সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


কিশোর কুমার। ছবি: সংগৃহীত।

আজন্ম, মৃত্যু অবধি জীবন আসলেই বৈচিত্র্যময়, বৈপরীত্যময়ও বটে। চলা-থামা, উত্থান-পতন, আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ, আলো-আঁধার, রোগ-ভোগ, এ আতিশয্য অগুন্তি। তবু এ সব কিছুর মধ্যেই মানুষ যেন খুঁজে চলে এক নিরন্তর আশ্রয়। কখনও তা প্রাণের আরামে, আবার কখনও বা ব্যথার উপশমে। প্রিয়জন বা প্রিয় কিছুর আবেশে যেমন আসে প্রশান্তি বা তেমনি আসে ব্যথার ব্যঞ্জনা। কথায় বলে, ‘Music has the supreme power.’ আর তার আখর হিসেবে বলা যায়, জীবনের এই নানা রসাস্বাদনের সর্বসময়ের এক পরম সহযাত্রী যদি কেউ হতে পারেন, তিনি হলেন চির অবিস্মরণীয়, সর্বশ্রেষ্ঠ, অমর শিল্পী, কিছুটা নাটকীয় ভাবে বলতে গেলে ‘None other than’ কিশোর কুমার।
সমাজের যে কোনও শ্রেণির, যে কোনও স্তরের, যে কোনও প্রজন্মের মানুষের কাছে যার আনাগোনা অবারিত, অপরিমিত। ব্যক্তি ও শিল্পী সত্ত্বার বহুমুখিতা তাকে আপামর জনসাধারাণের কাছে করে তুলেছে অপরিহার্য, অবশ্যম্ভাবী এক পাথেয়। পথের সাফল্য আর বাধা দুইয়েই মুখরিত তার জয়গান। শুধু গায়ক কিশোরই নন, অভিনেতা, সংগীত পরিচালক, নির্দেশক, প্রযোজক, সর্বোপরি মানুষ কিশোর আসল অর্থেই ছিলেন সরস্বতীর বরপুত্র।

রীতি-নীতির শৃঙ্খলে নয়—নিয়মছাড়া, বাঁধনহীন সাবলীলতায় তিনি সমাদৃত আনাচে কানাচে। তাই তো তাঁকে ছোঁয়া যায় যখন তখন, যেখান থেকে খুশি। তাই তো তার মুখ হতে ঝরে পড়া প্রতিটি শব্দই যে ‘কী করে গান হল জানি না।’ সে-কারণে তাঁকে নিয়ে আজ যখন দু’ কথা বলতে বা লিখতে বসা, তাও তাহলে হোক বাঁধনহীন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২২: পঞ্চমের সুরে কিশোর-আশার গাওয়া ‘জীবন কে হার মোড় পে’ গানটির কথা মনে পড়ে?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’

দশভুজা: আমি আর কখনওই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না…

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৬: কাউকে অপদস্ত করতে হলে তাঁকে নারীঘটিত বিষয়ে জড়িয়ে দিতে হয়

তথ্য আর পরিসংখ্যান নয়, এ লেখনীতে থাক কোনও এক বর্ষামুখর সন্ধ্যার ঘরকুণো জমাটি আড্ডার মতোই নির্মলতা, সহজতা। তাঁকে নিয়ে নয় আজ, মনের দুটো কথা বলে সময় কাটালে ক্ষতি কী?

একটু গোড়ার দিকের গল্পই হোক আগে। বাড়ির ছোট ছেলে বলে কথা, তাও আবার সবার চোখের মণি। আভাস থেকে তাই কিশোর হওয়া ছিল এক সহজাত ব্যাপার। বড়-দাদা, ‘দাদামণি’ অশোক কুমার তখন আবার খান্ডোয়া থেকে পাকাপাকি মুম্বই পাড়ি দিয়েছেন ‘রুপোলি পর্দার নায়ক’ হওয়ার আশায়। নাম ডাকও হচ্ছে ধীরে ধীরে। সময়টা তখন ১৯৩৬। ওদিকে দেশে ছোট্ট কিশোর তখন দাদার কীর্তিকলাপের কথাও জেনেছে কিছু কিছু।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১০: আমাদের কোনও শাখা নেই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩১: বিড়াল ঘাঁটলেই কি ডিপথেরিয়া হতে পারে?

দেশের আর সব জায়গার মতোই দাদামণির ‘জীবন নাইয়া’ মুক্তি পেল খান্ডোয়াতেও। বছর সাতেকের কিশোরকে তখন পায় কে? ওই বয়সেই বন্ধুবান্ধব, বাড়ির বড়দের সঙ্গে সিনেমা হলে দেখতে ছুটলেন, দাদামণিকে। অনেক প্রত্যাশা। আর পাঁচটা পর্দার নায়ক মানে তথাকথিত মাস্টার ভিঠাল বা রাজা স্যান্ডোর মতই নাচগান, খলনায়ককে কুপোকাত করে কিশোর ও তার বন্ধুদের মনোরঞ্জন করবেন পুরোদস্তুর। এই ছিল প্রত্যাশা, গর্বে আকাশ ছোঁবে কিশোরের মাথা।

কিন্তু কোথায় কী? এ যে নেহাতই এক অন্য ধারার বাস্তবিক ছবি। উল্টে অশোক গাল পেতে চড় পর্যন্ত খেলেন। ছি ছি। রেগে তেলেবেগুন কিশোর সে রাতেই দাদামণি অশোককে সোজাসাপ্টা চিঠি লিখলেন মুম্বইতে। যার মুখ্য ভাব হল— বন্ধুদের সামনে যে ভাবে তার আজ মাথা হেঁট হল, সেই অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি শীঘ্রই যেন পাতে দেওয়ার মতো একটি ছবি করেন নতুবা কোনওদিন খান্ডোয়াতে ফেরার কথা মন থেকে মুছে ফেলেন।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৪: রাজ পরিবারের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ও ব্রাহ্মবাদ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫: চন্দ্রমণির বধূবরণ

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা যায়, এই ‘জীবন নাইয়া’ ছবিতেই অশোক কুমার গাইলেন সেই বিখ্যাত গানটি, ‘কোই হামদাম না রাহা।’ যে গানটি গেয়ে ছোট থেকেই রেওয়াজ করতেন কিশোর এবং পরবর্তীকালে দাদামণির অনুমতি নিয় ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ঝুমরু’ ছবিতে নিজেই গানটি আবার গাইলেন কিশোর। বাকিটা ইতিহাস।

এবার একটু শোনা যাক তাঁর গানের শুরুর গল্প। দাদামণির মতে, ছোটবেলায় কিশোর খুব সর্দি, কাশিতে ভুগতেন। তখন তাঁর গলার স্বরও ছিল খুব তীক্ষ্ণ। দাদামণি নিজে ছোট থেকেই রীতিমতো সংগীতের তালিম নিলেও, কিশোরের গায়ক হয়ে ওঠা ছিল তার কল্পনাতীত।—চলবে।
* ঋত্বিক চক্রবর্তী, পেশাগত ভাবে একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কর্মসূত্রেই স্পেনে থাকা। কাজের কাজ ও অকাজ করে সময় পেলেই বইপড়া, গান শোনার চেষ্টা আর পাঁচটা বাঙালির মতোই মজ্জাগত। রুজি রোজগারের বাইরে নিজের মনের জন্য কিছু পুষ্টি সঞ্চয়ে উন্মুখ। তাই পেশা আর নেশার টানাপোড়েনে পড়ে থাকা আর এক বাঙালি।

Skip to content