আড্ডায়।
বাংলা চলচ্চিত্র বা আধুনিক গানে কিশোরের অবদান অতুলনীয় তো বটেই, অসমান্তরালও। মহানায়ক উত্তমকুমারের মুখে অনবদ্য সব কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চির দিনের সাথী’, ‘আশা ছিল ভালোবাসা ছিল’, ‘যদি হই চোর কাঁটা’, ‘এই তো জীবন’, ‘নারী চরিত্র বেজায় জটিল’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর নিজের অভিনীত ‘লুকোচুরি’ ছবিতে ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ গানটিতে দিকপাল হেমন্তবাবু একাধারে চমকপ্রদ, স্বতন্ত্র সুর সৃষ্টি করেছিলেন কিশোরের ওপর অগাধ আস্থা থেকেই। কথা, সুরে, যন্ত্রে, তালে যেন এক চরম নাটকীয় ও কৌতুকের বিশৃঙ্খলতার মধ্যেও, বজ্র আঁটুনি। মিলিটারি ছন্দে যেন হাসির কলরোল।
এদিকে ‘চারুলতা’য় বিশ্ববন্দিত রায় সাহেব তাঁকে দিয়ে গাওয়ালেন জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতটি। রায় সাহেবকে প্রশ্ন করা হল, তথাকথিত সমস্ত রাবীন্দ্রিক শিল্পীকে দিয়ে গানটি না গাইয়ে, হঠাৎ কিশোরকে দিয়ে কেন গাওয়ালেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, চলচ্চিত্রের ‘সন্দীপ’ চরিত্রটি আসলে একজন গুণী অথচ বেশ সাধারণ মানুষ। একজন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর গায়কীর বৈশিষ্ট্য, সেই চরিত্রের সঙ্গে মেলানো ভীষণ বেমানান। বদলে প্রয়োজন ছিল এমন একজনের, যার কণ্ঠ যেন জনমানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা তবুও যা আবিষ্ট করতে পারে সকলকে। কিশোর ছাড়া আর কারুর কথা যে মেনে নেওয়া যায় না সেক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন:
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা
সত্যজিতের প্রতি কিশোরের গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ পাওয়া যায় বার বার। ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের পথে আর্থিক প্রতিকূলতায় রায় যখন বিপর্যস্ত, তখন সুদূর বম্বে (তখন বম্বে) থেকে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কিশোর। উপরোক্ত ‘আমি চিনি গো চিনি’ গানটির পারিশ্রমিক হিসেবেও তিনি চেয়েছিলেন শুধু আশীর্বাদ। তবে সত্যজিতের সঙ্গে পর্দায় প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করার সুযোগ এসেও তা সম্ভব হয়নি একসময়। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির গুপীর চরিত্রে সত্যজিতের প্রথম পছন্দ অবশ্যই ছিলেন কিশোর। প্রাণখোলা, হাসিখুশি, গানে ভোলানো কিশোরের যদিও তা আর করা হয়নি বিভিন্ন ব্যস্ততার মাঝে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?
একটু আসা যাক তাঁর ইউডলেয়িং-এর কথায়। আসলে একসময় দাদা অনুপকুমারের সঙ্গে তালে তালে চলতো তাদের ইউডলেয়িংয়ের যুগলবন্দি। জিমি রজার্স ও টেক্স মর্টান-এর চরম ভক্ত এই দুই ভাইয়ের সংগ্রহে ছিল তাঁদের বেশ কিছু রেকর্ডিং। একবার অনুপের কিছু রেকর্ডিং আর খুঁজে পাওয়া যায় না কিছুতেই, চিন্তিত অনুপ জানতে চাইলে কিশোর নিরুত্তাপ। যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে হচ্ছে। এরপর মাস খানেক পর যখন কিশোরের বম্বাইয়ের বাড়িতে যান অনুপ, এক সকালে তিনি শোনেন চানঘর থেকে ভেসে আসা কিশোরের দুর্দান্ত ইউডলেয়িংয়ের আওয়াজ। একেবারে পরিপক্ক ও নিত্য অধ্যবসাযয়ের ফসল যাকে বলে। বুঝতে তাঁর আর বাকি রইল না যে রেকর্ডিংগুলোর মালিক আজ কে?
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৫: আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে / খুঁজে পেতে আনি খেতে-নয় বড় সিধে সে!…
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৬: অ্যালেন, দেখলেন, খেলেন
তবে নিজের মূল্যবোধ ও নীতির সঠিক পরিচয় তিনি বার বার দিয়ে গিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাবে। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্রী ইন্দিরা গান্ধী জারি করলেন, জরুরি অবস্থার। অবস্থানগত ভাবে সমাজে, শিল্পক্ষেত্রে সর্বত্র দেখা যায় এক সুস্পষ্ট বিভাজন। নিজের সেই নীতিবোধের ভিত্তিতেই তিনি নেন জরুরি অবস্থার বিরোধী পক্ষ। সরকারি পরিকল্পনা মাফিক, আকাশবাণী থেকে প্রচারিত গানের জন্য নির্বাচিত শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন তিনিও। আধিকারিকদের একাধিক পীড়াপিড়ির পরও তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি। ক্ষমতাবান বহু মানুষের বিরাগভাজন হবেন জেনেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি।
রেকর্ডিংয়ে।
আকাশবাণীর ওই সরকারি সম্প্রসারণে তিনি গান গাইবেন না। ফলস্বরূপ তৎকালীন সময়ে বেতার ও দূরদর্শনে তাঁর গাওয়া গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, জরুরি অবস্থার শেষ দিন অবধি। ক্ষমতার রক্ত চক্ষুকে তাও ভয় না পেয়ে তিনি পিছু হাঁটেননি কিছুতেই, যেন গেয়ে উঠেছেন ‘এ তো কান্না, এ তো নয় গান, এ যে আমার নীরব অভিমান’
যে মানুষটি একাধারে গায়ক, পর্দায় সাবলীল অভিনেতা, সংগীত পরিবেশনার খুঁটিনাটি যার হস্তগত সে মানুষটির সংগীত পরিচালকের রূপে অবতারণা ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। তাঁর নিজের গাওয়া অনেক গান, বহু শ্রোতাই হয়তো শুনে থাকেন, গুনগুনিয়ে থাকেন এ কথা না জেনে যে, সে গানের সুরকার আসলে কিশোর নিজেই। —চলবে।
যে মানুষটি একাধারে গায়ক, পর্দায় সাবলীল অভিনেতা, সংগীত পরিবেশনার খুঁটিনাটি যার হস্তগত সে মানুষটির সংগীত পরিচালকের রূপে অবতারণা ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। তাঁর নিজের গাওয়া অনেক গান, বহু শ্রোতাই হয়তো শুনে থাকেন, গুনগুনিয়ে থাকেন এ কথা না জেনে যে, সে গানের সুরকার আসলে কিশোর নিজেই। —চলবে।
* ঋত্বিক চক্রবর্তী, পেশাগত ভাবে একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কর্মসূত্রেই স্পেনে থাকা। কাজের কাজ ও অকাজ করে সময় পেলেই বইপড়া, গান শোনার চেষ্টা আর পাঁচটা বাঙালির মতোই মজ্জাগত। রুজি রোজগারের বাইরে নিজের মনের জন্য কিছু পুষ্টি সঞ্চয়ে উন্মুখ। তাই পেশা আর নেশার টানাপোড়েনে পড়ে থাকা আর এক বাঙালি।