শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আমেরিকার চলচ্চিত্র জগতে কিছু দিনের অভিজ্ঞতার পর, অভিনেতা ডেভিড ওয়ার্ক গ্রিফিথ (১৮৭৫-১৯৪৮) প্রযোজক ও পরিচালক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ছবি বানালেন দ্রুত। প্রায় শ’ খানেক। এই বহু সংখ্যক ছবি নির্মাণের ফলে গ্রিফিথের শট গঠন প্রক্রিয়ায় এল এক অনন্য দক্ষতা। উনি বুঝলেন যে চলচ্চিত্রকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে ক্যামেরাকে অ্যাকশনের অনুগামী হতে হবে। অ্যাকশন কোনও ভাবেই ক্যামেরার বাধ্য দাস হলে চলবে না।

নিজের চলচ্চিত্রের তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধির উপায় বের করার সময় তাঁর সামনে আসে নানান প্রশ্ন। একটি নাটকীয় দৃশ্যকে একাধিক শটে ভাগ করেও কি সেই দৃশ্যের কর্মের ও তার মর্মের ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব? এস্ট্যাব্লিশিং শট দিয়ে দৃশ্য শুরু করলে, ও তার পরেই মিডিয়াম শটের দ্বারা বস্তু বা ব্যক্তিকে আরও একটু স্পষ্ট করলে ও ঠিক তার পরই সেই বস্তু বা ব্যক্তির একটি ক্লোজ আপ নিলে ছবির নাটকীয়তা এবং শটের খুটিনাটি দর্শকের কাছে আরও সহজে পৌঁছবে?
১৯১৫ সালে মুক্তি পেল তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য বার্থ অফ এ নেশন’। আবরণহীন বর্ণবাদ এবং বহু ভুল তথ্য থাকা সত্ত্বেও এই ছবিটি চলচ্চিত্রের জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ছবিটি আমেরিকাতে মুক্তি পাওয়ার পর যতটা জনপ্রিয় হয়, ততটাই বিতর্কও কুড়োয়। লিঙ্কন হত্যা এবং আমেরিকার গৃহযুদ্ধ নিয়ে তৈরি এই তিন ঘণ্টার ছবি মার্কিন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম বার বিরতির প্রচলন শুরু করে। যুদ্ধের সুপরিকল্পিত প্রেক্ষাপট নির্মাণের সঙ্গে গ্রিফিথের গল্প বলার ধরনকে উদ্ভাবনীয় করে তোলার চেষ্টা চালান সমানে — ক্রস কাটিং, ফ্ল্যাশব্যাক, ফ্ল্যাশ ফরওয়ার্ড, ফেড, মাস্কিং, টিল্টিং, প্যানিং, ডলিইং … কি করেনি গ্রিফিথের ক্যামেরা? ক্যামেরার কারসাজির দৌলতেই বা দৌরাত্ম্যেই গড়ে ওঠে ‘দ্য বার্থ অফ এ নেশন’। সিনেমা প্রথম পায় প্রকৃত শিল্প হওয়ার খেতাব। প্রতিষ্ঠিত হয় অভিব্যক্তির এক অভূতপূর্ব শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে। আর এক দিক থেকে দেখতে গেলে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে চিন্তা নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করারও এক মোক্ষম অস্ত্র। তাই মাঝেমধ্যেই (বিশেষ করে যে কোনও যুদ্ধের আগে বা পরে) চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করা হয় উগ্র রাজনীতির বা প্রপাগান্ডার সহজ হাতিয়ার হিসেবে। আবার সেই চলচ্চিত্রই তৈরি করে প্রশ্নহীন আনুগত্যের বিপরীত সুর।
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-২: আইজেনস্টাইন, যুদ্ধজাহাজ ও মন্তাজ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৯: পথের প্রান্তে রয়ে গিয়েছে সে হাজার তারার ‘লক্ষহীরা’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর চলচ্চিত্রের জগৎ এগিয়ে চলে একটি অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে। এই প্রসঙ্গে জার্মান সিনেমার উল্লেখ করা প্রয়োজনীয়। জার্মানির সমসাময়িক ঘটনাবলী চলচ্চিত্রকে এক নতুন প্রবণতা, এক নতুন ছাঁচ দেয়। ঔপনিবেশিক উচ্চাভিলাষের পতন, দেশের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়া ওয়াইমার রিপাব্লিক, ভারসাইয়ের অপমানজনক চুক্তি, মুদ্রার স্ফীতি, রাজনৈতিক চরমপন্থা, ফরাসি ও বেলজিয়ানদের প্রবেশ, দারিদ্র, যুদ্ধ, মৃত্যু এই সব সৃষ্টি করে অস্পষ্টতা ও অন্ধকারের প্রতি আসক্তি। জন্ম হয় জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের বা জার্মান অভিব্যক্তিবাদের।

লট এইচ আইজনারের মতে, অভিব্যক্তিবাদী শুধু চোখ দিয়ে দেখে না। তাঁর কল্পদৃষ্টি দিয়ে গড়ে তোলে দৃশ্য। এডশ্মিড জানান যে, এক্সপ্রেশনিস্টের চোখে কারখানা, বাড়ি, রোগ, বেশ্যাবৃত্তি, হাহাকার, খিদে এর কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আছে শুধু এই সব কিছু শিল্পীর কল্পদৃষ্টিতে যে ছাপ উদ্রোক করে, সেই ছাপ। বস্তু বা ঘটনার গভীরে ঢুকলে তার আর কোনও জমাটবদ্ধ গঠন থাকে না। জন্ম হয় এক ধরনের বিমূর্তনের। উইলহেলম ওয়ারিঙ্গার বোঝান, যখন মানুষ তার চারিদিকের ঘটনার দ্বারা বিহ্বল, দিশেহারা এবং অসহায়, তখন সে বিমূর্ততার তারল্যে নিজের আশ্রয় খোঁজে। কোনও একটি বস্তুকে তার চারপাশের বস্তু ও ঘটনার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দেওয়ার চেষ্টায় মেতে ওঠে। বাহ্যিক ঘটনাকে ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ জগতে ও অভ্যন্তরীণ আবেগকে বাহ্যিক ঘটনায় পরিণত করাই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান দায়িত্ব।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৬: ‘ও হানসিনি, মেরি হানসিনি কাঁহা উড় চলি’—কিশোর-পঞ্চম ম্যাজিক চলছেই

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১: সুন্দরবনের শেকড়ের খোঁজে

চারিদিকের ধ্বংস এবং হাহাকারের মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার প্রবণতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বহু সংখ্যক জার্মান বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দেখা গিয়েছে। তাই চরম বৈপরীত্য ও চিওরুসকিউরোর (আলো ছায়ার সমন্বয়) প্রতি শিল্পীর আকর্ষণ অনায়াসেই প্রকাশ পেয়েছে সমসাময়িক জার্মান চলচ্চিত্রে।

একটি ছোট চায়ের দোকান, যেখানে সবকিছুই উদ্ভট। খাদ্য পরিবেশিকারা যান্ত্রিক মোমের পুতুলের মতো খাবার দিয়ে চলেছে। লেখকের প্রবেশে বিচলিত আশপাশের বহু খোদ্দের। তারা বিভিন্ন কোণায় বসে ফিসফিসিয়ে শয়তানি ফন্দি আঁটছে। দোকানের পেছনের দেওয়ালটি সন্দেহজনক। হয়তো ওটি একটি ফাঁদ। এই আলো-আঁধারি চায়ের দোকানে (হোটেল ক্যালিফর্নিয়ার মতো) শুধু প্রবেশই সম্ভব। এই ছিল অ্যালফ্রেড কুবিনের কল্পনায় আঁকা এক দুঃস্বপ্ন। কুবিনকেই বাছা হয়েছিল রবার্ট ওয়াইনের বিখ্যাত ‘দ্য কেবিনেট অফ ডক্টর ক্যালিগারি’-র (১৯২০) প্রেক্ষাপটের পরিকল্পক হিসেবে। অন্তত ‘ক্যালিগারি’ চলচ্চিত্রের লেখক কার্ল মেয়র ও হান্স জ্যানোউইটেসর এর তাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাধ সাধলেন এরিক পমার, যিনি ছবির অবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। খরচ বাঁচাতে সেট তৈরি হল আঁকা ক্যানভাসের উপর। টাকা ও কাঁচামাল সবকিছুরই যে বড় অভাব। তাই কুবিনের এই উদ্ভট মন্দগ্রাহী কল্পনাশক্তি কাজে লাগাতে পারল না মেয়র ও জ্যানোউইটস।

ছবির পান্ডুলিপি তারপর দেওয়া হল হার্মান ওয়ার্মকে। ওয়ার্ম, ওয়াল্টার রোরিগ ও ওয়াল্টার রেইম্যান ঠিক করেন, সেট তৈরি হবে এক্সপ্রেশনিজমের শৈলী মেনে। তাতে থাকবে যথেচ্ছ পাগলামির আপাত অযৌক্তিকতা।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩: গায়ে আমার পুলক লাগে

সম্মোহন, বাতুলতা, সহিংসতা, হত্যা ও তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা তমসাচ্ছন্ন বিকৃত দৃশ্যশৈলী ‘ক্যালিগারি’কে জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের নজির হিসেবে বিখ্যাত করল। ডক্টর ক্যালিগারি একটি উন্মাদাগারের তত্ত্বাবধায়ক এবং সংবেশক৷ তার চিকিৎসাধীন রোগী সিজারকে সম্মোহিত করে তাকে দিয়ে খুন করার গল্প ‘ক্যালিগারি’। গোটা ছবির প্রেক্ষাপট জুড়ে তীক্ষ্ণতার বিন্যাস, অসমান্তরাল এবং বক্ররেখা দিয়ে গড়া জীর্ণ বাড়িঘর, রাস্তা ও রাস্তার আলো। এই জগৎ জ্যানোউইটস ও মেয়রের দেখা ডিস্টোপিয়ার রূপক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পাশবিকতার রূপক।

রুডলফ কার্টজ ‘এক্সপ্রেশনিসম অ্যান্ড ফিল্ম’-এ জানান দৃশ্যে অপ্রত্যাশিত বাঁক বা বক্ররেখার আধিক্য, আকস্মিক উপর-নীচের গতিশীলতা মানুষের মনে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। রবার্ট ওয়াইনের ‘ক্যালিগারি’ এবং তার মড়চে পড়া অন্ধকার শহর, তার আঁকা বাঁকা অন্ধ গলি, প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ি যেখানে আলোর কোনও সান্ত্বনা নেই, যেখানে খুপরি জানলা আর দরজা গিলে খায় নিজেদেরই আশপাশের দেওয়াল, পথ দেখায় ভবিষ্যতের বহু এক্সপ্রেশনিস্ট পরিচালকদের। জার্মান চলচ্চিত্রে অভিব্যক্তিবাদ শুরু হয় ‘স্টুডেন্ট অফ প্রাহা’ (১৯১৩) দিয়ে। সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যায় ওয়াইনের ‘দ্য কেবিনেট অফ ডক্টর ক্যালিগারি’ (১৯২০)। ‘ক্যালিগারি’ তুলে ধরে উগ্র এবং অযৌক্তিক কর্তৃত্বের বিভৎসতা।

তারপর আসে ‘গোলেম’ (১৯২০), ‘ডেস্টিনি’ (১৯২১), ফ্যান্টম (১৯২২), নসফেরাতু (১৯২২) এবং আরও বহু ছবি যা ১৯৩০ অবধি জার্মান ও বিশ্বের চলচ্চিত্রকে দিয়ে যায় এই অবিস্মরণীয় অ্যাবসার্ড আতঙ্কের জগৎ। যে জগৎ এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। যে জগতে ‘ডক্টর ক্যালিগারি’ এক অতিপরিচিত মুখ।—চলবে
* ড. সুবর্ণা মণ্ডল (Subarna Mondal), অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content