বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

মহাভারতের চরিত্ররা ভালোলাগা-মন্দলাগা দুঃখসুখ জীবনের জটিলতা সাফল্য ব্যর্থতা নিয়ে যত এগিয়েছে তত তারা আমাদের আরও কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে। আর সেই মানুষদের অতিমানবীয় গুণ আবার কখনও নীচতা ধরা পড়েছে চোখে আবার তেমনি চরিত্রগুলোর পরতে পরতে যে রহস্যময়তা রয়েছে তাও দৃষ্টি এড়ায়নি। আর সবে মিলেই তো হয়ে উঠেছে আরও প্রাণের, কাছের। কৃপাচার্য আর দ্রোণাচার্য, উভয়ের সম্পর্ক শ্যালক ভগিনীপতির আবার দুজনেই কৌরব আর পাণ্ডবভাইদের আচার্যও বটে। সেই অর্থে দুজনেই আত্মীয় আবার কুরুপাণ্ডবদের জীবন ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে দুজনেরই জীবন। সবচাইতে আশ্চর্যের কথা হল উভয়ের জন্মের ক্ষেত্রেই রয়েছে রহস্য।

প্রথমেই কৃপাচার্যের প্রসঙ্গে কথা হোক। রুদ্রের অংশে জন্ম হয় কৃপাচার্যের। মহর্ষি গৌতমের পুত্র ছিলেন শরদ্বান্‍। শরের প্রতি তাঁর সহজাত প্রীতি ছিল। বরং পড়াশোনায় তাঁর মন ছিল না। সহপাঠীদের যখন পড়াশোনাই ধ্যানজ্ঞান ছিল, তখন শরদ্বানের অস্ত্রশিক্ষাই ছিল তপস্যা। তাঁর এই দৃঢ়ব্রত দেবরাজ ইন্দ্রকেও চমকিত করেছিল। ইন্দ্রের মনে হল এ কঠোর তপস্যা তাঁর ইন্দ্রত্ব পদের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। শরদ্বানের তপোভঙ্গের জন্য জানপদী নামের এক মনোমোহিনী অপ্সরাকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর কাছে। জানপদী ছিল অসামান্য সুন্দরী। একবস্ত্রা সুন্দরীকে দেখে অত্যন্ত সংযমী শরদ্বানের মনোনিবেশ ভঙ্গ হল। বিকার শুরু হল তাঁর। সে বিকারে তাঁর শুক্রস্খলন হল। তিনি তাঁর দীর্ঘজীবনের সঙ্গী ধনু, বাণ আর তপস্যার সঙ্গী কৃষ্ণাজিনখানি ফেলে রেখেই সে আশ্রম ত্যাগ করে অপ্সরার কাছে গেলেন। ইন্দ্রের উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হল। শরদ্বানের সেই শুক্র শরনামের তীক্ষ্ণ তৃণগুচ্ছের ওপর পড়ে দ্বিধাবিভক্ত হল। সেই শুক্র হতেই জন্ম নিল এক কন্যা আর এক পুত্র।

শরদ্বানের সেই আশ্রমের কাছে রাজা শান্তনু কোনও একদিন মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন। দৈববশে পরিত্যক্ত সেই পুত্রকন্যা দুটি রাজার এক সৈন্যের চোখে পড়ল। রাজা শান্তনু আশ্রমে এমন ফুটফুটে দুটি শিশুকে আর তাদের কাছেই পরিত্যক্ত ধনু বাণ আর কৃষ্ণাজিন দেখে কল্পনা করলেন নিজের মনেই৷ নিশ্চয়ই শিশুদুটি কোনও ধনুর্বিদ্যায় পারঙ্গম ব্রাহ্মণের। রাজা দয়াপরবশ হয়ে তাদের নিয়ে এলেন নিজের প্রাসাদে। তাদের সমস্ত সংস্কার করালেন এবং কৃপা করে বড় করে তুলছেন৷ তাদের এই কথা মনে করে ছেলেমেয়ে দুটির নামকরণ করলেন কৃপ আর কৃপী। এদিকে শরদ্বান্‍ তপোবলে এই সমস্ত কথা জানতে পেরে নিজের সন্তানদের খোঁজে রাজা শান্তনুর রাজপ্রাসাদে এসে নিজের পরিচয় দিলেন। শান্তনুর প্রাসাদেই অধিষ্ঠান করে নিজপুত্রকে ধনুর্বেদ আর নানানরকম অস্ত্রশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুললেন। শরবিদ্যায় ব্যুত্প্ন্ন এমন পিতা যাঁর, কঠোর তপস্যায় ধনুর্বেদ যাঁর অধিগত, তাঁর পুত্র সযত্নশস্ত্রপাঠে অচিরেই আচার্য হয়ে উঠবেন, এতে আর আশ্চর্য কী! কৌরবপাণ্ডবদের অভিভাবকেরা কৃপকেই পুত্রদের আচার্য হিসেবে নিয়োগ করলেন। সেইসঙ্গে শস্ত্রপাঠে তাদের সঙ্গী হল নানা দেশ থেকে আগত রাজপুত্ররাও। কালে কালে কৃপাচার্যের শিক্ষায় এদের প্রত্যেকেই অস্ত্রজ্ঞ হয়ে উঠল।

শস্ত্রশিক্ষায় প্রাথমিক পাঠ তো নেওয়া হল কৃপাচার্যের কাছে। এদিকে তীক্ষ্ণবুদ্ধি বিচক্ষণ ভীষ্মের পৌত্র কৌরবপাণ্ডবগণকে বিশেষ অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া জরুরি। কুরুদেশের ভবিষ্যৎ তো এরাই। তাই এরা অস্ত্রশিক্ষার বিশেষবিদ্যা অধিগত করে অজেয় হয়ে উঠুক এই ছিল তাঁর অভিপ্রায়। রাজ্যের বয়োজ্যেষ্ঠ আচার্যদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন তিনি। কে আছেন এমন বিশেষ বুদ্ধিমান, উদারচেতা, অস্ত্রে কার এমন বিশেষ ব্যুত্পেত্তি আছে, যিনি প্রবলপ্রতাপ কুরুবালকদের উপযুক্ত আচার্য হতে পারেন, তাদের অস্ত্রবিদ্যাদান করতে পারেন, যাঁর কাছে বলবান্‍ কুরুরাজপুত্রদের সমর্পণ করা যায় নিশ্চিন্তে! কুরুরাজ্যের বয়োজ্যেষ্ঠ আচার্যেরা উপদেশ দিলেন পিতামহ ভীষ্মকে, দ্রোণাচার্যই একাজে উপযুক্ত। ভীষ্ম খুশি হলেন এমন পরামর্শ পেয়ে। দ্রোণাচার্যও এমন প্রবলপ্রতাপ কুরুবালকদের শিষ্যরূপে পেয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন।

এদিকে সুতের বলে যাওয়া আখ্যান শুনতে শুনতে শ্রোতৃবর্গ বিভোর। প্রশ্ন করতেও যেন তাঁরা ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু জনমেজয় ভোলেননি। কেমন করেই বা ভুলবেন তিনি। তাঁকে যে জেনে নিতে হবে অনেককিছু। তাঁর পিতৃপুরুষের কথা, বংশের কথা। তিনি প্রশ্ন করেন, কে এই দ্রোণাচার্য? কীভাবেই বা তাঁর জন্ম হল? তিনি কীভাবে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করলেন?

সুত বৈশম্পায়ন বলে চলেন দ্রোণের কথা। ঋষি ভরদ্বাজের পুত্র হলেন দ্রোণ। অযোনিসম্ভবা তিনি। ঋষি ভরদ্বাজ কোনও এক সময়ে তাঁর আশ্রমের অপরাপর ঋষিদের সঙ্গে স্নান করতে নদীতে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি অপরূপরূপযৌবনা অপ্সরা ঘৃতাচীকে স্নানান্তে বস্ত্রপরিবর্তন করতে দেখেন। ঘৃতাচীর রূপে কামার্ত হয়ে ওঠেন ভরদ্বাজ। তাঁকে দেখে চিত্তবৈকল্য হয় এবং সেই নিমিত্ত শুক্রস্খলন হয়। ঋষি সেই শুক্র স্নানের সময় আনীত হোমকলশে স্থাপন করেন। দ্রোণ অথবা কলশ আবার কেউ বলেন দ্রোণী অথবা ডোঙায় সেই শুক্র সংরক্ষিত হয়েছিল। সেই শুক্র হতে কলশের মধ্যেই দ্রোণ জন্মগ্রহণ করেন। অযোনিসম্ভবা দ্রোণ। কলশে জন্ম তাঁর। হয়তো বা আজকের দিনের নলজাতক শিশুর মতোই জন্ম হয়েছিল তাঁর! পিতা ছিলেন তাঁর সর্ববিদ্যাবিশারদ। সন্তানের এমন অভিনব জন্ম, সে কি ঋষির বিশেষ জ্ঞান ছাড়া সম্ভব? ঋষি ভরদ্বাজ পুত্রকে একদিকে যেমন উজাড় করে দিলেন মায়ের স্নেহ অন্যদিকে পিতার শাসনও বড় কম ছিল না। ছেলেকে শেখালেন বেদবেদাঙ্গাদি শাস্ত্র। এত শিষ্য তাঁর। আশ্রমে তারা থাকে, শেখে নানান বিদ্যা। মনে পড়ে ঋষির অগ্নিবেশ্য নামের সেই শিষ্যের কথা। নিজে যত্ন করে তাকে তিনি অগ্নিবিদ্যা শিখিয়েছিলেন। ঋষির মনে হল, বুদ্ধিমান পুত্র তাঁর। এ অগ্নিবিদ্যাও পুত্রের অধিগত হোক, এই ঋষির ইচ্ছা। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। শিষ্য অগ্নিবেশ্যকে পুত্রের আচার্যরূপে নিয়োগ করলেন ভরদ্বাজ। অগ্নিবেশ্যমুনির কাছে দ্রোণ শস্ত্রবিদ্যাশিক্ষা করেন। শস্ত্রশাস্ত্রে অভিজ্ঞ দ্রোণের এই উপযুক্ত সময় সংসারে প্রবেশের। কৃপাচার্যের ভগিনী কৃপীর সঙ্গে বিবাহ হল তাঁর। এরপর পিতার আশ্রমে থেকে পিতা আর তাঁর শিষ্যদের কাছ থেকে শিক্ষালাভের পরেও দ্রোণ আরও বহুতর জ্ঞানলাভের আশায় পরশুরামের কাছে গিয়ে উপস্থিত হন। সর্বশস্ত্র তথা শাস্ত্রে ব্যুত্পেন্ন পরশুরাম সেই সময় নিজের সব ধন দান করছিলেন। দ্রোণের পার্থিব স্বর্ণরৌপ্যাদিধনে কোনও মোহ ছিল না। তাঁর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে দ্রোণ বলেন পরশুরাম যে সমস্ত শস্ত্রপ্রয়োগের গুপ্তবিদ্যা জানেন, সেসমস্ত তিনি শিখতে চান। দানব্রতী পরশুরাম তাঁকে দিলেন নিজের অস্ত্রগুলো আর শিখিয়ে দিলেন তাদের প্রয়োগের গুপ্তবিদ্যা। ধনুর্বেদে পারঙ্গম হলেন দ্রোণ। উপযুক্ত হলেন আচার্য হবার। এরপর দ্রোণ কীভাবে কোন প্রেক্ষিতে হস্তিনাপুরে এসে উপস্থিত হলেন আর কীভাবেই বা কৌরবপাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষাগুরু নির্বাচিত হলেন সে আখ্যানের কথা বরং অন্যত্র হবে।

Skip to content