শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


বাইসাইকেল থিভস ছবির একটি দৃশ্য।

অ্যালবের্তো মোরাভিয়া বা এলিও ভিতোরিনির চল্লিশের দশকের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ইতালিয়ান সাহিত্যের সঙ্গে তাল মেলায় সেই সময়ের ইতালিয়ান চলচ্চিত্র। মুসোলিনির পতন ও দ্বিতীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ইতালিয়ান চলচ্চিত্র জগতে আনে সিনেমার এক নতুন ধারা— ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম। প্রাক-যুদ্ধকালীন শিল্প-নিয়ন্ত্রণ, সেন্সরশিপ, প্রোপাগান্ডা ও একঘেয়ে চলচ্চিত্র শৈলীর ক্লান্তি থেকে মুক্তির পথ দেখায় এই নতুন শিল্প আন্দোলন।

মুসোলিনীর ‘সিনেসিতা’ স্টুডিয়োর ঘেরাটোপ পেরিয়ে ও হলিউডের স্টুডিয়ো ও স্টার সিস্টেমের হাতছানি এড়িয়ে ইতালিয়ান কিছু পরিচালক ক্যামেরা বসায় মাঝরাস্তায়, বাজারে, সর্বহারার ঘরের ভিতর। সাধারণ মানুষের সামাজিক রাজনৈতিক ও আর্থিক বিপন্নতা তুলে ধরার তাগিদের সঙ্গে সঙ্গে দেশে যুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক প্রতিকূলতাও বেশ খানিকটা নিওরিয়ালিসমের শৈলীর উত্থানের কারণ। দামী স্টুডিয়ো সেট তখন প্রযোজকদের সাধ্যের বাইরে। পরিচালকরা তাই বেছে নেন চারিদিকের দৃশ্যপট। রোজের দৃশ্যপট। বেশিরভাগ চরিত্রেরা এই ছবিগুলিতে সেই সব মানুষ যাদের নিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চারপাশ গঠিত। অন-লোকেশন শুটিং, স্বাভাবিক প্রাকৃতিক আলো, ফাস্ট ফিল্ম স্টক, লং ও মিডিয়াম শটের প্রাচুর্য, বাস্তবানুগ ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ এই সব মিলিয়ে জন্ম হয় ইতালিয়ান চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ যা বেছে নেয় যুদ্ধের পরবর্তীর অসহায়তাকে।
‘নিওরিয়ালিসম’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন আন্তোনিও পিয়েত্রাঙ্গেলি—১৯৪২-এ লুচিনো ভিসকন্টির ‘অবসেশন’ নামের ছবি দেখে। লুচিনো ভিসকন্টি, রবার্টো রোসালিনী, ভিতোরিও ডি সিকা ও লেখক সিজার জাভাতিনিদের হাত ধরে এই জ্ঁয়ের প্রবর্তন।

১৯৩৭ সালে ফ্যাসিস্টদের উদ্যোগে ইউরোপের সব থেকে আধুনিক স্টুডিওর জন্ম হয় ইতালিতে—‘সিনেসিতা’ স্টুডিয়ো। রাশিয়ান এবং জার্মানদের মতো ফ্যাসিস্ট ইতালিও চেয়েছিল চলচ্চিত্র মাধ্যমকে নিজস্ব রাজনৈতিক প্রচারের অস্ত্র হিসেবে গড়ে তুলতে। চলচ্চিত্র জগতের একাধিপত্য তাই রয়ে যায় ফ্যাসিবাদীদের হাতে। এর ফলে এক দিকে যেমন ফ্যাসিবাদ-বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার অপচেষ্টা চলতে থাকে, অন্যদিকে চলচ্চিত্র মাধ্যমকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে আরও সমৃদ্ধ করে চলে এই একই ফ্যাসিবাদী শক্তি। এই প্রযুক্তি কাজে লাগান পরবর্তীকালের চিত্রপরিচালকেরা অ্যান্টিফ্যাসিস্ট ছবি নির্মাণে।
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৭: গোদারের ব্রেথলেস ও প্যারিসের শঁসেলিজে

বিচিত্রের বৈচিত্র: তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২১: পঞ্চমের সুরের মাদকতায় বুঁদ হয়ে আশা গাইলেন সেই তোলপাড় করা গান ‘পিয়া তু আব তো আজা…’

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: মুখের রুচি চলে গিয়েছে? আয়ুর্বেদ উপায়ে অরুচি দূর করবেন কী ভাবে?

ফ্যাসিবাদীদের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ‘সেন্ট্রো স্পেরিমেন্টাল ডি সিনেমাটোগ্রা ফিয়া’ বা ‘এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম স্কুল’ (বাংলায় বলা যেতে পারে, ইতালিয়ান রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র পাঠাগার)। এই পাঠাগারের ছাত্রেরা হয়ে ওঠে পরবর্তীকালের ‘নিওরিয়ালিসম’-এর পথপ্রদর্শক রসালিনি, জাম্পা, ও অ্যান্তোনিওনি। ডি সিকা অবশ্য এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন না কোনওদিনই। ডি সিকা ও তাঁর সবথেকে কাছের বন্ধু ও সহকারী জাভাতিনি তাদের ছবিতে তুলে ধরেন নিওরিয়ালিস্ট চলচ্চিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য—ক্যামেরার বাস্তব সন্ধান বা বাস্তব-খিদে। যে ছবির পটভূমি বাস্তবকে সহজপাচ্য বা আকর্ষণীয় করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় সে ছবি মানুষকে তার পারিপার্শ্বিক সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে বঞ্চিত করে। কাকতালীয় পারিপাট্যের সাজানো কাঠামোতে হারিয়ে যায় বাস্তব জীবনের স্বাভাবিক পরিণতিগুলি। যে পরিণতিতে কোনও চাঞ্চল্য, চমক বা ভালো থাকার মিথ্যে আশ্বাস থাকার কথা থাকে নয়।

১৯৩৭ সালে ঘটে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। লুইগি চিয়ারিনি শুরু করেন ‘বিয়াঙ্কো এ নিরো’ (সাদা-কালো) নামের পত্রিকা যেখানে নিয়মিত প্রকাশিত হতে শুরু করে চলচ্চিত্র নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক রচনা। এই ‘বিয়াঙ্কো এ নিরো’ পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে নিওরিয়ালিসমের প্রধান মুখপাত্র।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৭: বিপৎকালে দেখতে পাই, রাখাল ছাড়া বন্ধু নাই…

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ

১৯৪৫ সালে চিয়ারিনির ছাত্র রসালিনি তৈরি করেন ‘রোম, ওপেন সিটি’ নামে তাঁর প্রথম বিখ্যাত ছবি। এই ছবি নিওরিয়ালিজমে মূল জোয়ার আনে ইতালিয়ান ছবির জগতে। ইতালিয়ান চলচ্চিত্রের এই নতুন ধারা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পায়। পরিচালক রসালিনি, চিত্রনাট্যকার ফেলিনি ও অভিনেত্রী আনা ম্যাগনানি হয়ে ওঠে ইতালির বাইরেও জনপ্রিয় কিছু নাম। ‘রোম, ওপেন সিটি’ বলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী এক দল মানুষের নাৎসি ও ইতালিয়ান সোস্যাল রিপাব্লিকের বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ের কথা, তাদের উপর চলা হিংস্র অত্যাচারের কথা, তার ঠিক তিন বছর পরে ডি সিকা বলেন সেই ‘নিওরিয়ালিস্ট’ ধারায় গড়া এক সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনের আরেক রকম অসম লড়াইয়ের গল্প তাঁর ছবি ‘বাইসাইকেল থিভস’-এ।

ছবি শুরু হয় রোম শহরে সারিবদ্ধ মানুষের কাজ পাওয়ার অপেক্ষার দৃশ্য দিয়ে। যুদ্ধ পরবর্তী কালের বেকারত্ব, রাস্তায় নবীন ও বৃদ্ধ অসহায় মুখের ভিড় থেকে আমরা তারপর আস্তেআস্তে সরে আসি আন্তোনিও রিকির ব্যক্তিগত জীবনে। রিকি দুই ছেলেমেয়ের বাবা। তার স্ত্রী কাজের ভারে শীর্ণ, ক্লান্ত। তাঁরা দু’ জনে খুশি কারণ রিকি রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগানোর কাজ পেয়েছে। পয়সা ভালোই। কিন্তু শর্ত একটাই। কাজ করতে হলে সাইকেল চাই। রিকির স্ত্রী নির্দ্বিধায় নিজের বিয়েতে পাওয়া লিনেনের চাদর বিক্রি করে ছাড়িয়ে আনে রিকির বন্ধক রাখা সাইকেল। রিকির ছোট ছেলে ব্রুনো যত্নে পরিষ্কার করে সেই সাইকেল।

বাবা-ছেলে মনের আনন্দে টিফিন গুছিয়ে কাজে বেরোয়। তবে বিপত্তি ঘটে প্রথম দিনই। রিকির সাইকেল চুরি যায়। বাকি ছবিটা সেই সাইকেল ফিরে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার এক করুণ কাহিনি। সাধারণ মানুষের শঠতা, নিষ্ঠুরতা ও উদারতা—সবই দেখানো হয় রিকি ও ব্রুনোর এই সারাদিনের সাইকেল-খোঁজে যা, ‘ওডিসিয়াস’-এর যাত্রার থেকে কম দুরূহ নয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’

লং শটে বৃষ্টি ভেজা রোম ও তার মলিন চেহারা দেখায় ডি সিকা। তার মাঝে মাঝে রিকি ও ব্রুনোর ক্লোজ শট। তাদের রেস্তরাঁর কথোপকথন শুনে ও তাদের সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে দর্শক বোঝে ব্রুনোকে বড় হয়ে যেতে হচ্ছে সময়ের অনেক আগে। যখন রিকি মরিয়া হয়ে একটি সাইকেল চুরি করে ধরা পড়ে, ব্রুনো সান্ত্বনা দেয় তার অপরাধী বাবাকে। ক্রস কাটে বাবার অপমান ও ব্রুনোর মুখ দেখায় ডি সিকা বারবার। ছেলের মুখ চেয়ে ছেড়ে দেয় রিকিকে পথচারীরা। তবে কানে রয়ে যায় তাদের তির্যক মন্তব্য—‘‘আজ তোমার দিন খুবই ভালো তাই বেঁচে গেলে। ছেলেকে কী শিক্ষা দিচ্ছো?”…

অপদস্থ বাবা ও তার ছেলে সন্ধ্যা নামার মুখে রোমের ভিড় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। জনবহুল পথে ডি সিকা সৃষ্টি করে এক গভীর ব্যক্তিগত দুঃখের দৃশ্য। রিকি চোখ মোছে আর ব্রুনো তার হাতটা ধরে। ‘লো কি লাইটে’ দু’ জনে মিলিয়ে যায় রোমের সন্ধ্যার রাস্তায়।
* ড. সুবর্ণা মণ্ডল (Subarna Mondal), অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content