সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


এ বার আবার একটু গান-গল্পে ফিরে আসে যাক। আট থেকে আশি বলা ভুল, বোধহয় এক থেকে একশো সবার মনকে ছুঁয়ে যেতে পারেন কিশোর। ‘রোনা, কাভি নাহি রোনা’, শুধু খিলখিল করে শিশুর মুখে হাসি ফোটায় না, চোখের জল মুছে দিতে পারে এক প্রাপ্তমনস্ক দুখীর। আবার ‘রুক জানা নাহি তু কাভি হারকে’, প্রাণশক্তির নির্যাসে উদ্বেলিত করে লক্ষ্য লক্ষ্য লক্ষ্যচূত চঞ্চল মনকে।

এই বিশাল ব্যাপ্তি আর প্রভাবময় সেই শিল্পীর শিল্পের মান নির্ধারণ সংখ্যাতত্ত্বের বেড়াজালে নয়, প্রাণের আরামের দাঁড়িপাল্লায় করা যায় নিমেষেই। সুদীর্ঘ ৪২ বছরের গায়ক জীবনে প্রায় তিন হাজার গান গেয়েছেন মূলত হিন্দি ও বাংলা ভাষায়। এছাড়াও গুজরাতি, ভোজপুরী, ওড়িয়া, ইংরাজি, কন্নড়, মালয়ালম ইত্যাদি ভাষায় গান গেয়েছেন। তবে ওই একই কথা তা হল, সংখ্যার কচকচি নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আজ ঘুরে ফিরে তার আনাগোনা চিরতরে, এটিই মূল কথা।
যে কথা আগের পর্বেও এসেছে, কিশোরের কর্মজীবনে বিভিন্ন প্রখ্যাত, প্রতিভাবান সুরকারদের যাই-ই সুবিশাল অবদান থাকুক না কেন, এসডি বর্মণের স্থান সবার ওপরে। তার হাত ধরেই যেন আসলেই সে পথ চলা, পিতা-পুত্রের কালাধিক সম্পর্কের মতো। তবে সরস্বতী দেবী, খেমচাঁদ প্রকাশ এঁদের গুরুত্বই বা অস্বীকার করি কি করে? যাঁদের মাধ্যমে বা দেওয়া সুযোগেই প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া। সলিল চৌধুরী, ওপি নাইয়ার, কল্যানজি-আনন্দজি, পঞ্চম, বাপ্পি লাহিড়ী, লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল সবাই তার পথের সঙ্গী। কোনও রকম তথাকথিত সংগীত শিক্ষা ছাড়াই তার কণ্ঠের ব্যাপ্তি আর সাবলীল ওঠানামা তা যেকোনও স্কেলেই হোক না কেন, বারবার চমকিত করেছে তাবড় সংগীতজ্ঞদের।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

কিশোরের আর পাঁচটা অতিমানব ক্ষমতার একটি ছিল সুরকারদের সুরের ব্যাপারে তার পূর্বানুমান। কল্যানজি-আনন্দজি একবার রেকর্ডিংয়ের চার দিন আগে থেকে রিহার্সালের দিন ঠিক করে রাখলেন। ব্যস্ত কিশোর গরহাজির, উদয় হলেন একেবারে রেকর্ডিংয়ের দিন। এতে সুরকারদ্বয় স্বাভাবিকভাবেই বেশ ক্ষুণ্ণ। চট করে হারমোনিয়ামখানা টেনে গানটা গেয়ে কিশোর বললেন,’ ঠিক আছে তো?’ তাঁরা চমকে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বরফের মতো গলে গেলো সব রাগ।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৭: আশাকে নিয়ে পঞ্চমের সব প্রশ্নের জবাব চিঠিতে জানিয়েছিলেন লতা

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৪: হাজরা মোড়ে নাম না জানা কচুরিখানা

একবার ঘুরে আসা যাক পঞ্চম পাড়া দিয়ে। ৬৪ সালে গুরু দত্তের মৃত্যুর পর তাঁকে উৎসর্গ করে নির্মিত ছবি মেহমুদের ‘ভূত বাংলা’ এক অনন্য প্রচেষ্টা। পঞ্চম-কিশোর অমৃত রসায়নের প্রথম ফোঁটার ছিঁটে আসে এখান থেকেই। ‘জাগো সোনেওলো’ ছন্দে, কথায়, উপস্থাপনায়, সর্বোপরি কিশোরের কণ্ঠে ছিল একাধারে পরীক্ষামূলক ও সফল পরিবেশনা। নিন্দুকদের চুপ করিয়ে কিশোর বুঝিয়ে দিলেন তাঁর ক্ষমতা। পাঁচের সচিন-কিশোর জুটির পর সূচনা হল নতুন যুগ, নতুন জুটির। পূর্বালোচিত ‘আরাধনা’র কথায় একটা কথা বলা অত্যন্ত জরুরি। এ ছবির সুরকার শচীনকর্তা হলেও, সুপারহিট দুই গানে পঞ্চমের অবদান সবারই জানা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…

প্রথম আলো, পর্ব-৪: পৃথিবীর প্রথম সুর ও সঙ্গীত কোনটি?

‘রূপ তেরা মাস্তানা’র পিছনের মজার গল্প অনেকেরই হয়তো জানা। কিন্তু যাঁরা জানে না, তাঁদের জন্য গল্পটা হোক আরেকবার বলি। গানটির জন্য এক তথাকথিত প্রেমের সুর বেঁধেছিলেন সচিনকত্তা। কিন্তু চিত্র পরিকল্পনা আর রাজেশ-শর্মিলার রসায়ন দাবি করছিল এক অন্য মাত্রার। রাহুলের তখন মাথায় এল কিশোরের মুখে কিছু দিন আগে শোনা এক ছড়া গানের কথা, ‘কালকে যাব শ্বশুরবাড়ি’। সেটিকেই অন্য বিস্তারে, হারমোনিয়াম নিয়ে কিশোরের সঙ্গে বসে সৃষ্টি করলেন সেই যুগান্তকারী মায়াময় গানটির। ‘পড়োশন’-এর ‘এক চতুর নার’ গানে মান্না দে ভাবলেন। এ বার তার কেল্লা ফতে করার পালা।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছন্দে গাঁথা গানটির অনেকাংশেই তিনি কিশোরকে টেক্কা দিয়ে জনতার দরবারে জিতবেন, এমন আশাতেই বুক বাঁধলেন। তবে কী আশায় বাঁধলেন খেলাঘর আর হল কি? ‘নাচ না জানে অঙ্গন টেড়া’ পঙতি যেই শেষ করলেন রেকর্ডিংয়ে কিশোর অমনি ধরলেন ‘ওরে টেড়ে সিধে হো যা রে’ যা মোটেও আসল গানের মধ্যে ছিল না। হতবাক মান্না তাকালেন পঞ্চমের দিকে, পঞ্চমদাও হেসে শুধু চালিয়ে যেতে বললেন। তারপর আর বিজয়পতাকা ওড়ানো গেল না।—চলবে।
* ঋত্বিক চক্রবর্তী, পেশাগত ভাবে একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কর্মসূত্রেই স্পেনে থাকা। কাজের কাজ ও অকাজ করে সময় পেলেই বইপড়া, গান শোনার চেষ্টা আর পাঁচটা বাঙালির মতোই মজ্জাগত। রুজি রোজগারের বাইরে নিজের মনের জন্য কিছু পুষ্টি সঞ্চয়ে উন্মুখ। তাই পেশা আর নেশার টানাপোড়েনে পড়ে থাকা আর এক বাঙালি।

Skip to content