সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ক্যামেরা বন্দি সেই দৃশ্য।

সিনেমার জন্ম উনিশ শতকের শেষের দিকে। বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও যন্ত্র যা চলাচলের ধারণা সৃষ্টি করে তারই উত্তরাধিকারী হিসেবে দেখা যেতে পারে এই চলচ্চিত্রের জগতকে। ছায়া প্রদর্শনী, ক্যালিডোস্কোপ, পিপ শো (ছোট গর্তের মাধ্যমে দৃশ্য প্রদর্শনী), যা স্থির চিত্রমালা থেকে চলনের এক বিভ্রম সৃষ্টি করে—এই সবই আজকের চলচ্চিত্রের পূর্বসূরি। তবে বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন ধীর গতিতে এগিয়ে চলার বিভ্রম তৈরি করা আর দৃশ্যপটের অবিচ্ছিন্ন চলাচলের মোহ সৃষ্টি করা—এই দুইয়ের মধ্যে রয়েছে এক বড় পার্থক্য। চলচ্চিত্র ব্যতীত আর কোনও যাদু লণ্ঠন বা পিপ শো এই একটানা গতিবিধির মায়া সৃষ্টি করতে অক্ষম। চলচ্চিত্রের জগৎ এখানেই অনন্য।

তাহলে চলচ্চিত্রের উৎপত্তি হল কীভাবে?
এডওয়ার্ড মাইব্রিজ এবং তার ঘোড়দৌড় নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণের মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ঘটনাটি এইরকম ১৮৬২-১৮৬৩ ক্যালিফর্নিয়ার গভর্নর হিসেবে লেল্যান্ড স্ট্যানফর্ড নিযুক্ত হন। তাঁর মাথায় একদিন এক অদ্ভুত প্রশ্ন জাগে। ঘোড়া যখন টগবগিয়ে ছোটে এরকম কি কোনও মহূর্ত থাকে যখন তার চারটি পা-ই মাটি ছোঁয় না? মানে চারটি পা-ই হাওয়ায় থাকে? তিনি তৎক্ষণাৎ ক্যালিফর্নিয়ার বিখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী মাইব্রিজকে কাজে লাগান এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে।
মাইব্রিজ এই জটিল সমস্যার সমাধান করার এক অভিনব উপায় বের করেন। তিনি একটি রেসট্র্যাকে অসংখ্য সুতো বাঁধেন। ট্র্যাকের বাঁ দিক থেকে ডান দিক অবধি। সেই ট্র্যাকেই ছোটানো হয় ঘোড়া। প্রতিটি সুতোর শেষ অংশটি জুড়ে রাখা হয় একটি ক্যামেরার সঙ্গে। এই ভাবে প্রতিটি সুতোর সঙ্গে থাকে একটি করে ক্যামেরার যোগ। ঘোড়া যেই ছুটতে শুরু করে, সুতোগুলিতে ঘোড়ার পা লেগে ক্যামেরার শাটার পড়তে শুরু করে। এ ভাবে চোখের নিমেষে ওঠে অসংখ্য ছবি। তফাৎ একটাই। মাইব্রিজের হাতের জায়গায় ছবি এবার তোলে ঘোড়ার পায়ের ক্ষুর। যে ছায়াচিত্রমালার সৃষ্টি হয়, তা স্ট্যানফর্ডের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঘোড়ার চারটি পা এক সময় সত্যিই মাটি থেকে একটু ওঠে একই সঙ্গে।

মাইব্রিজ সেদিন না জেনেই রেসট্র্যাকটিকে ছোট একটি চলচ্চিত্রের স্টুডিয়োতে পরিণত করেছিলেন। নিজের চাহিদার ছবি পাওয়া বা সৃষ্টি করার জন্যে নিজের পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে অনুকূল করে তোলাই চলচ্চিত্র সৃষ্টির অন্যতম শর্ত। প্রযুক্তির সঙ্গে বিষয় ও চরিত্র বিন্যাসই সম্ভব করল এই প্রথম চলমান ছায়াচিত্র, যা পরবর্তীকালে জন্ম দিল সিনেমার। মাইব্রিজ পারলেন চলচ্চিত্রে গল্প বলার প্রাথমিক শর্ত পূরণ করতে—স্থান ও কালে গতির উদ্ঘাটন ঘটাতে। মাইব্রিজের একটি ঘোড়ার ছবি একটি স্থির মুহূর্ত সৃষ্টি করে। কিন্তু ওই ঘোড়ার ৬টি ছবি যখন অত্যন্ত দ্রুগ গতিতে একে অপরকে অনুসরণ করে, তখন সেটি একটি ক্রিয়ায় পরিণত হয়। একটি ঘটনায় পরিণত হয়।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৭: স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ‘সাগরিকা’

একটি উচ্চ গতির ক্যামেরা যখন পর পর কিছু ছবি বা ফ্রেম (সিনেমার ক্ষেত্রে সাধারণত এক সেকেন্ডে ২৪টি ফ্রেম) ক্যামেরা বন্দি করে, আর সেই ফ্রেম যদি সিনেমার পর্দায় একই গতিতে (২৪ ফ্রেম পার সেকেন্ড বা ২৪ এফপিএস) দেখানো হয়, তাহলে দর্শকের চোখে কোনও ফ্রেমই আলাদা করে ধরা দেয় না। সবকটি ফ্রেম মিলিয়ে এক নিরবচ্ছিন্ন গতির ভ্রম তৈরি করে। কারণ আমাদের রেটিনা আমাদের সামনে থেকে সরে যাওয়া বস্তু বা দৃশ্যের ছাপ বহন করে আরও ১/১৬তম সেকেন্ডের জন্যে। এর ফলে দুটি ছবি খুব দ্রুত পরস্পরকে অনুধাবন করলে, এই দুই ছবির মাঝের ব্যবধান বোঝার ক্ষমতা মানুষের চোখে নেই।

বিজ্ঞানীরা এখনও মানুষের চোখের এই জড়তার রহস্য ভেদ করে উঠতে পারেনি। দর্শকের চোখের এই অদ্ভুত বিশিষ্টতার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘পারসিসটেন্স অফ ভিশন’ (বাংলায় অনুবাদ করলে ‘দৃষ্টি অধ্যবসায়’)। এখন যাকে বলা হয় ‘পারসিসটেন্ট আফটার ইমেজেস’ (বাংলায় ‘দৃশ্যোত্তর প্রলম্বন’ বলা যেতে পারে)। তাহলে চলচ্চিত্র জগতের উদ্ঘাটন সম্ভব হল দুটি ঘটনার সমন্বয়ে—স্থিরচিত্রে গতি আনার প্র‌যুক্তি এবং দর্শকের দৃষ্টির অধ্যবসায় (বা জড়তা)। আমরা অসংখ্য স্থায়ী চিত্রমালায় গতি দেখতে পাই, আর আমাদের মস্তিষ্ক সমানে এই চিত্রগুচ্ছের মাঝের শূন্যস্থান পূরণ করে চলে। এই ভাবেই সৃষ্টি হয় চলচ্চিত্রের পটভূমি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৭: দু’ মাস আগের এক সন্ধ্যা

দশভুজা: তিনি ‘অরণ্যের বিশ্বকোষ’, ৭৯ বছর বয়সেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তুলসী

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৩: বিবাহ প্রতিষ্ঠানে অবিশ্বাস কিংবা সম্পর্কে দাঁড়ি

মেরি অ্যান দোয়েন এই চলনের মায়া সম্পর্কে লিখেছেন, চলচ্চিত্র সবসময় অনুপস্থিতির দ্বারা বিরামচিহ্নিত। ফিল্ম দেখার সময় দর্শক আসলে ১০০ ভাগের মধ্যে ৪ ভাগ সময় বসে থাকেন ফাঁকা পর্দার সামনে। নিজেরই অজান্তে। ঠিক সেই সময় তাঁর মস্তিষ্ক সমানে তৈরি করে চলে সেই একই পর্দায় চলতে থাকা দৃশ্যমালা নিয়ে এক গল্প। তাই মাইকেল উডের কথা অনুসরণ করে বলা যায়, দর্শকের মস্তিষ্ক সেই অর্থে একাধারে প্রযোজক, পরিচালক ও সিনেমা প্রদর্শনীর ক্ষেত্র।

১৮৯৫ সালে অগস্ত লুমিয়ের আর লুই লুমিয়ের (যারা লুমিয়ের ব্রাদার্স নামে বিখ্যাত) প্রথম এই প্রযুক্তি আর দর্শকের দৃষ্টির যোগসাজশকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করলেন তাঁদের বিখ্যাত যন্ত্র ‘সিনেম্যাটোগ্রাফ’। এই যন্ত্র দ্রুত গতিতে ছবি তোলা ও ছবি প্রদর্শন দুই-ই করতে সক্ষম। ১৮৯৫ সালের ২২ মার্চ প্যারিস শহরে এই সিনেম্যাটোগ্রাফের সাহায্যে তাঁরা নিজেদের তৈরি করা ছায়াছবি ‘ওয়ার্কারস লিভিং দ্য লুমিয়ের ফ্যাক্টরি” জনসমক্ষে প্রদর্শন করেন। সিনেমার ইতিহাসে এই ছবিটিই হল প্রথম প্রদর্শিত চলচ্চিত্র।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৩: বায়োপসি মানেই ক্যানসার?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৪: কিশোরের শুধু কণ্ঠই নয়, তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকেও গানের নেপথ্যে সুকৌশলে কাজে লাগাতেন পঞ্চম

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে

একটি কারখানার ফটক খোলার পর বেশ কিছু শ্রমিকের বেরিয়ে আসার দৃশ্য। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মহিলা। তাঁরা প্রথমে হেঁটে আসেন ক্যামেরার দিকে এবং কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে বা বাঁ দিকে চলে যান। এই দৃশ্যে সাইকেল চালানো পুরুষ আছেন। আছে একটি সারমেয়ও। স্থিরচিত্রের পর এই প্রথম মানুষ বাস্তবের এতো কাছাকাছি এক প্রতিচ্ছবি দেখল। স্থিরচিত্রে বিষয়বস্তু সবই নিশ্চল। আর এই লুমিয়ের ব্রাদার্সের সৃষ্টিতে তো সব হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে! এ ভাবে শুরু হল প্রতিদিনের সাধারণ ও অসাধারণ গল্প তৈরির এক নতুন যাত্রা। লুমিয়ের ব্রাদার্স ঠিক তার পরের বছর ১৮৯৬ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে ভারতের বম্বে শহরের ওয়াটসন হোটেলে বেশ কিছু চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করেন।

লুমিয়ের ব্রাদার্স অবশ্য এই আবিষ্কারের বাণিজ্যিক দিকটা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। এই কাজটিতে উৎসাহ দেখালেন টমাস এডিসন। ১৮৯৬ সালের এপ্রিল মাসে এডিসনের তৈরি ‘ভিটাস্কোপে’ দেখানো চলচ্চিত্র আলোড়ন সৃষ্টি করল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই যন্ত্রের মায়া বছরখানেকের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ল ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায়।

ইতিমধ্যে ক্যামেরা গল্প বলতে শিখে ফেলেছে। এগিয়ে আসা, পিছিয়ে যাওয়া, উপরে ওঠা, নীচে নামা, অনুসরণ করা, ক্রেনের উপর ওঠা, ট্র্যাকে চলা, আর মাঝেমধ্যে এ সব একাধিক কসরত একসঙ্গে করা। এই ভাবেই ক্যামেরা ও তার তোলা ছবির সম্পাদনা —চলচ্চিত্রকে গড়ে তুলল নতুন এক শিল্প হিসেবে।

তথ্যঋণ:
Jarek Kupsc, The History of Cinema for Beginners. Orient BlackSwan, 1989.
Mary Ann Doane, The Emergence of Cinematic Time: Modernity, Contingency, the Archive. Harvard University Press, 2002.
Michael Wood, Film: A Very Short Introduction. Oxford University Press, 2012.
* ড. সুবর্ণা মণ্ডল (Subarna Mondal), অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content