শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কিশোর ও লতা। ছবি: সংগৃহীত।

আচ্ছা এ কথা কি পরিকল্পনা করা যায়, সুরের সাগরে ডুবে থাকা এই মানুষটি যখন প্রযোজনা ও নির্দেশনা করলেন ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দূর ওয়াদিও মে কাহি’ নামের ছবিটি। এই ছবিটি কিন্তু তথাকথিত নিয়ম রীতি ভাঙা একটা আস্ত গান ছাড়া চলচ্চিত্র। বহুল প্রতিভার জলজ্যান্ত প্রামাণ্য, এই মানুষটিই বোধহয় এমন বাস্তবমুখী আপাত ঝুঁকিপূর্ণ চিন্তা করতে পারেন। আবার নিজের ব্যস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যেই তিনি প্রায় ১৬টি ছবিতে সংগীত পরিচালনার কাজ করেছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ৬টি অসমাপ্ত। তবুও এ হল খাতা কলমের পরিসংখ্যান। বাস্তবে আসলে বহু গানের সুরের পিছনে আছে তার প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ মদত।

খোদ শচীনকর্তার বহু গানেই তার আদ্যোপান্ত প্রভাব, একসঙ্গে বসে শুরু থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত সুর গেঁথেছেন তিনি। যদিও তার খাতা কলমে কৃতিত্ব চাননি কখনও। নবীন কিশোরের সুরে ‘ঝুমরু’ ছবির ‘কোই হামদাম না রাহা ‘যেমন বিরহের গাম্ভীর্যকে ব্যক্ত করে, তেমনি ‘দূর গগন কি ছাও মে’ আর ‘আ চালকে তুঝে মেয় দিখলাউ’ এনে দেয় শান্তির শীতল ও নিবিড় আরাম।
খেলার ছলেই সুরদানের কিছু কথা জানা যায় গীতিকার অমিত খান্নার থেকে। একবার অমিতবাবু কোনও এক কাজে মেহেবুব স্টুডিয়োর বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে কিশোর শশব্যস্ত ‘শাবাশ ড্যাডি’র নির্দেশনায়। প্রায় পাকড়াও করে অমিতবাবুকে বললেন যে, তিনি ছবির প্রযোজক, নির্দেশক, অভিনেতা ও সংগীত পরিচালকও। এদিকে ব্যস্ততায় কোনও গান রেকর্ডিং হয়নি। তাই তিনি যেন তক্ষুনি খান দু’য়েক গান লিখে আপাতত কোনও ভাবে মুখরক্ষা করতে পারেন। যথা আদেশ, অমিতবাবু তৎক্ষণাৎ প্রয়োজন মাফিক লিখে দিলেন কিছু গান, আর ততোধিক চমৎকৃত হলেন এই দেখে যে— কিশোরও সঙ্গে সঙ্গে গানে সুর দিয়ে চললেন সে গানের রেকর্ডিংয়ে। হতবাক অমিতবাবু তার দক্ষতায়।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৮: আমি শুনি গো শুনি তোমারে…

সৌম্য ভৌমিক, সঙ্গীত শিল্পী, পর্ব-৩০: আ দেখে জারা কিসমে কিতনা হ্যায় দম… এই গানে পঞ্চমের বাজি ছিলেন কিশোর ও আশা

সুরকার যতীনের কাছে শোনা যায়, আরেক আজব মজার কথা। কিশোরের সঙ্গে তাদের পরিবারের জানা শোনা ছিল আগে থেকেই। ছেলেবেলায় যতীন একদিন বাড়ির বাগানে খেলতে ব্যস্ত, হঠাৎ কিশোর মামার আগমন। বাড়ির বড়দের জানালেন, তিনি তখন ‘দূর কে রাহি’ ছবি তৈরি করছেন, আর সেই জন্যই তাঁর দরকার কিছু ছোট ছেলেমেয়ের। বাড়ির লোকের অনুমতি নিয়ে, গাড়ি করে যতীন ও আরও কিছু বাচ্ছাদের নিয়ে সোজা চলে গেলেন শহর থেকে দূর কোনও এক গ্রামে। সেখানে তখন আগে থেকেই চলছে শুটিংয়ের কাজ।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৬: আজগুবি ‘নয়’, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা!

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে দরকার ছোটদের একটা গান। সেখানেই কথা সুরে বেঁধে ফেললেন কয়েক কলির ‘যবতাক হেয় দাম মে দাম’, কচিকাঁচাদের নিয়ে হল শুটিং। কাজ শেষ হতে আবার গাড়ি করে বাড়ি ছাড়ার আগে সোজা একবার স্টুডিয়োতে গিয়ে সেরে ফেললেন গানের রেকর্ডিংও। বহুমুখী গুণের সাগরে পরিপূর্ণ না হলে কেউ হয়তো এমন ভাবে কর্ম সম্পন্ন করার কথা ভাবতে পারবেন না।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৩: নহবতবাড়ির ‘এতটুকু বাসা’

একবার এক অর্থে বেশ রেষারেষি লেগে গেল কোকিল কণ্ঠী লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে। সে যুগে বাঙালি শ্রোতার কাছে পুজোর গানের আলাদা কদর। গীতিকার মুকুল দত্তর কথায় দু’খান গান সুর করার জন্যে তৈরি। একটি গান কিশোর বেছে, মজা করে লতাকে উস্কে দিয়ে বললেন আমি এটার সুর করবো, তুমি কি আর আমার মতো আরেকটা তে সুর করতে পারবে? তাহলেই হয়েছে আর কী? ব্যাস, এই শুনে লতা তো বেশ চটলেন। দু’জনের মধ্যে হল বাজি। গান যদি একে অপরের পছন্দ হয়, তবে তারাই গাইবেন সে গান। নচেত একেবারেই নয়। আর এই জেদ থেকেই সৃষ্টি হল কালজয়ী সেই দুটো গান, যা আজও অমলিন।

কিশোর সুর করলেন, ‘প্রিয়তম কী লিখি তোমায়’, কী অসাধারণ সুর। প্রেমের আড়ালে এক রহস্যময়তা। ওদিকে লতাও কম যান না, তিনি সুর করলেন ‘তারে আমি চোখে দেখিনি’, আরেক অপরূপ সৃষ্টি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দু’জনই দুটি গানে হলেন মুগ্ধ, আর তারা গাইলেন অন্যের সুরারোপিত গানগুলি। ‘হাওয়ায় মেঘ সরায়ে’, ‘সেই রাতে রাত ছিল’-এর মতো এক একটি গানে কিশোর সুর সৃষ্টি করে শ্রোতাদের সেই সুরে অবগাহন করিয়ে এক অর্থে হাবুডুবু খাইয়েছেন যুগ যুগ ধরে।—চলবে।
* ঋত্বিক চক্রবর্তী, পেশাগত ভাবে একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কর্মসূত্রেই স্পেনে থাকা। কাজের কাজ ও অকাজ করে সময় পেলেই বইপড়া, গান শোনার চেষ্টা আর পাঁচটা বাঙালির মতোই মজ্জাগত। রুজি রোজগারের বাইরে নিজের মনের জন্য কিছু পুষ্টি সঞ্চয়ে উন্মুখ। তাই পেশা আর নেশার টানাপোড়েনে পড়ে থাকা আর এক বাঙালি।

Skip to content