ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
ভয়ানক প্রতিজ্ঞা করে ভীষ্ম যে সিংহাসন ত্যাগ করলেন, রয়ে গেলেন চিরকুমার, যে সিংহাসন ভোগ করা হয়ে উঠল না পাণ্ডুর, সে সিংহাসনের দাবিদার হলেন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম। কিন্তু তাদের মধ্যে গোল লেগেই রইল। এই সিংহাসনে কি অভিশাপ ছিল? অথবা ছিল অনেকের লোভ। পাণ্ডু কয়েকদিনের রাজা হলেন আর তার পরে পরেই অকালে ত্যাগ করতে হল বড় সাধের এই পুতুলখেলার জগত্। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হবার ফলে ভোগ করতে পারলেন না। কিন্তু সবটুকু ছাড়তে পারলেন কই। যা কিছু মূল্যবোধ ছিল পিতৃপুরুষক্রমে পাওয়া সেসবও কখনও কখনও জলাঞ্জলি দিতে হতে লাগল। তাও না পারলেন সন্তানদের সঠিক পরিচালিত করতে, না পারলেন তাদের অনুশাসনে বাঁধতে। কখনও অন্ধ সন্তানস্নেহে ভালোমন্দ বিচার বুদ্ধি হারালেন। পরে আফসোস করলেন কিন্তু ফিরে আসবার পথটা যে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল সে হয়তো কুরুবৃদ্ধরা সকলেই অনুধাবন করতে পারছিলেন। যাইহোক সেসব অনেক পরের কথা। পিতামহ ভীষ্মের স্নেহচ্ছায়ায়, মাতাদের আদরে সোহাগে সুখেই বেড়ে উঠছিলেন পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানেরা। অভাব ছিল না কিছুরই। কিন্তু যখন অভাব থাকে না কিছুর তখন হয়তো তার জায়গা নেয় অন্য কিছু। জন্মলগ্ন থেকেই দুর্যোধনের সাথে জুড়ে ছিল নানান অশুভ অমঙ্গলসূচক ঘটনাবলি। তাই তাকে নিয়ে চিন্তার অন্ত ছিল না ধৃতরাষ্ট্রের। অন্ধ হলেও রাজ্যের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় ছিল তাঁর নখদর্পণে। পাণ্ডুর অবর্তমানে রাজ্য একপ্রকার চালিয়ে নিচ্ছিলেন তিনিই।
এদিকে পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন ছিলেন সবচেয়ে বুদ্ধিমান, অধ্যবসায়ী। আর ভীমের ক্ষমতা ছিল সবচাইতে বেশি। ছেলেবেলায় ভীমের ছেলেমানুষি দুষ্টবুদ্ধিও প্রবল ছিল। ঈর্ষাবশত নয় কিন্তু স্বভাবগত চাপল্যহেতু প্রায়শই কৌরবভাইদের বিশেষ করে দুর্যোধনকে বেকায়দায় ফেলতেন ভীম। অন্যান্য ছেলেরা প্রবল ভীমকেই তাদের প্রধান বলে মেনে নিয়েছিল। মানতে পারছিলেন শুধু দুর্যোধন। যাঁর পিতা রাজ্যের রাজা, তিনি হয়তো নিজেকে সে রাজ্যের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে মনে করতেন। ভীমের এমন পরাক্রম তাঁর অসহনীয় বলে মনে হত। খেলাচ্ছলে এমন অপদস্থ হওয়া তিনি মেনে নিতে পারতেন না। যদিও কুরুবৃদ্ধেরা ভীম দুর্যোধনের এই ছেলেখেলা নজর করবার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ছেলেবেলায় এমন তো কত কী হয়ে থাকে। এরই অন্তরালে যে একজনের মনে ক্ষোভ, অসূয়ার আগুন ঘনীভূত হচ্ছে সে আর কেই-বা বুঝেছে? সেই ছোট্টটি থেকে এইভাবে ভীমসেনের বিরুদ্ধে, পাণ্ডবভাইদের বিরুদ্ধে হিংসার বীজ রোপিত হল দুর্যোধনের মনে। দুর্যোধন বুঝেছিলেন, একমাত্র অসদুপায়েই পাণ্ডবদের জব্দ করা সম্ভব।
ভীমসেন ছিলেন অত্যন্ত ভোজনরসিক। দুর্যোধনের ঈর্ষাকাতর মন এমনই এক ছিদ্রের অনুসন্ধান করছিল। গঙ্গার তীরে তিনি বিলাসবহুল সুন্দর সুন্দর তাঁবু তৈরি করালেন, যার কিছুটা থাকল জলে আর কিছুটার অবস্থান স্থলে। পাকপটু ব্যক্তিরা দুর্যোধনের আদেশে সেখানে অপূর্ব ভোজ্যদ্রব্য তৈরি করতে লাগল। এরপর সমস্ত ব্যবস্থা হলে তিনি পাণ্ডবদের আমন্ত্রণ করে সেখানে নিয়ে উপস্থিত হলেন। উদ্দেশ্য প্রমোদবিহার। সরলমতি পাণ্ডবেরা ঘুণাক্ষরেও দুর্যোধনের দুরভিসন্ধির আঁচ পেলেন না। দুর্যোধনের দুর্জনজনোচিত মধুর বাক্যে তাঁরা আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, পটমণ্ডপের মনোরম পরিবেশে সুখে জলবিহার করলেন আর শেষে বন্ধু ভেবে দুর্যোধনের দেওয়া খাদ্যবস্তু গ্রহণ করলেন। ভীমকেই বিশেষভাবে শত্রু বলে মনে করতেন দুর্যোধন। তাই তাঁর ভোজ্যে নিজেই বিষ মিশিয়েছিলেন। নিজে হাতে করে বিষমিশ্রিত সুস্বাদু ভোজ্য খাইয়ে দিলেন ভীমসেনকে। এ এমন বিষ যা অতি ধীরে সংজ্ঞাহীন করে। ভোজনাদির পরেও পাণ্ডব আর কৌরবেরা পুনরায় একত্র জলবিহার করলেন। রাত্রে অতিপরিশ্রান্ত ভীমসেন কতকটা বিষের প্রভাবেই ধীরে ধীরে আরও ক্লান্ত হয়ে অন্যান্য কুরুবালকের সাথে যেতে সমর্থ হলেন না। পটমণ্ডপেই নিদ্রিত হয়ে পড়লেন তিনি। এমন এক সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন দুর্যোধন। ভীমসেনকে লতা দিয়ে বেঁধে জলে ফেলে দিলেন। নিজের পরাক্রম প্রকাশের কোনও সুযোগই পেলেন না ভীম। সংজ্ঞাহীন হয়ে জলে পড়ে অচিরেই ভীমের মৃত্যু হবে এই ভেবে আনন্দিতচিত্তে দুর্যোধন ফিরে গেলেন স্বস্থানে। যুধিষ্ঠিরাদি অন্য পাণ্ডবদের অনিষ্টচিন্তা করলেও দুর্যোধনের শত্রুতা ছিল মূলত ভীমের সাথে। ভীমহীন পাণ্ডবদের তিনি তেমন গুরুত্ব দিতে চাননি। ভীমসেনকে খুঁজে না পেয়ে বিষণ্ণচিত্ত পাণ্ডবেরা আর দুর্যোধনসহ অপরাপর কৌরবেরা ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে।
এদিকে সংজ্ঞাহীন ভীম জলের নীচে যেখানে পড়েছিলেন, সেটা ছিল নাগলোক। আর নাগরাজ বাসুকী ছিলেন ভীমের মাতামহ রাজা কুন্তীভোজের মাতামহ। ভীমের পরিচয় পেয়ে খুবই আনন্দিত হলেন বাসুকী। নাগেদের প্রভাবে ভীমের শরীর বিষমুক্ত হল। নাগলোকে বিপুল আপ্যায়ন পেয়ে ভীম ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে। যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবেরা ভীমের আকস্মিক অন্তর্ধানে হতচকিত হয়ে ছিলেন। তাঁর ফিরে আসাতে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন আর সমস্ত ঘটনা অনুপুঙ্খ শুনে দুর্যোধনের কুকীর্তি বিষয়ে নিশ্চিত হলেন। তাঁরা পরস্পরে স্থির করলেন, ভবিষ্যতে এমন বিপদ আবার আসতে পারে তাই সাবধান হওয়া প্রয়োজন। তবে সমস্ত ঘটনা তাঁরা গোপন রাখলেন। তাঁদের একমাত্র সহায় ছিলেন পিতৃব্য বিদুর। পিতৃহারা পাণ্ডবদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন বিদুর আর সর্বদা সুপরামর্শ দিতেন।
পিতামহ ভীষ্ম আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় কৌরবপাণ্ডবেরা কৃপাচার্য আর দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করলেন। এতকাল সকলে ভীমের পরাক্রমের সাথে পরিচিত ছিল। এবার সকলের সম্মুখে প্রকাশিত হল তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের অস্ত্রবিদ্যায় নৈপুণ্য। তারপর শিক্ষার শেষে কুরুবৃদ্ধদের আগ্রহে এক শিক্ষাপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হল। সে রঙ্গভূমিতে কুরুবালকদের বিশেষত অর্জুনের কুশলতায় সকলে মুগ্ধ হল। সেই রঙ্গভূমিতেই আকস্মিক আবির্ভাব ঘটল বীর কর্ণের, পাণ্ডবমাতা কুন্তীর ত্যক্ত কানীনপুত্রের। সুতের গৃহে লালিত হলেও ক্ষত্রিয়ের তেজ ধারণ করছেন তিনি। শিক্ষা প্রদর্শনীতে পরাক্রমী অর্জুনের প্রতিযোগীরূপেই যেন স্পর্ধাভরে উপস্থিত হলেন। প্রদর্শন করলেন নিজের অস্ত্রবিদ্যা। বিস্ময়ে বিমূঢ় হল উপস্থিত জনগণ। কেউ অর্জুনের কেউ বা কর্ণের জয়ধ্বনি করতে লাগল। অর্জুনের নৈপুণ্যে ভীত ছিলেন যে দুর্যোধন, তিনি কর্ণকে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন। নিজেই এগিয়ে এসে বন্ধুরূপে বরণ করলেন। ভীমসেনকে বধের পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন তিনি। আজ তিনিই উৎফুল্ল হলেন কর্ণের মতো বীরকে বন্ধুরূপে পেয়ে। উপহারস্বরূপ কর্ণকে অঙ্গরাজ্য উপহার দিলেন।
এরপর যথাসময়ে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হলেন। পাণ্ডবেরা তাঁদের মধুর ব্যবহার, ধীরতা, দয়া, সারল্য ইত্যাদি গুণে সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। বহু রাজ্য জয় করে বহুবিধ ধন এনে কুরুরাজ্যের উন্নতিতে মনোনিবেশ করলেন তাঁরা সকলেই। পাণ্ডবদের এহেন শ্রীবৃদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রের মোটেও ভালো ঠেকল না। কিন্তু নিজের এমন অসূয়াবিষয়ে তিনি বিদুর কিংবা ভীষ্মের সাথে পরামর্শ করতে পারছিলেন না। কারণ তাঁরা ছিলেন পাণ্ডবদের অনুকূলে। পাণ্ডবদের স্নেহ করতেন তাঁরা। তাই তিনি ডাকলেন কণিকনামের মন্ত্রীকে। কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরেই কণিকের কাছে নিজের অসূয়া অকপটে স্বীকার করলেন। কীভাবে পাণ্ডবদের দমিয়ে সে উপায় জানতে চাইলেন। কণিকও রাজার মন বুঝে কতকটা সদুপদেশের ছলে ঠেলে দিলেন অসততার পথে। দুষ্টের মন্দবুদ্ধিদাতা সাথীর অভাব হয় না। ধৃতরাষ্ট্রের ছিল অন্ধ পুত্রস্নেহ। কার্যাকার্যজ্ঞানরহিত হয়েছিলেন তিনি। তাই দুর্যোধন যখন শকুনি, দুঃশাসন, কর্ণ ইত্যাদির সাথে মিলিত হয়ে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করলেন, সায় দিলেন ধৃতরাষ্ট্র। তাঁর অবচেতন মন তখন নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে, দুর্যোধনকে কুরুরাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে দেখছিল যে!
হস্তিনাপুরের কিছুটা দূরে অবস্থিত বারণাবত নগরী। স্থির হল, কোনওভাবে পাণ্ডবদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেখানে পাঠানো হবে। দুর্যোধনের কুপরামর্শে ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে কয়েকজন মন্ত্রী পাণ্ডবদের বোঝালেন, বারণাবত নগরী কিছুদিনের জন্য বসবাসের অতি মনোরম স্থান। রাজধানী থেকে দূরে এমন অবকাশযাপন নিঃসন্দেহে পাণ্ডবদের আনন্দ দেবে। পাণ্ডবেরাও এমন অবকাশযাপনের সুযোগ পেয়ে উৎফুল্ল হলেন। পাণ্ডবদের জন্য যে গৃহ নির্মিত হল, দুরাত্মা দুর্যোধনের আদেশে পুরোচন নামক ব্যক্তি সেটিকে বিশেষভাবে তৈরি করল। সমস্তরকম দাহ্যবস্তু দিয়ে তৈরি এ গৃহে কোনও প্রকারে আগুন লাগলে পাণ্ডবেরা আর জীবিত থাকবেন না। কিন্তু রাখে হরি মারে কে! দুর্যোধনের এমন কুমন্ত্রণা বুঝতে পেরেছিলেন বুদ্ধিমান বিদুর। তিনি সাবধান করলেন যুধিষ্ঠির আর কুন্তীকে।
নির্দিষ্টদিনে সকল পুরবাসী ক্ষুণ্ণ মনে পাণ্ডবদের বিদায় করল। বারণাবতে পাণ্ডবদের বিশেষ সমাদর করল পুরোচন। দশদিন পাণ্ডবেরা এক বাড়িতে বাস করলেন। তারপর পুরোচনের ব্যবস্থাপনায় শিবভবন নামের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। বস্তুত পক্ষে এইটিই ছিল জতুগৃহ। বিদুরের সাবধানবাণী পাণ্ডবদের স্মরণে ছিল। কিন্তু সেকথা ঘুণাক্ষরে প্রকাশ করলেন না। অপূর্ব সুন্দর সে বাড়িটিতে প্রবেশ করামাত্রই দাহ্যবস্তুর গন্ধ আঘ্রাণ করতে সক্ষম হলেন তাঁরা। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে একমাত্র দৈব আর উপস্থিতবুদ্ধিই সহায় হতে পারে।
সন্তানতুল্য পাণ্ডবরা জীবিত থাকুক, এই ছিল বিদুরের আন্তরিক ইচ্ছা। এক খনককে তিনি প্রেরণ করলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। বিদুরের প্রেরিত সে খনক অতি গোপনে যুধিষ্ঠিরের আদেশে সে জতুগৃহে এক সুড়ঙ্গ তৈরি করল। এবার শুধু নির্দিষ্টদিনের অপেক্ষা। পুরোচন সে গৃহে অগ্নিসংযোগ করল যে রাতে, সে রাতে কুন্তীর গৃহে নিমন্ত্রিত ছিল অনেকে। সকলে ফিরে গেলেও আহারাদির পর ক্লান্ত শরীরে সেখানেই নিদ্রামগ্ন হয়েছিল এক ব্যাধপত্নী আর তার পাঁচ পুত্র। ঘুমের ঘোরেই মৃত্যু হল তাদের। মধ্যরাত্রে সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে পাণ্ডবেরা তখন গোপনে পথ চলেছেন। অনেকদূর চলতে হবে তাঁদের। এ পথের যে শেষ কোথায় তাও জানেন না তাঁরা।
এদিকে পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন ছিলেন সবচেয়ে বুদ্ধিমান, অধ্যবসায়ী। আর ভীমের ক্ষমতা ছিল সবচাইতে বেশি। ছেলেবেলায় ভীমের ছেলেমানুষি দুষ্টবুদ্ধিও প্রবল ছিল। ঈর্ষাবশত নয় কিন্তু স্বভাবগত চাপল্যহেতু প্রায়শই কৌরবভাইদের বিশেষ করে দুর্যোধনকে বেকায়দায় ফেলতেন ভীম। অন্যান্য ছেলেরা প্রবল ভীমকেই তাদের প্রধান বলে মেনে নিয়েছিল। মানতে পারছিলেন শুধু দুর্যোধন। যাঁর পিতা রাজ্যের রাজা, তিনি হয়তো নিজেকে সে রাজ্যের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে মনে করতেন। ভীমের এমন পরাক্রম তাঁর অসহনীয় বলে মনে হত। খেলাচ্ছলে এমন অপদস্থ হওয়া তিনি মেনে নিতে পারতেন না। যদিও কুরুবৃদ্ধেরা ভীম দুর্যোধনের এই ছেলেখেলা নজর করবার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ছেলেবেলায় এমন তো কত কী হয়ে থাকে। এরই অন্তরালে যে একজনের মনে ক্ষোভ, অসূয়ার আগুন ঘনীভূত হচ্ছে সে আর কেই-বা বুঝেছে? সেই ছোট্টটি থেকে এইভাবে ভীমসেনের বিরুদ্ধে, পাণ্ডবভাইদের বিরুদ্ধে হিংসার বীজ রোপিত হল দুর্যোধনের মনে। দুর্যোধন বুঝেছিলেন, একমাত্র অসদুপায়েই পাণ্ডবদের জব্দ করা সম্ভব।
ভীমসেন ছিলেন অত্যন্ত ভোজনরসিক। দুর্যোধনের ঈর্ষাকাতর মন এমনই এক ছিদ্রের অনুসন্ধান করছিল। গঙ্গার তীরে তিনি বিলাসবহুল সুন্দর সুন্দর তাঁবু তৈরি করালেন, যার কিছুটা থাকল জলে আর কিছুটার অবস্থান স্থলে। পাকপটু ব্যক্তিরা দুর্যোধনের আদেশে সেখানে অপূর্ব ভোজ্যদ্রব্য তৈরি করতে লাগল। এরপর সমস্ত ব্যবস্থা হলে তিনি পাণ্ডবদের আমন্ত্রণ করে সেখানে নিয়ে উপস্থিত হলেন। উদ্দেশ্য প্রমোদবিহার। সরলমতি পাণ্ডবেরা ঘুণাক্ষরেও দুর্যোধনের দুরভিসন্ধির আঁচ পেলেন না। দুর্যোধনের দুর্জনজনোচিত মধুর বাক্যে তাঁরা আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, পটমণ্ডপের মনোরম পরিবেশে সুখে জলবিহার করলেন আর শেষে বন্ধু ভেবে দুর্যোধনের দেওয়া খাদ্যবস্তু গ্রহণ করলেন। ভীমকেই বিশেষভাবে শত্রু বলে মনে করতেন দুর্যোধন। তাই তাঁর ভোজ্যে নিজেই বিষ মিশিয়েছিলেন। নিজে হাতে করে বিষমিশ্রিত সুস্বাদু ভোজ্য খাইয়ে দিলেন ভীমসেনকে। এ এমন বিষ যা অতি ধীরে সংজ্ঞাহীন করে। ভোজনাদির পরেও পাণ্ডব আর কৌরবেরা পুনরায় একত্র জলবিহার করলেন। রাত্রে অতিপরিশ্রান্ত ভীমসেন কতকটা বিষের প্রভাবেই ধীরে ধীরে আরও ক্লান্ত হয়ে অন্যান্য কুরুবালকের সাথে যেতে সমর্থ হলেন না। পটমণ্ডপেই নিদ্রিত হয়ে পড়লেন তিনি। এমন এক সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন দুর্যোধন। ভীমসেনকে লতা দিয়ে বেঁধে জলে ফেলে দিলেন। নিজের পরাক্রম প্রকাশের কোনও সুযোগই পেলেন না ভীম। সংজ্ঞাহীন হয়ে জলে পড়ে অচিরেই ভীমের মৃত্যু হবে এই ভেবে আনন্দিতচিত্তে দুর্যোধন ফিরে গেলেন স্বস্থানে। যুধিষ্ঠিরাদি অন্য পাণ্ডবদের অনিষ্টচিন্তা করলেও দুর্যোধনের শত্রুতা ছিল মূলত ভীমের সাথে। ভীমহীন পাণ্ডবদের তিনি তেমন গুরুত্ব দিতে চাননি। ভীমসেনকে খুঁজে না পেয়ে বিষণ্ণচিত্ত পাণ্ডবেরা আর দুর্যোধনসহ অপরাপর কৌরবেরা ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে।
এদিকে সংজ্ঞাহীন ভীম জলের নীচে যেখানে পড়েছিলেন, সেটা ছিল নাগলোক। আর নাগরাজ বাসুকী ছিলেন ভীমের মাতামহ রাজা কুন্তীভোজের মাতামহ। ভীমের পরিচয় পেয়ে খুবই আনন্দিত হলেন বাসুকী। নাগেদের প্রভাবে ভীমের শরীর বিষমুক্ত হল। নাগলোকে বিপুল আপ্যায়ন পেয়ে ভীম ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে। যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবেরা ভীমের আকস্মিক অন্তর্ধানে হতচকিত হয়ে ছিলেন। তাঁর ফিরে আসাতে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন আর সমস্ত ঘটনা অনুপুঙ্খ শুনে দুর্যোধনের কুকীর্তি বিষয়ে নিশ্চিত হলেন। তাঁরা পরস্পরে স্থির করলেন, ভবিষ্যতে এমন বিপদ আবার আসতে পারে তাই সাবধান হওয়া প্রয়োজন। তবে সমস্ত ঘটনা তাঁরা গোপন রাখলেন। তাঁদের একমাত্র সহায় ছিলেন পিতৃব্য বিদুর। পিতৃহারা পাণ্ডবদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন বিদুর আর সর্বদা সুপরামর্শ দিতেন।
পিতামহ ভীষ্ম আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় কৌরবপাণ্ডবেরা কৃপাচার্য আর দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করলেন। এতকাল সকলে ভীমের পরাক্রমের সাথে পরিচিত ছিল। এবার সকলের সম্মুখে প্রকাশিত হল তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের অস্ত্রবিদ্যায় নৈপুণ্য। তারপর শিক্ষার শেষে কুরুবৃদ্ধদের আগ্রহে এক শিক্ষাপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হল। সে রঙ্গভূমিতে কুরুবালকদের বিশেষত অর্জুনের কুশলতায় সকলে মুগ্ধ হল। সেই রঙ্গভূমিতেই আকস্মিক আবির্ভাব ঘটল বীর কর্ণের, পাণ্ডবমাতা কুন্তীর ত্যক্ত কানীনপুত্রের। সুতের গৃহে লালিত হলেও ক্ষত্রিয়ের তেজ ধারণ করছেন তিনি। শিক্ষা প্রদর্শনীতে পরাক্রমী অর্জুনের প্রতিযোগীরূপেই যেন স্পর্ধাভরে উপস্থিত হলেন। প্রদর্শন করলেন নিজের অস্ত্রবিদ্যা। বিস্ময়ে বিমূঢ় হল উপস্থিত জনগণ। কেউ অর্জুনের কেউ বা কর্ণের জয়ধ্বনি করতে লাগল। অর্জুনের নৈপুণ্যে ভীত ছিলেন যে দুর্যোধন, তিনি কর্ণকে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন। নিজেই এগিয়ে এসে বন্ধুরূপে বরণ করলেন। ভীমসেনকে বধের পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন তিনি। আজ তিনিই উৎফুল্ল হলেন কর্ণের মতো বীরকে বন্ধুরূপে পেয়ে। উপহারস্বরূপ কর্ণকে অঙ্গরাজ্য উপহার দিলেন।
এরপর যথাসময়ে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হলেন। পাণ্ডবেরা তাঁদের মধুর ব্যবহার, ধীরতা, দয়া, সারল্য ইত্যাদি গুণে সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। বহু রাজ্য জয় করে বহুবিধ ধন এনে কুরুরাজ্যের উন্নতিতে মনোনিবেশ করলেন তাঁরা সকলেই। পাণ্ডবদের এহেন শ্রীবৃদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রের মোটেও ভালো ঠেকল না। কিন্তু নিজের এমন অসূয়াবিষয়ে তিনি বিদুর কিংবা ভীষ্মের সাথে পরামর্শ করতে পারছিলেন না। কারণ তাঁরা ছিলেন পাণ্ডবদের অনুকূলে। পাণ্ডবদের স্নেহ করতেন তাঁরা। তাই তিনি ডাকলেন কণিকনামের মন্ত্রীকে। কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরেই কণিকের কাছে নিজের অসূয়া অকপটে স্বীকার করলেন। কীভাবে পাণ্ডবদের দমিয়ে সে উপায় জানতে চাইলেন। কণিকও রাজার মন বুঝে কতকটা সদুপদেশের ছলে ঠেলে দিলেন অসততার পথে। দুষ্টের মন্দবুদ্ধিদাতা সাথীর অভাব হয় না। ধৃতরাষ্ট্রের ছিল অন্ধ পুত্রস্নেহ। কার্যাকার্যজ্ঞানরহিত হয়েছিলেন তিনি। তাই দুর্যোধন যখন শকুনি, দুঃশাসন, কর্ণ ইত্যাদির সাথে মিলিত হয়ে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করলেন, সায় দিলেন ধৃতরাষ্ট্র। তাঁর অবচেতন মন তখন নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে, দুর্যোধনকে কুরুরাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে দেখছিল যে!
হস্তিনাপুরের কিছুটা দূরে অবস্থিত বারণাবত নগরী। স্থির হল, কোনওভাবে পাণ্ডবদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেখানে পাঠানো হবে। দুর্যোধনের কুপরামর্শে ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে কয়েকজন মন্ত্রী পাণ্ডবদের বোঝালেন, বারণাবত নগরী কিছুদিনের জন্য বসবাসের অতি মনোরম স্থান। রাজধানী থেকে দূরে এমন অবকাশযাপন নিঃসন্দেহে পাণ্ডবদের আনন্দ দেবে। পাণ্ডবেরাও এমন অবকাশযাপনের সুযোগ পেয়ে উৎফুল্ল হলেন। পাণ্ডবদের জন্য যে গৃহ নির্মিত হল, দুরাত্মা দুর্যোধনের আদেশে পুরোচন নামক ব্যক্তি সেটিকে বিশেষভাবে তৈরি করল। সমস্তরকম দাহ্যবস্তু দিয়ে তৈরি এ গৃহে কোনও প্রকারে আগুন লাগলে পাণ্ডবেরা আর জীবিত থাকবেন না। কিন্তু রাখে হরি মারে কে! দুর্যোধনের এমন কুমন্ত্রণা বুঝতে পেরেছিলেন বুদ্ধিমান বিদুর। তিনি সাবধান করলেন যুধিষ্ঠির আর কুন্তীকে।
নির্দিষ্টদিনে সকল পুরবাসী ক্ষুণ্ণ মনে পাণ্ডবদের বিদায় করল। বারণাবতে পাণ্ডবদের বিশেষ সমাদর করল পুরোচন। দশদিন পাণ্ডবেরা এক বাড়িতে বাস করলেন। তারপর পুরোচনের ব্যবস্থাপনায় শিবভবন নামের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। বস্তুত পক্ষে এইটিই ছিল জতুগৃহ। বিদুরের সাবধানবাণী পাণ্ডবদের স্মরণে ছিল। কিন্তু সেকথা ঘুণাক্ষরে প্রকাশ করলেন না। অপূর্ব সুন্দর সে বাড়িটিতে প্রবেশ করামাত্রই দাহ্যবস্তুর গন্ধ আঘ্রাণ করতে সক্ষম হলেন তাঁরা। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে একমাত্র দৈব আর উপস্থিতবুদ্ধিই সহায় হতে পারে।
সন্তানতুল্য পাণ্ডবরা জীবিত থাকুক, এই ছিল বিদুরের আন্তরিক ইচ্ছা। এক খনককে তিনি প্রেরণ করলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। বিদুরের প্রেরিত সে খনক অতি গোপনে যুধিষ্ঠিরের আদেশে সে জতুগৃহে এক সুড়ঙ্গ তৈরি করল। এবার শুধু নির্দিষ্টদিনের অপেক্ষা। পুরোচন সে গৃহে অগ্নিসংযোগ করল যে রাতে, সে রাতে কুন্তীর গৃহে নিমন্ত্রিত ছিল অনেকে। সকলে ফিরে গেলেও আহারাদির পর ক্লান্ত শরীরে সেখানেই নিদ্রামগ্ন হয়েছিল এক ব্যাধপত্নী আর তার পাঁচ পুত্র। ঘুমের ঘোরেই মৃত্যু হল তাদের। মধ্যরাত্রে সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে পাণ্ডবেরা তখন গোপনে পথ চলেছেন। অনেকদূর চলতে হবে তাঁদের। এ পথের যে শেষ কোথায় তাও জানেন না তাঁরা।