বুধবার ১৩ নভেম্বর, ২০২৪


অন্য মুডে কিশোর কুমার। ছবি: সংগৃহীত।

১৯৭০-এর সময়কার কথা। সীমান্তে সেনা, জওয়ানদের অনুপ্রাণিত ও মনোরঞ্জনের জন্য ডাক পড়ল শ্রদ্ধেয় সুনীল দত্তের। সুনীলবাবু, কিশোর কুমারকেও বললেন তাঁর সঙ্গে যেতে, ওই সফরে তাঁর সঙ্গী হতে। পর্দার সামনে, প্রাণখোলা হাসিখুশি এই মানুষটা তখনও সে অর্থে অত সাবলীল ছিলেন না জনসাধারণের মধ্যে, বেশি গানের জলসা বা এক অর্থে স্টেজ শো এসব তো করতেনই না সে সব দিনে। তবুও নাছোড়বান্দা সুনীলবাবু, কিশোরকে বোঝালেন যে, এই কাজটা হবে দেশের জন্যে, নিজেদের শিল্পসত্ত্বা দিয়ে সেনাদের আনন্দ দেওয়ার চেয়ে ভালো কাজ আর কি বা হতে পারে। এই শুনে শেষমেশ রাজি হলেন কিশোর।
প্রথম দিকে সুনীলবাবুর পিছনে নিজেকে আড়াল করে গান শুরু করলেন তিনি। কিছু পরে গান গাওয়ার ছন্দে তিনি যখন বিভোর, ধীরে ধীরে সরে গেলেন সুনীল। সেনা, জওয়ানরা তাঁকে দেখতে পেয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে যাওয়ার সামিল। তাই দেখে কিশোরও হঠাৎ স্নায়ুর চাপ অনুভব করলেন, একেবারে গলদঘর্ম অবস্থা। তবুও আস্তে আস্তে কেটে গেল তা, কেটে গেল সব জড়তাও।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১০: কী উপহার সাজিয়ে দিলে…

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩২: শুধু কি গানে, আবহসঙ্গীতেও তাঁর কাজ অসামান্য

আর এই মানুষটাই ধীরে ধীরে স্টেজেও মানুষের মন জয় করলেন, একজন পারফরমার হিসেবে, এ ভাবেই শুরু। একটা সময় ছিল যখন তিনি ও তাঁর সঙ্গী সংগীতবাদকরা খুব কম সময়ের ব্যবধানে, এমনকি কোনও রিহের্সাল ছাড়াও মঞ্চ কাঁপাতেন অনায়াসে। দর্শকদের থেকে আশা অনুরোধ অবলীলায় মঞ্চস্থ করতেন হুবহু রেকর্ডিং স্টুডিয়োর মতোই। এর পর মঞ্চে দেখা যেতে লাগল কিশোরের প্রাণখোলা, হুল্লোড়ের রূপ। শুধু গান গেয়েই যে মঞ্চ মাতালেন তা নয়, নিজস্ব এক অনবদ্য আকর্ষণীয়তাই আচ্ছন্ন করলেন শ্রোতাদের। নাচ, লম্ফঝম্প কি নেই তাতে? সঙ্গী গায়ক, গায়িকারা রীতিমতো হিমশিম খেতে শুরু করলেন তাঁর সঙ্গে মঞ্চে গাইতে উঠে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?

পরবর্তীকালে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষত হৃদরোগ জনিত সমস্যার পর চিকিৎসক তাঁকে অনুরোধ করেন আক্ষরিক অর্থে কিশোরসুলভ দৌরাত্ম ছেড়ে একটু ধীরে-সুস্থে মঞ্চে গান করতে। স্ত্রী লীনা, এ ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখা শুরু করলে তিনি জানান, এ সব অনুরোধ তাঁর পক্ষে পুরোপুরি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, শ্রোতা দর্শকরা কিশোরের অনুষ্ঠানে শুধু গান শুনতে আসেন না, আসেন ঘণ্টা খানেক জীবনের সব দুঃখ, চাপ, হতাশা ভুলে শুধু আনন্দের জোয়ারে ভেসে বেড়াতে। আর সেই চাওয়া থেকে তিনি কোনওদিন তাদের বঞ্চিত করতে পারবেন না।

কানাডার এক অনুষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটল যা একপ্রকার অবিশ্বাস্য। অনুষ্ঠানের শুরুতে আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ খবর পান কোনও এক সংস্থা নাকি হুমকি দিয়েছে অনুষ্ঠান চলাকালীন চরম কোনও এক প্রাণঘাতী আক্রমণ করার। পুলিশ ও প্রশাসন তৎপর হয়ে উঠলেন স্বাভাবিক ভাবেই। কিশোরকে অনুরোধ করলেন, স্বাভাবিক মন মাতোয়ারা, উচ্ছলতার গান না গেয়ে কিছু গম্ভীর ও ধীরস্থির গান গাওয়ার জন্য, যাতে অবস্থা আয়ত্তের মধ্যে রাখতে সুবিধা হয়। সঙ্গে ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তিনিও অনুরোধ করলেন কথা মতো কাজ করার জন্য, না হলে জীবনের ঝুঁকি হতে পারে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৯: সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না?

রিভিউ: ২০০ কোটি টাকার চোখ-ধাঁধানো দক্ষিণী অ্যাকশন ছবি ‘থুনিবু’

সব কিছু শুনে কিশোর অনুষ্ঠান শুরু হতেই যে কাজটা করলেন তা হল দর্শক আসন থেকে কয়েক জনকে উঠে আসার অনুরোধ করলেন, যাঁরা মঞ্চে তাঁর সনেগ গানের সঙ্গে সঙ্গে নাচতে চান। পুলিশ, কর্তৃপক্ষের তো চক্ষু ছানা বড়া, এ মানুষ বলেন কী? সঙ্গে সঙ্গে তারা অনুষ্ঠান স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়ে, কিশোরকে বেশ জোরের সঙ্গেই অনুরোধ করলেন, এমন বিধ কাজ না করতে। ওদিকে উনি যে কিশোর কুমার। তিনি বললেন, আমি গাই গান, মানুষকে দিই আনন্দ, আর আমাকে কেউ মারতে পারে এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।

বেশ কিছু চাপান উতরের পর এক রকম বাধ্য হয়েই কর্তৃপক্ষ কিশোরকে তাঁর স্বমহিমায় গান গাইতে দিতে বাধ্য হলেন। সে অনুষ্ঠানও এক অন্য মাত্রার হল, তবে ঠিক চেনা ছকের বাইরে একদম শেষ যে গানটি গাইলেন তা হল, ‘প্যার বাঁটতে চাল, ক্যায়া হিন্দু ক্যায়া মুসলমান’। এনে দিলেন সবার চোখে জল। এমনি তিনি কিশোর কুমার, গায়ক, অভিনেতা, পারফরমার না এক সহজ আবেগী মানুষ, যিনি শুধু আবেগ ছড়িয়ে গিয়েছেন আনাচে কানাচে, প্রতি নিয়ত। আজ যার সৌরভে মাতোয়ারা আমরা।—চলবে।
* ঋত্বিক চক্রবর্তী, পেশাগত ভাবে একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কর্মসূত্রেই স্পেনে থাকা। কাজের কাজ ও অকাজ করে সময় পেলেই বইপড়া, গান শোনার চেষ্টা আর পাঁচটা বাঙালির মতোই মজ্জাগত। রুজি রোজগারের বাইরে নিজের মনের জন্য কিছু পুষ্টি সঞ্চয়ে উন্মুখ। তাই পেশা আর নেশার টানাপোড়েনে পড়ে থাকা আর এক বাঙালি।

Skip to content