শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

মহাভারতের কথা, কৌরবপাণ্ডবদের আখ্যান। সত্যবতীর এক পৌত্র পাণ্ডুর ছেলেরা পাণ্ডব বলেই পরিচিত ছিল আর অপর পৌত্র ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের লোকে কৌরব সম্বোধন করত। পাণ্ডু কতকটা অকালেই মৃত্যুবরণ করলে পাণ্ডুর দ্বিতীয়া স্ত্রী মাদ্রী সহমৃতা হলেন। তাঁদের অবর্তমানে পাণ্ডবভাইদের অভিভাবক হলেন কুন্তী। পাণ্ডবজননীর এ ছিল বড় দায়িত্ব। কুরুবংশের বয়োজ্যেষ্ঠদের পরামর্শদাতা হিসেবে কাছে পেলেও পাঁচ-পাঁচজন সন্তানকে একলা বড় করে তোলা তো আর সামান্য কাজ নয়! তার মধ্যে দুটি তো আবার সপত্নী মাদ্রীর সন্তান। যদিও সে দুটিতেও কুন্তী ছাড়া যেন আর কাউকেই জানে না আজ। এই পাঁচ সন্তানই তাঁর জীবন। তবে মনে পড়ে থেকে থেকেই সেই ছেলের কথা, মেয়েবেলায় যে এসেছিল ঘর আলো করে। নাড়ি-ছেঁড়া সে ধনকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল অনেক গোপন চোখের জলের বিনিময়ে। সে আজ কোথায়, কেমনই-বা আছে কে জানে? মেয়েবেলার কথা কেই-বা অত মনে রাখে! কেই-বা জানতে চায়! পাণ্ডবজননী তিনি, এই তাঁর আজকের পরিচয়। তবু কি ভোলা যায়? ভুলতে পারেন না তিনি, লালন করে চলেন সে স্মৃতি অতি সংগোপনে মনে মনে।

জন্মদাতা পিতা নাম দিয়েছিলেন পৃথা। সে নাম আর কজনই-বা জানে! কুন্তী নামখানা তো পালকপিতার দেওয়া নাম। কীভাবে শূররাজার গৃহে জন্মেও তাঁর ঘরবদল হল, এসব গল্প জেনেছেন তিনি বড় হয়ে। অবশ্য পালকপিতা কুন্তীভোজের অতি স্নেহচ্ছায়াতেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। যদুবংশের রাজা শূর আর কুন্তীভোজরাজা ছিলেন দুই তুতোভাই আবার দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধুও বটে। বড় ভালোবাসতেন দুজন দুজনকে। নতুবা কতটা বন্ধু হলে পর চাইবামাত্র নিঃসন্তান বন্ধুর হাতে নিজের প্রথম সন্তানকে তুলে দেওয়া যায়! যদুবংশে জন্মের সূত্রে কুন্তী ছিলেন কৃষ্ণের পিসি।

এদিকে নিঃসন্তান কুন্তীভোজরাজা আর পত্নীর ঘর ভরে উঠল। তাঁদের ঘর আলো করে এল ফুটফুটে কন্যা। বড় হয়ে উঠতে লাগল সে মেয়ে আর রাজারানিও সুসংস্কারে লালিত করতে লাগলেন। রোজের দেবসেবা আর অতিথিসেবার ভার ছিল কুন্তীর ওপর। সে কাজ তিনি নিষ্ঠাভরেই করতেন। একদিন রাজদরবারে এলেন এক ব্রাহ্মণ। কানাঘুষোয় জানতে পারলেন কুন্তী, ইনি যে-সে অতিথি নন, বরং এই ব্রাহ্মণ খুবই কোপনস্বভাবের আবার ধর্মের গূঢ়তত্ত্বও তাঁর অধিগত। দুর্বাসা নাকি তাঁর নাম। নিজকাজে একনিষ্ঠ কুন্তী খুব যত্ন করে পরিচর্যা করলেন তাঁর। দুর্বাসামুনিকে তুষ্ট করা তো বড় সহজ কাজ নয়! কুন্তীর শুশ্রূষায় অত্যন্ত খুশি হলেন দুর্বাসা। দুর্বাসা ছিলেন ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ। তিনি জানতেন কুন্তীর সন্তানজন্মে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কিন্তু সে কথা তিনি কুন্তীকে জানালেন না। কুন্তীকে শিখিয়ে গেলেন পুরুষাকর্ষক মন্ত্র। বলে গেলেন, এ মন্ত্রবলে নিজের মনোমতো দেবতাকে আকর্ষণ করতে পারবেন কুন্তী। দেবতার সঙ্গে মিলনে তাঁর সন্তানের জননীও হতে পারবেন তিনি।

মন্ত্রবলে কাছে পেতে পারেন পছন্দের দেবতাকে এমন আশীর্বাদ শুনে, এমন মন্ত্র জেনে কুমারী কুন্তীর মনে জেগে উঠল নিষিদ্ধ উত্সা হ। মন্ত্রের ক্ষমতা সে মুহূর্তে পরীক্ষা করবার জন্য উত্সুধক হয়ে উঠলেন তিনি। যাঁকে রোজ দেখেন বহু দূর থেকে যাঁর ছন্দেই ছন্দময় গোটা জীবকুল, তাঁকে কাছ থেকে দেখতে সাধ জাগল তাঁর। সদ্যশেখা মন্ত্র দিয়ে সেই প্রত্যক্ষদেব আদিত্যকেই আহ্বান করে বসলেন তিনি। দুর্বাসামুনির দেওয়া মন্ত্র তো আর যে-সে মন্ত্র নয়! দেবতা এলেন মানবী কুন্তীর কাছে। মন্ত্রের ফল এভাবে ফলতে দেখে যুগপৎ বিস্মিত আর ভীত হলেন কুন্তী। অনিন্দ্যসুন্দরী কুন্তী করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন দেবতার কাছে। বললেন, ছেলেমানুষি করে মন্ত্রের ক্ষমতা পরখ করতে গিয়ে এমন এক অনর্থ ঘটিয়ে ফেলেছেন তিনি। দেবতা আশ্বস্ত করলেন তাঁকে। সহজ করে তুললেন তাঁর মনকে। মিলন হল তাঁদের। যথাসময়ে জন্ম নিল এক অপূর্ব পুত্র। জন্ম থেকেই দেবপুত্রের অঙ্গে ছিল কবচ আর কুণ্ডল।

এদিকে দেবতার আশীর্বাদে কুন্তী আবার কন্যাত্ব ফিরে পেলেন। কিন্তু তাঁর মনকে ঘিরে রইল এক অন্ধকার। এমন অপূর্ব সন্তান তাঁর। কিন্তু এ ছেলেকে নিয়ে কী করবেন? মাতাপিতার সম্মুখীন হবেন কীভাবে? লোকে কী বলবে? কীভাবেই-বা এর জন্মবৃত্তান্ত লোকসমক্ষে প্রকাশ করবেন? আর তাঁর মেয়েবেলার বন্ধুরা? তারা কি তাঁকে ছিছিক্কার করবে না এমন ঘটনা শুনে? সেসব মনে করে আঁতকে ওঠেন তিনি। কার সঙ্গেই বা হিতাহিতবিষয়ে আলোচনা করবেন? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবতে ভাবতে সমস্ত দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে আসেন অবশেষে। নিজের মনকে শক্ত করেন। মনে মনে ভাবেন দেবপুত্র যে, দৈবই তার বড় সহায় হবে। বুকে পাথরখণ্ড চাপিয়ে, চোখের জল সংবরণ করে একটা বড় পাত্রে ছেলেকে শুইয়ে দেন আর তারপর সেই পাত্র ভাসিয়ে দেন নদীর জলে। পাত্র এগিয়ে চলে স্রোতের মুখে আর এগিয়ে চলে মায়ের আদরের পুত্রের ভাগ্য কোনও এক নাম-না-জানা কুলের দিকে।

Skip to content