আমন্ত্রণ জানালেন সকলে৷ সকলের উপস্থিতিতে দ্বারকায় অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রার বিবাহ হল৷
এদিকে অর্জুনের বনবাসের সময় প্রায় ফুরিয়ে আসছিল৷ ফুরিয়ে আসছিল দ্রৌপদীর সঙ্গে দীর্ঘবিরহযাপনের কাল৷ যে মন নিয়ে দেশ ছেড়ে, ভাইদের ছেড়ে, পত্নীকে ছেড়ে বেরিয়েছিলেন পথে, সে মন আজ অনেক পরিণত৷ আলস্যহীন পথচলায় সঙ্গী সকলে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁকে৷ নাগকন্যা উলুপী যে জড়তা ভেঙে দিয়েছিলেন তাঁর, সেই তিনি আজ আর কুণ্ঠাগ্রস্ত নন৷ তিনি জানেন দ্রৌপদী তাঁর মনে যে আসন নিয়ে রয়েছেন, সে স্থান কোনও অবস্থাতেই টলবার নয়৷ তিনি নিশ্চিত এ বিষয়ে যে বুদ্ধিমতী দ্রৌপদী তাঁকে বুঝবেন৷ প্রিয়কে আগের মতোই বরণ করে নেবেন তিনি৷
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
দেবর্ষি নারদ গল্প বলতে লাগলেন৷ দৈত্যরাজ হিরণ্যশিপুর কথা ত্রিভুবনবিদিত৷ তাঁর বংশেই নিকুম্ভ নামধারী এক দৈত্যশ্রেষ্ঠের জন্ম হয়েছিল৷ সেই নিকুম্ভের সুন্দ আর উপসুন্দ নামে দুই পুত্র ছিল৷ দুই ভাই ছিল প্রবল বলবান, পরাক্রমশালী৷ দুইজনেই ছিল অতি নিষ্ঠুর৷ তাদের স্বভাবে যেমন মিল ছিল তেমনি ছিল মনের মিল৷ সব কাজ দুটিতে একসঙ্গে মিলেমিশে করত৷ তাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করার কথা কেউ কল্পনাতেই আনতে পারত না৷ এহেন সুন্দ উপসুন্দ মিলে একবার স্থির করল স্বর্গ মর্ত পাতাল এই তিন ভুবনকে নিজেদের বশে আনতে হবে৷ নইলে আর কীসের প্রতাপ! তারা দুজনে মিলে বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে ভয়ংকর তপস্যা আরম্ভ করল৷ সেই তপস্যা দেখে দেবতারাও ভয় পেয়ে গেলেন৷ নানাভাবে তাদের তপস্যা নষ্ট করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারলেন না৷ অবশেষে ব্রহ্মা তাদের তপোনিষ্ঠা দেখে খুশি হয়ে তাদের কাছে এলেন৷ তারা দুজনেতেই সমস্বরে অমরত্বের বর চাইল৷ ব্রহ্মা বললেন, ‘তোমরা যখন তিন ভুবনের প্রভুত্ব চেয়ে তপস্যা শুরু করেছিলে, তাই মৃত্যুকে তোমরা জয় করতে পারবে না৷ তবে ত্রিভুবনে কেউ তোমাদের মারতে পারবে না৷ একমাত্র তোমরা যদি না নিজেরা পরস্পরের মৃত্যুর কারণ হও৷’ দুই ভাই খুব নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল কারণ তারা নিজেদের অটুট বাঁধন সম্পর্কে এতটাই দৃঢ়নিশ্চিত ছিল৷ নিজেদের দেশে ফিরে তারা আমোদ আহ্লাদে বেশ কিছুদিন কাটাল আর তারপর বেরোল ত্রিভুবন জয় করতে৷ দেবতা, পাতালবাসী, ঋষি সকলের ত্রাসের কারণ হয়ে, সমস্ত দিগ্বিদিকে নিজেদের নিষ্ঠুরতায় ভরিয়ে তুলে তারা কুরুক্ষেত্রে নিজেদের রাজধানী তৈরি করল৷ এদিকে দেবতারা ঋষিরা সকলে আকুল হয়ে গেলেন ব্রহ্মার কাছে৷ বসল সভা৷ সভায় ডাকা হল বিশ্বকর্মাকে৷ ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মা নিজের কল্পনায় অতিযত্নে তৈরি করলেন এক অপূর্ব রমণীকে৷ ব্রহ্মার আশীর্বাদে সেই রমণী ত্রিভুবনে দুর্লভ সৌন্দর্যের অধিকারিণী হলেন৷ নাম হল তাঁর তিলোত্তমা৷ এদিকে সুন্দ আর উপসুন্দ তখন বিন্ধ্যপর্বতসংলগ্ন এক মনোরম সমতলভূমিতে সুরানারীসহযোগে ত্রিভুবন জয়ের আনন্দ উপভোগে মত্ত৷ দেবতাদের নির্দেশে তিলোত্তমা রক্তবসনা হয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন৷ তাকে দেখে কামমত্ত হল দুই ভাই৷ দুজনেই ভুলে গেল তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন৷ দুজনেই কামনা করল এক নারীকে৷ মত্ত দুই ভাই পরস্পর বিবাদ করতে লাগল৷ সে বিবাদ ক্রমে প্রবল হল৷ কেউই এগিয়ে এল না তাদের বিবাদমুক্ত করতে৷ প্রবল পরাক্রমী দুই ভাই একনারীকে চেয়ে যুদ্ধ শুরু করল আর তার পরিণাম হল মৃত্যু৷
এ গল্প বলে নারদ সাবধান করলেন পাণ্ডবদের৷ দেবর্ষির পরামর্শে তাঁরই উপস্থিতিতে এক রফায় এলেন পাঁচ ভাইয়ে মিলে৷ কোনওমতে যাতে দ্রৌপদীকে ঘিরে তাঁদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি না হয়, তাই রফা৷ এমন অসময়ে পাঁচজনের একসঙ্গে থাকাটা খুব জরুরি৷ এমনিতেই দেশে বিবাদ সবই প্রায় ভাইয়ে ভাইয়ে৷ স্থির হল তাঁরা প্রত্যেকে এক বছর করে দ্রৌপদীর কাছে থাকবেন৷ আর সেইসময় যদি কোনও ভাই সেখানে প্রবেশ করেন তবে তাঁকে বারো বছর বনে থেকে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে৷ সকলেই মেনে নিলেন এই প্রস্তাব৷ তখন দ্রৌপদীর সঙ্গে সংসারবাস চলছে যুধিষ্ঠিরের৷ সেইসময় সে দেশে এক ব্রাহ্মণের বহুকষ্টের ধন গোরুগুলোকে চুরি করল কয়েকটি দস্যু৷ ব্রাহ্মণ এসে কেঁদে পড়লেন অর্জুনের কাছে৷ পাণ্ডবদের যে ঘরে অস্ত্রশস্ত্র থাকত সে ঘরেই যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর সঙ্গে থাকছিলেন৷ তাই অর্জুন পড়লেন ফাঁপরে৷ এদিকে ব্রাহ্মণের কাতর আর্তনাদ, আর অন্যদিকে ভাইয়ে ভাইয়ে স্থির হওয়া নিয়মের বেড়াজাল৷ শেষমেশ কর্তব্যের পাল্লাই ভারী হল৷ প্রতিজ্ঞাভাঙার অপরাধের শাস্তি মাথা পেতে নেবেন এই স্থির করে অর্জুন প্রবেশ করলেন দ্রৌপদী আর যুধিষ্ঠিরের ঘরে৷ ধনুর্বাণ নিলেন আর তারপর চোরেদের হাত থেকে ব্রাহ্মণের ধন উদ্ধার করলেন৷ তারপর রাজধানীতে ফিরে এসে যুধিষ্ঠিরকে জানিয়ে প্রতিজ্ঞাভাঙার অপরাধে শাস্তি স্বরূপ বারো বছর বনবাসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন৷ যুধিষ্ঠিরাদি অন্য ভাইরা একথা শুনে অত্যন্ত শোকার্ত হলেন৷ অর্জুনকে তাঁরা হারাতে চাইছিলেন না৷ অনিচ্ছাকৃত এ অপরাধ কোনওমতেই শাস্তিযোগ্য নয়৷ এসব নানা প্রবোধবাক্যেও অর্জুন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকলেন৷ তারপর একদিন বেরিয়ে পড়লেন বনবাসের পথে৷
অর্জুনের এই বনবাস ছিল বর্ণময়, নানা ঘটনাপরম্পরার সম্ভারে পূর্ণ৷ পিছনে ফেলে এসেছেন প্রিয় ভাইদের, ফেলে এসেছেন প্রিয়া দ্রৌপদীকে৷ হিসেবমতন বছরদুয়েক পরেই কাছে পেতেন দ্রৌপদীকে৷ সে সুখলাভের সৌভাগ্য আর হল না৷ ক্ষত্রিয় পুরুষ তিনি৷ এত সহজে কাতর হলে কি চলে? দ্রৌপদী তাঁকেই যে মনে মনে ভালোবেসেছিলেন, এ তিনি জানেন৷ সে সুখটুকুর রেশ মনে নিয়ে এগিয়ে চলেন সামনের দিকে৷ বহু দেশভ্রমণের পর গঙ্গাতীরে তিনি আশ্রম তৈরি করে থাকতে লাগলেন৷ অর্জুনের আগমনে মুনিঋষিরাও যেন নিশ্চিন্ত হয়ে সেই আশ্র্মকে বেছে নিলেন বসবাসের জন্য৷ এভাবে বহুজনপরিবৃত হয়ে সুখের বনবাসজীবন যাপন করতে লাগলেন অর্জুন৷ সেইস্থানেই একদিন গঙ্গাস্নানের সময় অর্জুনকে দেখে কামার্ত হলেন নাগকন্যা উলুপী৷ অর্জুনের সঙ্গ চাইলেন তিনি৷ কুরুকুলশ্রেষ্ঠ অর্জুনের বীরগাথা ততদিনে দিকে দিকে ব্যাপ্ত হয়েছে৷ উলুপীরও অজ্ঞাত নয় কোনও কথাই৷ মনে মনে অর্জুনকে ভেবে কতদিন কেটেছে৷ আজ অর্জুনকে এমন আচম্বিতে একান্তে পেয়ে তিনি প্রগল্ভা হয়ে উঠেছেন৷ নাগসুন্দরী যুক্তি দিলেন অর্জুনের ব্রহ্মচর্যযাপন কেবল দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেই৷ আর ক্ষত্রিয়ের তো একাধিক নারীসঙ্গে কোনও বাধা নেই৷ অর্জুন এরপর উলুপীর কথা আর ফেরাতে পারলেন না৷ বিবাহের পর কদিনই বা দ্রৌপদীকে কাছে পেয়েছেন! তারপর তো এমন নারীবর্জিত ব্রহ্মচর্যযাপন৷ বীর কুরুশ্রেষ্ঠের সঙ্গলাভের এতদিনের অভিলাষ পূর্ণ হল উলুপীর৷ নাগরাজকন্যা খুশি হয়ে অর্জুনকে বর দিলেন, সব জলজন্তু অর্জুনের বশীভূত হবে৷
নাগকন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গঙ্গাতীরের আশ্রমকে পিছনে ফেলে অর্জুন চললেন হিমালয়ের পথে৷ সেখানে নানা দেশ ভ্রমণের পর সমুদ্রতীরের রাজ্যগুলি বিচরণের সময় মণিপুর নামের এক রাজ্যে তিনি উপস্থিত হলেন৷ সে দেশের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে মুগ্ধ হলেন অর্জুন৷ সে দেশের রাজা চিত্রবাহন অর্জুনের চিত্রাঙ্গদার প্রতি প্রীতি জেনে আর তাঁর বংশপরিচয় জেনে খুশি হলেন৷ তবে চিত্রবাহন মেয়ের বিবাহের জন্য শর্ত স্থির করে রেখেছিলেন, তা জানালেন অর্জুনকে৷ তাঁর একমাত্র কন্যার সন্তান হবে এ বংশের উত্তরসূরি৷ সে-ই হবে এ রাজ্যের রাজা৷ এই শর্ত যদি পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ মেনে নেন, তবে রাজা সানন্দে নিজের আদরের কন্যাকে অর্জুনের হাতে সঁপে দেবেন৷ অর্জুনের মন তখন চিত্রাঙ্গদাতে আসক্ত৷ এ প্রস্তাব মেনে নিলেন তিনি৷ বিবাহ হল অর্জুন আর সমুদ্রপারের রাজকন্যার৷ বিবাহের পর চিত্রাঙ্গদাকে ভালোবেসে অর্জুন সে রাজ্যে বাস করলেন তিন বছরকাল৷ চিত্রাঙ্গদার গর্ভে আপন পুত্রসন্তান জন্ম নিলে তার মুখদর্শন করে বিদায় নিলেন অর্জুন৷ আরও দেশভ্রমণ তখনও বাকি যে!
দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে বিচরণ শেষ হলে তিনি চললেন পশ্চিমের দিকে৷ সেখানে প্রভাসতীর্থে কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল তাঁর৷ দ্বারকানগরীতে কৃষ্ণের বাসভবনের অর্জুনকে দেখবার জন্য বিপুল জনসমাবেশ হল৷ সে এক বিপুল উত্সঅবের আকার নিল ধীরে৷ বৃষ্ণি আর অন্ধকদের বার্ষিক উত্সসবের সময়ও তখন আসন্ন ছিল৷ রৈবতকপর্বতে সে আনন্দ উত্সকবকে কেন্দ্র করে পুরবাসীরা শামিল হল৷ সে অনুষ্ঠানে বসুদেবের কন্যা কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকে দেখলেন অর্জুন৷ আবারও মুগ্ধ হলেন তিনি৷ অর্জুনের এ ভাবান্তর বুদ্ধিমান কৃষ্ণের কিন্তু চোখ এড়াল না৷ তিনি মনে মনে খুশিই হলেন৷ মুচকি হেসে অর্জুনকে সুভদ্রাহরণের বুদ্ধি দিলেন৷ যদি স্বয়ংবরসভা হয়, তবে সুভদ্রা অপর কোনও পুরুষকে বরণ করতে পারেন৷ তাই একমাত্র আচমকা হরণ করলেই অর্জুনের পক্ষে সুভদ্রাকে লাভ করা সম্ভব৷ কারণ এমন হরণ ক্ষত্রিয়ের ক্ষেত্রে দোষের নয়৷ কৃষ্ণ মনে প্রাণে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠের সঙ্গে আত্মীয়তা চাইছিলেন৷ কৃষ্ণের অনুমতি পেয়ে অর্জুন মনে আরও সাহস সঞ্চয় করলেন৷ লোক মারফত যুধিষ্ঠিরকে জানালেন তাঁর পরিকল্পনার কথা৷ তারপর একদিন সকালে যখন স্নান সেরে রৈবতকপর্বতে দেবপূজার শেষে দ্বারকায় ফিরে আসছিলেন, অর্জুন বলপূর্বক অপহরণ করলেন সুন্দরী সুভদ্রাকে৷
বৃষ্ণিবংশীয় বীরেরা এমন ঘটনা শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন৷ ক্রুদ্ধ হলেন বলরামও৷ আর আশ্চর্যজনকভাবে কৃষ্ণকে নীরব, নিশ্চেষ্ট থাকতে দেখে অবাক হলেন তাঁরা৷ অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যখন তাঁরা তৈরি হচ্ছেন, তখন কৃষ্ণ মৌনতা ভাঙলেন৷ বুঝিয়ে বললেন সমস্ত কথা৷ অর্জুন কোনও অন্যায় করেননি৷ অপমান করেননি তাঁদের৷ বরং ক্ষত্রিয়জনোচিত কাজ করেছেন তিনি৷ সুভদ্রার এমন পতিভাগ্য বরং খুবই আনন্দের৷ ধীর স্থির কৃষ্ণের কথা বুঝলেন সকলে৷ অর্জুনকে আমন্ত্রণ জানালেন সকলে৷ সকলের উপস্থিতিতে দ্বারকায় অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রার বিবাহ হল৷
এদিকে অর্জুনের বনবাসের সময় প্রায় ফুরিয়ে আসছিল৷ ফুরিয়ে আসছিল দ্রৌপদীর সঙ্গে দীর্ঘবিরহযাপনের কাল৷ যে মন নিয়ে দেশ ছেড়ে, ভাইদের ছেড়ে, পত্নীকে ছেড়ে বেরিয়েছিলেন পথে, সে মন আজ অনেক পরিণত৷ আলস্যহীন পথচলায় সঙ্গী সকলে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁকে৷ নাগকন্যা উলুপী যে জড়তা ভেঙে দিয়েছিলেন তাঁর, সেই তিনি আজ আর কুণ্ঠাগ্রস্ত নন৷ তিনি জানেন দ্রৌপদী তাঁর মনে যে আসন নিয়ে রয়েছেন, সে স্থান কোনও অবস্থাতেই টলবার নয়৷ তিনি নিশ্চিত এ বিষয়ে যে বুদ্ধিমতী দ্রৌপদী তাঁকে বুঝবেন৷ প্রিয়কে আগের মতোই বরণ করে নেবেন তিনি৷
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।