দ্রোণ দ্রুপদের বিবাদ আর মীমাংসার কথা তো আগেই হয়েছে। তারপর দুজনের কতকটা লোকদেখানো বন্ধুত্বও হয়েছে। কিন্তু এসব হলে কী হবে? ভেতরে ভেতরে সে বন্ধুত্বে চিড় ধরেই গিয়েছে। দ্রোণের কাছে পরাস্ত হয়ে তাঁর দাক্ষিণ্যে রাজ্য ফিরে পেয়েছেন দ্রুপদ। এ অপমান তিনি ভোলেননি। তিনি হেরে গেলেন বাল্যের বন্ধুর কৌশলে। একমাত্র সন্তানই এ অপমানের জ্বালা ঘোচাতে সক্ষম হতে পারে। দ্রোণের পুত্রসম শিষ্যেরা এসে প্রবলপ্রতাপ দেখিয়ে গেছেন। অথচ না দ্রুপদের পুত্রেরা, না অপর কোনও আত্মীয় কেউই এ অসময়ে প্রবলবিক্রমে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াননি। মনে মনেই অধিক্ষেপ করেন তাঁদের। অনেক ভেবে স্থির করেন সন্তান চাই তাঁর। প্রবল পরাক্রমী সন্তান। একমাত্র সেই হয়তো পারে এ অপমানের জ্বালা থেকে রেহাই দিতে। কিন্তু এমন কাজে কে তাঁকে সাহায্য করতে পারেন? দ্রোণাচার্যের মতো প্রভাবশালী ব্রাহ্মণকে ক্ষাত্র তেজ দিয়ে পরাস্ত করা সম্ভব নয় এ দ্রুপদ বুঝেছিলেন। সন্তানার্থে যজ্ঞের জন্য উপযুক্ত ব্রাহ্মণের সন্ধানে একদিন তিনি বেরিয়ে পড়লেন। বিস্তীর্ণ প্রদেশ নিয়ে পাঞ্চাল দেশ। গঙ্গা যমুনা দুইয়ের জলে পরিপুষ্ট। আর এই দুই নদীর বিস্তৃত অববাহিকায় ব্রতধারী ব্রাহ্মণদের বাস। এলোমেলো পথ চলতে চলতে দ্রুপদ চিন্তা করেন, যদি এই অঞ্চলে দেখা মিলত তাঁর অভীষ্ট ব্রাহ্মণের! এখানেই বাস করতেন যাজ আর উপযাজ নামের দুই ভাই। উভয়েই বিদ্বান বুদ্ধিমান এবং অপরের বিপদেও যথাসাধ্য সহায়তা করতেন। রাজা দ্রুপদের মনে হল এঁরাই পারেন তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। তিনি উপযাজের সাথে সাক্ষাত্ করে বললেন, দ্রোণ হলেন তাঁর শত্রু। আর তাঁকে বধ করবার জন্য পুত্রকামনা করেন তিনি। উপযাজ যদি তাঁর অভীষ্টসিদ্ধির জন্য যজ্ঞ করতে রাজি হন, তবে দ্রুপদ তাঁকে অভীষ্টের অধিক ধন দিয়ে তুষ্ট করবেন। উপযাজ ছিলেন নির্লোভ। ধনের লোভে এমন কাজ করতে কোনও মতে রাজি হলেন না তিনি। এদিকে দ্রুপদও নাছোড়বান্দা। কেন যেন তাঁর মনে হয়েছিল, ইনিই সেই ব্রাহ্মণ যাঁর অন্বেষণে তিনি ইতস্তত ভ্রমণ করেছিলেন।দ্রুপদ হাল ছাড়লেন না । উপযাজকে অনুকূলে আনতে তাঁর বছরখানেক সময় ব্যয়িত হল । উপযাজ দ্রুপদের সনির্বন্ধ অনুরোধে কিছুটা নরম হলেন । বললেন, তাঁর ভাই যাজ হয়তো এমন যাগে সহায়তা করতে পারেন। কারণ, তিনি এ সমস্ত কাজ দোষের বলে মনে করেন না। ভরদ্বাজের পুত্র দ্রোণ আবার পরশুরামের কাছে তিনি অস্ত্রশিক্ষা করেছেন। সেই দ্রোণকে পরাস্ত করা বড় সহজ নয়। যুগপত্ ব্রাহ্ম ও ক্ষত্রিয়সুলভ তেজে বলীয়ান তিনি। রাজা দ্রুপদ তেমন তেজস্বী সন্তান কাঙ্ক্ষা করে যাজের কাছে গিয়ে তাঁকে বহু অনুনয় করে নিজের আর্জি পেশ করলেন। যাজ এ কাজ করতে সম্মত হলেন। তবে রাজাকে বললেন তিনি অতি দুরূহ এই পুত্রার্থ যাগ আর তার আয়োজনও প্রচুর। দ্রুপদ তখন মরিয়া। দ্রোণহন্তা পুত্রের জন্য এই যজ্ঞে পৌরোহিত্য করলেন যাজ আর তাঁকে সহায়তা করলেন উপযাজ। যাজ উপযাজের সহায়তায় সে যজ্ঞে হবি প্রদান ফলপ্রসূ হল। যজ্ঞের সে লেলিহান শিখাই যেন জন্ম দিল ভয়ংকর, আগুনের মতো উজ্জ্বল, বাণ আর বর্ম্মধারী এক পুরুষের আর শ্যামাঙ্গী অপূর্বসুন্দরী এক কন্যারত্নের। লোকের মুখে মুখে যেন ফিরতে লাগল এ কথা, এরা সামান্য নয়। দ্রুপদের সে দুর্দম মনোবাঞ্ছা যেন মূর্তি ধারণ করে উপস্থিত হল। রাজগৃহে বেড়ে উঠতে লাগলেন ভাইবোনে, ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদী কৃষ্ণা।
দ্রোণ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। দ্রুপদের সাথে সখ্যতার রফা হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে এত সহজে এই অপমান হজম করবেন না, দ্রোণ এ কথা বিলক্ষণ জানতেন। দ্রুপদের সন্তানকামনায় যজ্ঞ কিংবা পুত্রকন্যার জন্মসংবাদও তাঁর অগোচর ছিল না। দৈবকে কেই-বা খণ্ডাতে পারে! সব জেনেশুনে, নিজের নিয়তি অনুধাবন করেও নিজের যশ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য দ্রোণ ডেকে পাঠালেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে। এ অঞ্চলে দ্রোণাচার্যের মতো অস্ত্রগুরু আর কেই-বা আছে? শত্রুপুত্র জেনেও ধৃষ্টদ্যুম্নকে অস্ত্রবিদ্যা শেখালেন।
এ সমস্ত ঘটনা ঘটছিল, পাণ্ডবেরা তখন জতুগৃহ থেকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে নানা দিক ঘুরতে থাকলে ব্যাসদেব একচক্রানগরীকে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে পাণ্ডবদের থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন। সে বাড়িতে একদিন অতিথি হলেন এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্রতচারী ব্রাহ্মণ। তিনি নিজের নানাদিগ্দেশের আশ্চর্য সব ভ্রমণকাহিনি শোনাতে লাগলেন। মাতা কুন্তীসহ মুগ্ধচিত্ত পাণ্ডবেরা শুনলেন পাঞ্চালরাজকন্যার আশ্চর্য জন্মের কাহিনি। শুনলেন দ্রোণ দ্রুপদের শত্রুতার কথা। শুনে শিউরে উঠলেন তাঁরা। এর অমোঘ পরিণাম বুঝি সকলেই অনুমান করতে পারছিলেন। কিন্তু নিয়তিকে কেই-বা খণ্ডাতে পারে!পাণ্ডবেরা স্থির করলেন যে তাঁরা পাঞ্চালদেশে যাবেনপাণ্ডবেরা স্থির করলেন যে তাঁরা পাঞ্চালদেশে যাবেন। কুন্তীসহ পাণ্ডবেরা রওনা দেবার জন্য তৈরী তৈরি হচ্ছিলেন, সেই সময় সেখানে উপস্থিত হলেন মহর্ষি বেদব্যাস। কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর বেদব্যাস তাঁদের এক অশ্রুতপূর্ব আখ্যান শোনালেন। প্রাচীনকালে কোনও এক তপোবনে এক ঋষির সর্বগুণসম্পন্না সুন্দরী কন্যা ছিলেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর বিবাহ হয়নি। উপযুক্ত পতিলাভ না হওয়ায় মনের দুঃখে সেই কন্যা তীব্র তপশ্চরণে প্রবৃত্ত হলেন। এভাবে তিনি মহাদেবকে সন্তুষ্ট করলেন। তুষ্ট মহাদেব তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। মহাদেব তুষ্ট হয়েছেন, বর দিতে প্রস্তুত হয়েছেন, এতেই আত্মহারা সেই কন্যা ‘আমি সর্বগুণসম্পন্ন পতি কামনা করি’ এই কথাটি পাঁচবার বলে বসলেন। মহাদেব বললেন, ‘পাঁচবার তুমি পতিকামনা করেছো, অতএব তুমি জন্মান্তরে পঞ্চপতিলাভ করবে’ ।’
ব্যাসদেব পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে বললেন, এই সেই ঋষিকন্যা যাঁর দ্রৌপদীরূপে জন্ম হয়েছে। আর পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী হওয়াও তাঁর ভবিতব্য।
ব্যাসদেবের পরামর্শে মায়ের সাথে পাঁচপুত্র চললেন পাঞ্চালের পথে। তাঁদের সাথে চললেন পুরোহিত ধৌম্য। পাঞ্চালরাজ্যে উপস্থিত হয়ে দেখলেন দেশবিদেশ থেকে রাজারাজড়ারা সকলে চলেছেন রাজপুরীর পথে। পঞ্চপাণ্ডবের ছিল ব্রহ্মচারীর বেশ। সে দেশের ব্রাহ্মণেরা তাঁদের জানালেন, রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভার কথা। আমন্ত্রণ জানালেন ভিনদেশি ব্রহ্মচারীদের। পাণ্ডবেরা সকলে মিলে চললেন পাঞ্চালরাজপুরীর পথে, সে অপূর্ব স্বয়ংবরসভার সাক্ষী হতে।
রাজা দ্রুপদ যতই স্বয়ংবরসভার আয়োজন করুন, মনে মনে তিনি অর্জুনকেই দ্রৌপদীর পতিরূপে ভেবে রেখেছিলেন। দৃঢ়মতি দ্রুপদ এমন একটি ধনু নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা অর্জুন বিনা অপরে নোয়াতেই সমর্থ হবে না। তারপরে আসছে লক্ষ্যবেধের প্রশ্ন। এই লক্ষ্যবেধ যিনি করতে সমর্থ হবেন দ্রৌপদী তাঁরই হবেন, এই ছিল সেই স্বয়ংবরসভার শর্ত।দ্রুপদ বিশ্বাস করতেন যে, পাণ্ডবেরা জীবিত রয়েছেন । দ্রৌপদীর রূপের খ্যাতি আর আশ্চর্য জন্মের আখ্যান ছড়িয়ে পড়েছিল দিগ্বিদিকে। দ্রৌপদীকে পাওয়ার আশায় উপস্থিত হয়েছিলেন নানান দেশের নানান রাজপুত্রেরা। উপস্থিত হয়েছিলেন দুর্যোধন এমনকী কর্ণও। বিশেষভাবে তৈরি সে ধনু উত্তোলন করতে সকলেই অক্ষম হলেও কর্ণ কিন্তু সমর্থ হয়েছিলেন। পাণ্ডবেরা মৃত একথাই সকলের গোচরে ছিল। অর্জুন ছাড়া আর এমন বীর কেই-বা আছেন যিনি এমন আশ্চর্য ধনু উত্তোলন করে লক্ষ্যভেদ করতে পারেন! সুতরাং অঙ্গরাজ কর্ণই দ্রৌপদীকে লাভ করবেন একথা সভার সকলে স্থির ভেবে ফেলেছিল। এমন সময় সে ভাবনায় জল ঢেলে দিলেন দ্রৌপদী। লক্ষ্যভেদে উদ্যত কর্ণকে লক্ষ্য করে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন তিনি, ‘সুতের পুত্রকে আমি পতিত্বে বরণ করব না।’ সভায় তখন একটা ছুঁচ পড়লেও বুঝি শব্দ হবে। সভাস্থিত ক্ষত্রিয়েরা যখন সকলেই হতোদ্যম হয়েছেন,অপমানিত কর্ণ লক্ষ্যস্থল থেকে ফিরে এসেছেন নতমুখে, তখন সে ধনুকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চললেন ব্রাহ্মণবেশধারী অর্জুন। সকলকে বিস্ময়মূঢ় করে ধনুতে গুণারোপ করলেন তিনি। তারপর লক্ষ্যভেদও করলেন। হাসি ফুটল দ্রুপদের মুখে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে পাণ্ডবেরা বেঁচে রয়েছেন।ব্রাহ্মণবেশ থাকা সত্ত্বেও তাঁর অভিজ্ঞ চোখ পাণ্ডবদের চিনে নিতে ভুল করেনি | তিনি নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে যে, দ্রৌপদী তাঁর ইচ্ছামতো যথাযোগ্য পাত্র বরণ করে নিতে সক্ষম হবেন। মুগ্ধ হলেন দ্রৌপদীও। ইন্দ্রতুল্য অর্জুনের রূপে, বীর্যে মোহিত হয়ে কতকটা যেন মনে মনেই প্রেমাস্পদরূপে বরণ করলেন। হাতেই ধরা ছিল বরমালাখানি। বীরপরিবেষ্টিত সে সভায় নির্ভয়চিত্তে মালা সমর্পণ করলেন অর্জুনের বক্ষে।
পঞ্চপাণ্ডবকে একত্র দেখলে উপস্থিত সকলের সন্দেহ হতে পারে। তাই অর্জুনের লক্ষ্যভেদের সাথে সাথেই সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন যুধিষ্ঠির নকুল আর সহদেব। কেবল ভীমসেন ছিলেন অর্জুনের সঙ্গে। দ্রৌপদীর সভাস্থ বীর রাজগণের উপস্থিতি সত্ত্বেও এক অজ্ঞাতকুলশীল ব্রাহ্মণকে বরমাল্যপ্রদানের ঘটনা সকলকে সাময়িক হতচকিত করলেও সংবিৎ ফিরতেই সকলে রে রে করে ছুটলেন অর্জুনের দিকে। ভীমার্জুনকে ব্রাহ্মণজ্ঞান করে কোমলভাবে যুদ্ধ করলেও তাঁদের পরাক্রমে হতচকিত হলেন সকলে। কাউকে আঘাত না করে, কৌশলে সকলকে পাশ কাটিয়ে ভীম আর অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে উপস্থিত হলেন মাতা কুন্তীর কাছে। এদিকে কুন্তী ভিক্ষার্থে নির্গত পুত্রদের আগমনে বিলম্ব দেখে নানারকম অনিষ্টচিন্তা করছিলেন। পুত্রদের ডাকে নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। ভীম আর অর্জুন মায়ের কাছে ফিরে আনন্দিতচিত্তে বলে উঠলেন, ‘ভিক্ষা এনেছি।’ মা ও ঘর থেকেই বলে উঠলেন, ‘যা এনেছ সকলে মিলে ভোগ করো।’ তারপর দ্রৌপদীকে দেখেই আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। হায় হায় করে বলতে লাগলেন, ‘এ কী বললাম! এ যে বড় কষ্টের!’ নিয়তিকে কেই-বা খণ্ডাতে পারে! ঋষিকন্যার প্রতি মহাদেবের আশীর্বচন এ জন্মে ফলে গেল। অর্জুনকে ভালোবেসেও নিয়তির ফেরে পাঁচ পাণ্ডবকে পতিরূপে বরণ করলেন দ্রৌপদী। জুড়ে গেলেন পাঁচভাইয়ের ভাগ্যের সঙ্গে।
ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
দ্রোণ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। দ্রুপদের সাথে সখ্যতার রফা হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে এত সহজে এই অপমান হজম করবেন না, দ্রোণ এ কথা বিলক্ষণ জানতেন। দ্রুপদের সন্তানকামনায় যজ্ঞ কিংবা পুত্রকন্যার জন্মসংবাদও তাঁর অগোচর ছিল না। দৈবকে কেই-বা খণ্ডাতে পারে! সব জেনেশুনে, নিজের নিয়তি অনুধাবন করেও নিজের যশ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য দ্রোণ ডেকে পাঠালেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে। এ অঞ্চলে দ্রোণাচার্যের মতো অস্ত্রগুরু আর কেই-বা আছে? শত্রুপুত্র জেনেও ধৃষ্টদ্যুম্নকে অস্ত্রবিদ্যা শেখালেন।
এ সমস্ত ঘটনা ঘটছিল, পাণ্ডবেরা তখন জতুগৃহ থেকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে নানা দিক ঘুরতে থাকলে ব্যাসদেব একচক্রানগরীকে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে পাণ্ডবদের থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন। সে বাড়িতে একদিন অতিথি হলেন এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্রতচারী ব্রাহ্মণ। তিনি নিজের নানাদিগ্দেশের আশ্চর্য সব ভ্রমণকাহিনি শোনাতে লাগলেন। মাতা কুন্তীসহ মুগ্ধচিত্ত পাণ্ডবেরা শুনলেন পাঞ্চালরাজকন্যার আশ্চর্য জন্মের কাহিনি। শুনলেন দ্রোণ দ্রুপদের শত্রুতার কথা। শুনে শিউরে উঠলেন তাঁরা। এর অমোঘ পরিণাম বুঝি সকলেই অনুমান করতে পারছিলেন। কিন্তু নিয়তিকে কেই-বা খণ্ডাতে পারে!পাণ্ডবেরা স্থির করলেন যে তাঁরা পাঞ্চালদেশে যাবেনপাণ্ডবেরা স্থির করলেন যে তাঁরা পাঞ্চালদেশে যাবেন। কুন্তীসহ পাণ্ডবেরা রওনা দেবার জন্য তৈরী তৈরি হচ্ছিলেন, সেই সময় সেখানে উপস্থিত হলেন মহর্ষি বেদব্যাস। কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর বেদব্যাস তাঁদের এক অশ্রুতপূর্ব আখ্যান শোনালেন। প্রাচীনকালে কোনও এক তপোবনে এক ঋষির সর্বগুণসম্পন্না সুন্দরী কন্যা ছিলেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর বিবাহ হয়নি। উপযুক্ত পতিলাভ না হওয়ায় মনের দুঃখে সেই কন্যা তীব্র তপশ্চরণে প্রবৃত্ত হলেন। এভাবে তিনি মহাদেবকে সন্তুষ্ট করলেন। তুষ্ট মহাদেব তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। মহাদেব তুষ্ট হয়েছেন, বর দিতে প্রস্তুত হয়েছেন, এতেই আত্মহারা সেই কন্যা ‘আমি সর্বগুণসম্পন্ন পতি কামনা করি’ এই কথাটি পাঁচবার বলে বসলেন। মহাদেব বললেন, ‘পাঁচবার তুমি পতিকামনা করেছো, অতএব তুমি জন্মান্তরে পঞ্চপতিলাভ করবে’ ।’
ব্যাসদেব পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে বললেন, এই সেই ঋষিকন্যা যাঁর দ্রৌপদীরূপে জন্ম হয়েছে। আর পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী হওয়াও তাঁর ভবিতব্য।
ব্যাসদেবের পরামর্শে মায়ের সাথে পাঁচপুত্র চললেন পাঞ্চালের পথে। তাঁদের সাথে চললেন পুরোহিত ধৌম্য। পাঞ্চালরাজ্যে উপস্থিত হয়ে দেখলেন দেশবিদেশ থেকে রাজারাজড়ারা সকলে চলেছেন রাজপুরীর পথে। পঞ্চপাণ্ডবের ছিল ব্রহ্মচারীর বেশ। সে দেশের ব্রাহ্মণেরা তাঁদের জানালেন, রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভার কথা। আমন্ত্রণ জানালেন ভিনদেশি ব্রহ্মচারীদের। পাণ্ডবেরা সকলে মিলে চললেন পাঞ্চালরাজপুরীর পথে, সে অপূর্ব স্বয়ংবরসভার সাক্ষী হতে।
রাজা দ্রুপদ যতই স্বয়ংবরসভার আয়োজন করুন, মনে মনে তিনি অর্জুনকেই দ্রৌপদীর পতিরূপে ভেবে রেখেছিলেন। দৃঢ়মতি দ্রুপদ এমন একটি ধনু নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা অর্জুন বিনা অপরে নোয়াতেই সমর্থ হবে না। তারপরে আসছে লক্ষ্যবেধের প্রশ্ন। এই লক্ষ্যবেধ যিনি করতে সমর্থ হবেন দ্রৌপদী তাঁরই হবেন, এই ছিল সেই স্বয়ংবরসভার শর্ত।দ্রুপদ বিশ্বাস করতেন যে, পাণ্ডবেরা জীবিত রয়েছেন । দ্রৌপদীর রূপের খ্যাতি আর আশ্চর্য জন্মের আখ্যান ছড়িয়ে পড়েছিল দিগ্বিদিকে। দ্রৌপদীকে পাওয়ার আশায় উপস্থিত হয়েছিলেন নানান দেশের নানান রাজপুত্রেরা। উপস্থিত হয়েছিলেন দুর্যোধন এমনকী কর্ণও। বিশেষভাবে তৈরি সে ধনু উত্তোলন করতে সকলেই অক্ষম হলেও কর্ণ কিন্তু সমর্থ হয়েছিলেন। পাণ্ডবেরা মৃত একথাই সকলের গোচরে ছিল। অর্জুন ছাড়া আর এমন বীর কেই-বা আছেন যিনি এমন আশ্চর্য ধনু উত্তোলন করে লক্ষ্যভেদ করতে পারেন! সুতরাং অঙ্গরাজ কর্ণই দ্রৌপদীকে লাভ করবেন একথা সভার সকলে স্থির ভেবে ফেলেছিল। এমন সময় সে ভাবনায় জল ঢেলে দিলেন দ্রৌপদী। লক্ষ্যভেদে উদ্যত কর্ণকে লক্ষ্য করে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন তিনি, ‘সুতের পুত্রকে আমি পতিত্বে বরণ করব না।’ সভায় তখন একটা ছুঁচ পড়লেও বুঝি শব্দ হবে। সভাস্থিত ক্ষত্রিয়েরা যখন সকলেই হতোদ্যম হয়েছেন,অপমানিত কর্ণ লক্ষ্যস্থল থেকে ফিরে এসেছেন নতমুখে, তখন সে ধনুকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চললেন ব্রাহ্মণবেশধারী অর্জুন। সকলকে বিস্ময়মূঢ় করে ধনুতে গুণারোপ করলেন তিনি। তারপর লক্ষ্যভেদও করলেন। হাসি ফুটল দ্রুপদের মুখে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে পাণ্ডবেরা বেঁচে রয়েছেন।ব্রাহ্মণবেশ থাকা সত্ত্বেও তাঁর অভিজ্ঞ চোখ পাণ্ডবদের চিনে নিতে ভুল করেনি | তিনি নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে যে, দ্রৌপদী তাঁর ইচ্ছামতো যথাযোগ্য পাত্র বরণ করে নিতে সক্ষম হবেন। মুগ্ধ হলেন দ্রৌপদীও। ইন্দ্রতুল্য অর্জুনের রূপে, বীর্যে মোহিত হয়ে কতকটা যেন মনে মনেই প্রেমাস্পদরূপে বরণ করলেন। হাতেই ধরা ছিল বরমালাখানি। বীরপরিবেষ্টিত সে সভায় নির্ভয়চিত্তে মালা সমর্পণ করলেন অর্জুনের বক্ষে।
পঞ্চপাণ্ডবকে একত্র দেখলে উপস্থিত সকলের সন্দেহ হতে পারে। তাই অর্জুনের লক্ষ্যভেদের সাথে সাথেই সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন যুধিষ্ঠির নকুল আর সহদেব। কেবল ভীমসেন ছিলেন অর্জুনের সঙ্গে। দ্রৌপদীর সভাস্থ বীর রাজগণের উপস্থিতি সত্ত্বেও এক অজ্ঞাতকুলশীল ব্রাহ্মণকে বরমাল্যপ্রদানের ঘটনা সকলকে সাময়িক হতচকিত করলেও সংবিৎ ফিরতেই সকলে রে রে করে ছুটলেন অর্জুনের দিকে। ভীমার্জুনকে ব্রাহ্মণজ্ঞান করে কোমলভাবে যুদ্ধ করলেও তাঁদের পরাক্রমে হতচকিত হলেন সকলে। কাউকে আঘাত না করে, কৌশলে সকলকে পাশ কাটিয়ে ভীম আর অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে উপস্থিত হলেন মাতা কুন্তীর কাছে। এদিকে কুন্তী ভিক্ষার্থে নির্গত পুত্রদের আগমনে বিলম্ব দেখে নানারকম অনিষ্টচিন্তা করছিলেন। পুত্রদের ডাকে নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। ভীম আর অর্জুন মায়ের কাছে ফিরে আনন্দিতচিত্তে বলে উঠলেন, ‘ভিক্ষা এনেছি।’ মা ও ঘর থেকেই বলে উঠলেন, ‘যা এনেছ সকলে মিলে ভোগ করো।’ তারপর দ্রৌপদীকে দেখেই আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। হায় হায় করে বলতে লাগলেন, ‘এ কী বললাম! এ যে বড় কষ্টের!’ নিয়তিকে কেই-বা খণ্ডাতে পারে! ঋষিকন্যার প্রতি মহাদেবের আশীর্বচন এ জন্মে ফলে গেল। অর্জুনকে ভালোবেসেও নিয়তির ফেরে পাঁচ পাণ্ডবকে পতিরূপে বরণ করলেন দ্রৌপদী। জুড়ে গেলেন পাঁচভাইয়ের ভাগ্যের সঙ্গে।
ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।