বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ। ছবি: সংগৃহীত।

ত্রিপুরার রাজবংশের কীর্তি-কাহিনি নির্ভর কাব্যগাঁথা রাজমালা’য় ১৮৪ জন রাজার নাম রয়েছে। ত্রিপুরার রাজাগণ একদা ‘ফা’ উপাধি ধারণ করতেন। তারপর একদিন ‘ফা’ ছেড়ে তারা মাণিক্য উপাধি ধারণ করতে শুরু করেন। রাজমালা অনুসারে প্রথম রাজা রত্ন ‘ফা’ মাণিক্য উপাধি ধারণ করেন। গৌড়াধিপতির সহায়তায় তিনি ভাইদের পরাস্ত করে বসেছিলেন ত্রিপুরার সিংহাসনে। তারপর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কয়েকটি হাতি ও একটি মূল্যবান মণি উপহার দিয়েছিলেন গৌড়াধিপতিকে। উপহারে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তখন ত্রিপুরার রাজাকে দিলেন ‘মাণিক্য’ উপাধি। রত্ন ‘ফা’ তারপরই হলেন রত্ন মাণিক্য। কিন্তু এ নিয়ে দ্বিমত আছে। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, মহা মাণিক্য হলেন ত্রিপুরার প্রথম মাণিক্য রাজা।
রাজমালা অনুসারে তাঁর নাম ‘ছেংথুম ফা’। তিনি পরাক্রমশালী নৃপতি ছিলেন। প্রাচীন কমলাঙ্ক রাজ্য জয় করে মেঘনার তীর পর্যন্ত ত্রিপুরার সীমা বিস্তার করেছিলেন এই রাজা। ‘ছেংথুম ফা’র সঙ্গে গৌড়েশ্বরের প্রবল যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধের কারণ হীরাবন্ত খাঁ নামে এক জমিদারের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজার বিরোধ। হীরাবন্তের সঙ্গে খুব দহরম মহরম ছিল গৌড়াধিপতির। হঠাৎ একদিন ত্রিপুরার সৈন্য বাহিনী মেহেরকুল আক্রমণ করে লুঠ করে নিয়ে এল হীরাবন্তের সম্পদ। পরাজিত হীরাবন্ত আশ্রয় নিল গৌড়েশ্বরের কাছে। এ বার ক্রুদ্ধ হলেন গৌড়ের শাসক। গৌড় বাহিনীকে তিনি ত্রিপুরা আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। একদিন বিশাল গৌড় বাহিনী ধেয়ে এল ত্রিপুরার দিকে।ভয় পেয়ে গেলেন রাজা। তিনি চাইলেন সন্ধি করতে। কিন্তু এই খবর শুনে মহারানি মহাদেবী নিতান্ত রুষ্ট হলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৯: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-ইতিহাস

রানি জানালেন, তিনি স্বয়ং যুদ্ধে যাবেন। এ বার রানির কথায় যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠল। মহারানি মহাদেবী হাতির পিঠে চড়ে স্বয়ং যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। অবশেষে রাজাও তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে গেলেন। এই যুদ্ধে ত্রিপুরার বিজয় ঘটেছিল। বাংলার তুর্কি শাসকদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকে ইন্দো-মঙ্গোলীয়দের প্রথম বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। হীরাবন্ত সম্পর্কে কৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্ৰন্থে লিখেছেন যে, ত্রিপুরেশ্বরের অধিকৃত অঞ্চলে হীরাবন্ত নামে এক ধনী ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি বঙ্গেশ্বরের প্রধান কর্মচারী ও বিশেষ পরাক্রমশালী ছিলেন। ত্রিপুরার রাজার প্রতি হীরাবন্ত অবজ্ঞা প্রদর্শন করায় সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিকে তিনি রাজত্ব করেছিলেন বলে জানা যায়।
১৪০০-৩০ খ্রিস্টাব্দ তাঁর রাজত্বকাল বলে ধরা হয়ে থাকে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো ঐতিহাসিকদের মতে, ত্রিপুরার প্রথম মাণিক্য উপাধিধারী রাজা ছিলেন মহা মাণিক্য। তিনি শ্রীহট্ট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জয় করে এক নতুন রাজ্যের পত্তন করেছিলেন। কিন্তু কোনো তাম্রলিপি বা প্রত্ন নিদর্শন আবিষ্কৃত না হওয়ায় তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায়নি।

ছেংথুম ফা বা মহা মাণিক্যের পর রাজা হলেন তাঁর পুত্র ধর্ম মাণিক্য, যাকে ‘রাজমালা’য় ডাঙ্গর ফা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৪৩১-৬২ খ্রিস্টাব্দ তাঁর রাজত্বকাল। ‘রাজমালা’র জন্য ত্রিপুরার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন তিনি। তাঁর নির্দেশেই পণ্ডিত শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর রাজপুরোহিত দুর্লভেন্দ্রের সহায়তায় ত্রিপুরার রাজবংশের কীর্তি কাহিনি নিয়ে কাব্য গাঁথা ‘রাজমালা’ রচনা করেছিলেন। ধর্ম মাণিক্য প্রজা কল্যাণে অনেক কাজ করেছিলেন। প্রজাদের জলকষ্ট দূর করতে খনন করিয়েছিলেন সরোবর। বারাণসী থেকে আসা আটজন কান্যকুব্জীয় ব্রাহ্মণকে তাম্রশাসনের মাধ্যমে ভূমিদান করেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৫: রাণুর মধ্যে মাধুরী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৩: ক্রোধ ও ক্ষমা, কোনটির প্রভাব বেশি? হিংসা ও প্রতিহিংসার ফল কী সুদূরপ্রসারী?

বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চল তখন ত্রিপুরার অধীনে ছিল। কুমিল্লা শহরের ধর্ম সাগর আজও তাঁর কীর্তির সাক্ষ্য বহন করছে। ধর্ম মাণিক্য একজন পরাক্রমশালী নৃপতি ছিলেন। তিনি বঙ্গদেশ আক্রমণ করে সুলতানকে পরাস্ত করেছিলেন। রাজধানী সুবর্ণগ্রাম অভিযান ও লুণ্ঠন করে রাজ্যে ফিরে এসেছিলেন বিজয়ীর বেশে। এমনকি, আরাকানপতিও একবার তাঁর হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে পরাক্রমশালী ধর্ম মাণিক্যের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আরাকানপতি তখন ব্রহ্মরাজ কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত ছিলেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য ত্রিপুরার রাজার সহায়তায় সিংহাসন ফিরে পেয়েছিলেন আরাকানরাজ। ধর্ম মাণিক্যের বীরত্বের কথা তখন ত্রিপুরার গন্ডী ছাড়িয়ে আরাকান, ব্রহ্মদেশ ও বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। নিজেও ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ। বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনি পণ্ডিতদের নিয়ে এসেছিলেন তাঁর রাজসভায়।
পরবর্তী রাজা রত্ন মাণিক্যই ত্রিপুরার প্রথম মাণিক্য রাজা যিনি নিজস্ব মুদ্রা তৈরি করিয়েছিলেন। ১৪৬৪ থেকে ১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রত্ন মাণিক্যের তৈরি কয়েকটি মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে এটা স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দ বা তার কিছু আগে রত্ন মাণিক্য সিংহাসনে বসেছিলেন। ‘রাজমালা’ অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে তিনিই ধর্ম মাণিক্য। ‘রাজমালা’য় বলা হয়েছে ডাঙ্গর ফা তাঁর আঠারোজন পুত্রের মধ্যে সতেরোজন পুত্রকে রাজ্য ভাগ করে দেন। আর কনিষ্ঠ পুত্র রত্ন ফা-কে দূত করে পাঠিয়ে দিলেন গৌড়ের দরবারে। গৌড়েশ্বর সমাদরে গ্রহণ করলেন ত্রিপুরার রাজপুত্রকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গৌড়েশ্বরের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৪: শোভনাসুন্দরী—ঠাকুরবাড়ির এক সরস্বতী!

একদিন নবাবের সহায়তায় এক বিরাট সৈন্য বাহিনী নিয়ে তিনি ত্রিপুরা অভিযান করলেন। নিজ ভ্রাতাদের পরাজিত করে বসলেন ত্রিপুরার সিংহাসনে। নবাবের সহায়তায় রাজা হতে পেরেছেন রত্ন ফা। তিনি চাইলেন সেই ঋণ শোধ করতে। বহু সংখ্যক হাতি আর একটি মূল্যবান মণি তিনি উপহার দিলেন গৌড়েশ্বরকে। হাতি আর মণি উপহার পেয়ে সন্তুষ্ট নবাব রত্ন ফা-কে উপাধি দিলেন ‘মাণিক্য’। রত্ন ফা হলেন রত্ন মাণিক্য। ‘রাজমালা’ অনুসারে ত্রিপুরার রাজারা তখন থেকেই ‘মাণিক্য’ উপাধি ধারণ করে আসছেন।

রাজমালা গ্রন্থের শেষ পাতা।

যাইহোক, রত্ন মাণিক্যের সময়কাল থেকেই ত্রিপুরার সঙ্গে বঙ্গদেশের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়। গৌড়ের মুসলমান শাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার সূত্রে ত্রিপুরার রাজকার্যেও পার্সি ও বাংলার প্রচলন বাড়তে থাকে। গৌড়েশ্বরের অনুমতিক্রমে রাজা বেশ কিছু বাঙালিকে বঙ্গদেশ থেকে ত্রিপুরায় নিয়ে এসে বসতি স্থাপন করেন। রত্ন মাণিক্যের প্রচারিত মুদ্রায় বাংলা অক্ষর পরিলক্ষিত হয়েছে।

যাইহোক, ত্রিপুরার ‘ফা’ রাজাদের মাণিক্য উপাধি ধারণকাল নিয়ে দ্বিমত থাকলেও এটা স্পষ্ট পঞ্চদশ শতক থেকেই তার শুরু। অর্থাৎ মাণিক্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠা পঞ্চদশ শতকে। সেই থেকে একনাগাড়ে সাড়ে পাঁচশ বছর ধরে একটি রাজ্যে একটি রাজবংশের শাসন নিঃসন্দেহে এক বিরল দৃষ্টান্ত।—চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content