শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে ক্যামেরা সম্পাদনা প্রক্রিয়ার যে মূল ভূমিকা, সেটা বুঝতে গেলে আমাদের রাশিয়ান চলচ্চিত্র জগতের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই ভ্লাদিমির লেনিন চলচ্চিত্রের প্রচার ক্ষমতা ও অধিকাংশের মনে গ্রহণযোগ্যতার কথা মাথায় রেখে সোভিয়েত চলচ্চিত্রের জাতীয়করণে উদ্যোগী হন। উদ্দেশ্য সিনেমাকে সাধারণের মনে বলশেভিকদের প্রতি আস্থা বজায় রাখার এক গণমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা।

ফলস্বরূপ ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মস্কো ফিল্ম স্কুল’। পৃথিবীর প্রথম সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করার বিধিবদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ‘মস্কো ফিল্ম স্কুল’ হয়ে ওঠে পরিচালক, প্রযুক্তিবিদ ও অভিনেতাদের প্রশিক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই স্কুলেরই এক শিক্ষক লিও কুলেশভ একাধিক বিচ্ছিন্ন শট সূত্রবদ্ধ করার মাধ্যমে সৃষ্টি করেন এক যুগান্তকারি চিত্রের প্রয়োগকৌশল—’মন্তাজ’। ‘মন্তাজ’ চলচ্চিত্রে আনে কতিপয় ভিন্ন শটের সমন্বয়, যা আক্ষরিক অর্থ অতিক্রম করে সাঙ্কেতিক অর্থ দর্শকদের সামনে তুলে ধরে।
কুলেশভের এই অভিক্রিয়া ‘কুলেশভ এফেক্ট’ নামে বিখ্যাত। ‘কুলেশভ এফেক্ট’ বোঝায় কী ভাবে একটি শটের মানে তার আশপাশের শটের দ্বারা নির্মিত হয়। এই তত্ত্ব প্রমাণ করতে কুলেশভ একটি পুরুষের নির্বিকার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকার শট নিলেন। এই মুখের শটের সঙ্গে উনি সাজালেন আলাদা আলাদা মেজাজ ও স্বরের শট। যেমন পুরুষের মুখের ঠিক পরেই একবার রাখলেন একটি ছোট মেয়ের কফিনে শুয়ে থাকার শট, তারপর একটি স্যুপের বাটির শট এবং সব শেষে একটি যুবতীর শুয়ে থাকার শট। প্রতিটি ক্ষেত্রে দর্শক সেই পুরুষের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলেন তার পরের শটের নিরিখে। যখন পুরুষের মুখের পর শিশুর কফিন দেখলেন, তখন দর্শক বুঝলেন সেই পুরুষের বেদনা। আবার যখন পুরুষের মুখের পর এক বাটি স্যুপ দেখলেন, তখন অনুভব করলেন সেই পুরুষের খিদে। আর শেষে যখন পুরুষের মুখের পর এক যুবতীর গা এলিয়ে শুয়ে থাকা দেখলেন, তখন পড়লেন সেই পুরুষের চোখে কামনা। একাধিক শটের বিন্যাস, তার কোরিওগ্রাফি, দৃশ্যের অর্থ বদলে দেয়। পাল্টে দেয় দর্শকের দৃশ্য পড়ার ধরণ ও ভঙ্গি।
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-১: কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৫: পঞ্চমের অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে একটি কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয় ‘নদিয়া সে দরিয়া’ গানটি

কুলেশভের বিখ্যাত ছাত্র সের্গেই আইজেনস্টাইন তাঁর শিক্ষকের তত্ত্ব অনুসরণ করেন ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ নামক বিখ্যাত চলচ্চিত্রে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯২৫ সালে। এই ছবির পটভূমি ‘পোটেমকিন’ নামক যুদ্ধজাহাজের ১৯০৫ সালের ঐতিহাসিক বিদ্রোহকে ঘিরে। ১৯০৫ সাল রাশিয়ান সাম্রাজ্যে এক অশান্ত সময়, বিদ্রোহের সময়। এই অশান্তি ও অস্থিরতা দর্শকের মনে ঝড় তোলেন আইজেনস্টাইন তাঁর একাধিক শটের মিথষ্ক্রিয়ার সাহায্যে। বহু শটে অসংখ্য আনকোরা সাধারণ মানুষ ও তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন তিনি তুলে ধরেন তার সম্পাদনা শৈলীর মাধ্যমে।

‘মেট্রিক মন্তাজ’, ‘রিদেমিক মন্তাজ’, ‘টোনাল মন্তাজ’, ‘ওভার টোনাল মন্তাজ’ এবং ‘ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ’—এই ধরনের মন্তাজ আইজেনস্টাইন ব্যবহার করেন তাঁর ছবিতে। ‘টোনাল মন্তাজ’-এর এক অপূর্ব উদাহরণ আমরা পাই ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’-এ। ভাকুলিঞ্চুকের নেতৃত্বে নাবিকরা পচা খাবার খেতে অস্বীকার করেন এবং শেষমেশ তাঁরা শাসকের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে নামেন। এই অসম যুদ্ধে ভাকুলিঞ্চুকের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃতদেহ রাখা হয় এক তাঁবুর ছায়ায়। সমুদ্রের ধারে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। টাইটেল কার্ডে আমরা পড়ি ‘এক চামচ স্যুপের জন্য মৃত্যু’।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৯: আগে তো প্রাণে বাঁচি, তার পরে না হয় বিমার নিয়ম কানুনের কথা ভাবা যাবে

মৃতের ক্লোজ শটের পর সূর্যের শেষ আলোয় দেখা বহু মানুষের শোকার্ত মুখ, সমুদ্র, মৃতের অজানার উদ্দ্যেশ্যে পাড়ি দেওয়া। যখন আমার ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের দেখাই তখন তারা বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করে এই দৃশ্যটির। কারও মনে পড়ে, ‘রাইডার্স টু দ্য সি”-এর ‘বার্টলে’-র কথা, সমুদ্রে যেতে যে বাধ্য। কেউ আবার ‘বেউলফ’-এ মৃত রাজাকে জাহাজে শুইয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী, রাজা হোক বা সাধারণ নাগরিক—মৃত্যুর পর ভাসিয়ে দেওয়া হতো এক অজানার উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা নামা, এক সাহসী মানুষের চুপচাপ শুয়ে থাকা, একটা মোমবাতি এবং মানুষের শোকের মুখ—এই বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদী শটগুলি পরপর সাজিয়ে আইজেনস্টাইন সৃষ্টি করেন মনখারাপের ‘টোনাল মন্তাজ’। যে মন খারাপ জুড়ে দেয় ষষ্ঠ শতকের ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ান’ মহাকাব্য ‘বেউলফ’-এর সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর আইরল্যান্ডের কাব্যিক নাটক—’বার্টলে’ এবং ‘মৌরিয়া’-র দুঃখের নাটক।

দুই বা দুইয়ের বেশি শট, যার আলাদা মানে আছে—সেই সব শটকে জুড়ে সৃষ্টি হয় এক নতুন মানে। যার মানে আলাদা করে ওই স্বতন্ত্র শটগুলিতে আমরা পাই না। এই শটের সমন্বয়কে আমরা ‘ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ’ বলতে পারি। ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’-এ ‘ওডেসা স্টেপস’ নামে বিখ্যাত যে সিকোয়েন্স আছে, তাতে এই ‘ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ’ যুগান্তকারী এক যুদ্ধদৃশ্যের জন্ম দেয়। ‘জার’ (Tsar)-এর দুর্ধর্ষ সৈন্যবাহিনী ‘কাসেক’-রা (Cossack) আক্রমণ চালায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর। কাসেকদের সারিবদ্ধ যান্ত্রিকভাবে এগিয়ে আসা এবং ঠিক তারপর অসামরিক অপ্রস্তুত মানুষের এদিক ওদিক ছিটকে যাওয়া, তাদের চিৎকার তীব্র করে তোলে আমাদের সামনে ‘জার’ শাসকের নৃশংসতাকে। প্রথমে লং শটে গোটা দৃশ্যের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৯: যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার আশেপাশে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৩: বায়োপসি মানেই ক্যানসার?

ডায়েট ফটাফট: সুপার ফুড ড্রাগন ফল খেতে ভালোবাসেন? জানেন এর উপকারিতা?

সৈন্যবাহিনীর অনিবার্য ভাবে এগিয়ে আসা এবং সাধারণ নাগরিকদের পিছিয়ে যাওয়া। এই লং শটগুলির মাঝে মাঝেই আইজেনস্টাইন সাজিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের অসংলগ্ন বিভ্রান্ত চলাচলের ‘মিডিয়াম শট’। এই দৃশ্যের আপাত অসঙ্গতি আরও গাঢ় হয় বন্দুকের নল এবং মানুষের অসহায় পায়ের ছুটে বেড়ানোর ‘ক্লোজ শট’-এর ধাক্কায়। ঠিক যেই মুহূর্তে মনে হয় এই নিম্নগামী, হোঁচট খাওয়া, লুটিয়ে পড়া পায়ের থেকে আমাদের নিস্তার নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে আইজেনস্টাইন এক বিপরীত চলাচলের সূচনা ঘটান। গুলিবিদ্ধ এক শিশুর মৃতদেহ নিয়ে তার মা উঠতে থাকেন সেই সামরিক বাহিনীর দিকে। আমরা আশ্বাস পাই এক উল্টো স্রোতের। লং শটে একই ফ্রেমে যখন বেশিরভাগ মানুষ নীচের দিকে পালাচ্ছেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভয়ে। সেই সময় একজন মহিলা একা হেঁটে চলেছেন সেই সারিবদ্ধ বন্দুকের নলের দিকে। এই প্রতিবাদের সূচনা। ছবির শেষে আইজেনস্টাইন তিনটি সিংহের মূর্তি দেখান পরপর। প্রথমটি ঘুমন্ত, দ্বিতীয়টি বসা এবং তৃতীয়টি দাঁড়ানো—চোখ বিস্ফোরিত, হিংস্র। রাগে গর্জে ওঠা সাধারণ মানুষের রূপক। তারপরই দেখানো হয়, ‘ওডেসা অপেরা হাউস’-এর উপর ব্যাটেলশিপের আক্রমণ। ইঙ্গিত স্পষ্ট। যুদ্ধের এই তো সবে শুরু।
আইজেনস্টাইনের প্রথম দিকের ছবি তৈরির সময় চলচ্চিত্রের মূল লক্ষ্য ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রচার। ১৯০৫-এর বিদ্রোহকে ছবির পটভূমি হিসেবে বেছে নিয়ে চিত্রপরিচালক বলশেভিকদের ক্ষমতায় আসা এবং সর্বহারাদের জেগে ওঠার বার্তাই দিয়েছেন। কিন্তু উপদেশ ও বার্তা ছাপিয়ে এই চলচ্চিত্রের শৈলী রয়ে গিয়েছে এখনও। আইজেনস্টাইনের মন্তাজ-যাপন দেখা যায় হিচককের বিখ্যাত ‘ভার্টিগো’ (১৯৫৮) এবং ‘সাইকো’-তে (১৯৬০)। তাঁর শৈলীর ছাপ পড়ে কিউব্রিকের অসামান্য ছবি ‘২০০১ : স্পেস ওডিসি’ ছবিতেও (১৯৬৮)।
* ড. সুবর্ণা মণ্ডল (Subarna Mondal), অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content