শনিবার ৫ অক্টোবর, ২০২৪


সুন্দরবনে অধুনালুপ্ত শুয়োরে হরিণ।

সুন্দরবনের কথা উঠলেই সবার আগে মনে আসে সুন্দরী গাছ আর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের কথা। সুন্দরবনে উদ্ভিদকূলের রানি যদি হয় সুন্দরী গাছ, তবে প্রাণিকূলের রাজা হল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। তারপরেই বড় আকারের প্রাণীদের মধ্যে আসে খাঁড়ির কুমির, চিতল হরিণ, বানর, বুনো শূকর, মেছো বিড়াল ইত্যাদি বন্য জন্তুর কথা। যদিও আমরা অনেকেই জানি না যে, আমাদের গর্বের সুন্দরবনে মাত্র ১২০-১৫০ বছর আগেও এমন অনেক বৃহদাকার প্রাণী ছিল যেগুলো আজ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন। এই চারটি প্রাণী হল জাভার গন্ডার, বুনো মহিষ, শুয়োরে হরিণ এবং বারশিঙা হরিণ।
সুন্দরবন এক সময় ছিল গন্ডারের বাসভূমি। কথাটা শুনলে অনেকের মনেই খটকা লাগতে বাধ্য। সুন্দরবনে মিষ্টি জলের অভাব। দিনে দু’বার জোয়ারের নোনা জলে প্লাবিত হওয়ায় বেশিরভাগ জায়গা থাকে কর্দমাক্ত। তাছাড়া গন্ডারের খাদ্যযোগ্য ঘাসও এখানে জন্মায় না। তাহলে কী করে গন্ডারের মতো প্রাণী সুন্দরবনে থাকতে পারে? কিন্তু নানা তথ্য থেকে যা জানা গিয়েছে তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো, আর অবিশ্বাস করারও কোনও কারণ নেই।

সুন্দরবনে যে গন্ডার থাকত তা আসলে জাভার গন্ডার। একসময় এই গন্ডারের বিচরণভূমি ছিল ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপ থেকে পশ্চিমে সুন্দরবন পর্যন্ত। আর সুন্দরবন অঞ্চলে যেসব গন্ডার থাকত তারা নিশ্চিতভাবে সুন্দরবনে বসবাসের জন্য অভিযোজিত হয়ে গিয়েছিল। সুন্দরবনে জাভা গন্ডারের উপস্থিতির তথ্য জানা যায় সাতটি জায়গা থেকে যার মধ্যে ভারতীয় সুন্দরবন অঞ্চলে তিনটি স্থান ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে চারটি স্থান।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি

পাখি সব করে রব, পর্ব-১: সবুজ সুন্দরী মুনিয়া

সাগরদ্বীপে গন্ডার ছিল বললে আজ অনেকেই বিশ্বাস করবে না। জলবেষ্টিত দ্বীপে গন্ডার আসবে কী করে? কিন্তু ১৮৩২ সালের ১৬ মার্চ তারিখে ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকার প্রকাশককে লেখা এক চিঠিতে জনৈক শিকারী লিখেছেন যে, সাগরের এডমন্ডস্টোন দ্বীপের মিডলটন পয়েন্টে তিনি এক গণ্ডারের উপস্থিতির খবর পেয়ে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দেন। অনেক চেষ্টার পর তিনি গুলি করে ১৩ ফুট লম্বা ও ৭ ফুট উঁচু গন্ডারটিকে হত্যা করেন। তারপর প্রমাণ হিসেবে তার চামড়া ও শৃঙ্গটি কেটে নিয়ে আসেন। ১৮৭৬ সালে লন্ডনের এক বন্যজন্তু ব্যবসায়ী উইলিয়াম জামরাক সুন্দরবন থেকে জীবন্ত গন্ডার ধরে আনার জন্য লোক নিযুক্ত করেন। রায়মঙ্গল নদীর তীর থেকে একটি জাভার গন্ডার ধরতে পারলেও সেটি অচিরেই মারা যায় এবং লন্ডনে কেবল তার চামড়া পৌঁছোয়। তিনি পরের বছর আবার চেষ্টা চালান। এবার জীবন্ত গন্ডার ধরে লন্ডনে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু ছ’মাস তাকে বাঁচিয়ে রাখলেও কেউ কিনতে রাজি হয়নি।

সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত জাভা গন্ডার।

১৮৮৭ সালে তৎকালীন বাংলার পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেকটর জেনারেল এডয়ার্ড বেকার তাঁর স্বরচিত গ্রন্থে লিখেছেন, বারুইপুর থেকে ছ’মাইল দক্ষিণে গ্রামবাসীরা পিয়ালি নদীর ধারে এক জঙ্গলের মধ্যে একটি বিশালাকার পুরুষ গন্ডার দেখেছিল। কলকাতা, বার্লিন ও লন্ডন জাদুঘরে সুন্দরবন থেকে পাওয়া এগারোটি জাভা গন্ডারের নমুনা সংরক্ষিত আছে। কলকাতা জাদুঘরে সংরক্ষিত নমুনার সংখ্যা সাতটি, যেগুলি ১৮৩৪ থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে সংগৃহীত। আর বার্লিন ও লন্ডন জাদুঘরে রয়েছে দুটি করে নমুনা, যেগুলির সংগ্রহকাল ১৮২৮ থেকে ১৮৭৬ সালের মধ্যে।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১০: আমাদের কোনও শাখা নেই

জাভা গন্ডার চেহারায় ভারতীয় গন্ডারের চেয়ে অনেকটা ছোট। পুরুষ জাভা গন্ডারের একটা শৃঙ্গ থাকলেও তা ভারতীয় গন্ডারের শৃঙ্গের চেয়ে অনেক ছোট। আর স্ত্রী গন্ডারের শৃঙ্গ থাকে না, কেবল নাকের উপর দু’এক ইঞ্চি উপবৃদ্ধি দেখা যায়। অন্যান্য প্রজাতির গন্ডারের মতো এদেরও ঘ্রাণ ও শ্রবণশক্তি প্রখর কিন্তু দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। এদের গড় আয়ু ৩০-৪৫ বছর। জাভা দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে উজুং কুলন জাতীয় উদ্যান ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও জাভার গন্ডার বর্তমানে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে নেই। সুন্দরবন থেকে এদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণ কী হত্যা? বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত মিষ্টি জলের অভাব ও বাসস্থান ধ্বংস এদের চরম বিপন্ন করে তোলে। তারপর আন্তর্জাতিক বাজারে শৃঙ্গ ও চামড়ার প্রবল চাহিদার জন্য নির্মম হত্যাকাণ্ড ওদের নিশ্চিহ্ন হওয়াকে ত্বরান্বিত করেছে।

বিশ শতকের শেষার্ধে সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হওয়া বারশিঙ্গা হরিণ।

সুন্দরবন এক সময় ছিল প্রচুর বুনো মহিষের আস্তানা। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অন্যতম খাদ্য ছিল বুনো মহিষ। এই বুনো মহিষ থেকেই প্রায় ৬৩০০ বছর আগে পোষা জল-মহিষের উৎপত্তি হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই বিবর্তন ঘটেছে ভারতীয় উপমহাদেশেই। তবে শুধু সুন্দরবন থেকে নয়, অন্যান্য বহু জায়গা থেকেও বুনো মহিষ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সারা পৃথিবীতে এখন মাত্র প্রায় ৩৪০০ টি বুনো মহিষ বেঁচে আছে, যেগুলির মধ্যে ৩১০০টি রয়েছে অসমে। এরা লম্বায় প্রায় ৮-১০ ফুট এবং উচ্চতায় প্রায় ৫-৬ ফুট হয়। ওজন হয় ৬-১২ কুইন্ট্যাল। এদের স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে বিশাল লম্বা শিং থাকে যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ ফুট! এরা সাধারণত দলবদ্ধ প্রাণী। এক একটা দলে ৩০-৫০০টি বুনো মহিষ থাকতে পারে। সুন্দরবন অঞ্চলের বহু জায়গায় মাটির নীচে বুনো মহিষের হাড় পাওয়া গিয়েছে। সম্ভবত বাসস্থান ধ্বংসের কারণে ও খাদ্যাভাবে সুন্দরবনে এদের বিলুপ্তি ত্বরান্বিত হয়েছে। ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের পূর্বভাগে এদের দেখতে পাওয়া গেলেও এখন সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩১: বিড়াল ঘাঁটলেই কি ডিপথেরিয়া হতে পারে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

সুন্দরবনে একসময় অদ্ভুত সুন্দর একপ্রকার হরিণ দেখা যেত। ছোটখাট আকারের এই হরিণ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড়োনোর সময় মাথাটাকে শূকরের মতো নীচু করে দৌড়োয় বলে এর নাম শুয়োরে-হরিণ বা হগ-ডিয়ার। বাকি সব প্রজাতির হরিণ যেখানে জঙ্গলের বাধা মাথা উঁচু করে লাফিয়ে অতিক্রম করে, এরা বাধার তলা দিয়ে মাথা নীচু করে গলে যায়। এদের উচ্চতা ২৪-২৮ ইঞ্চি, ওজন ৩০-৫০ কেজি। দেহের তুলনায় পাগুলো কিছুটা ছোট। বিপদ বুঝলে এরা গলা দিয়ে অদ্ভুত এক শব্দ বার করে অন্যদের সতর্ক করে। তবে বিপদের সময় এরা অন্যান্য হরিণের মতো জোট না বেঁধে একাই পালায়। সুন্দরবনে একসময় প্রচুর শুয়োরে হরিণ পাওয়া যেত। সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে জনপদ গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে এদের বাসস্থান যত সঙ্কুচিত হয়েছে ততই এরা হারিয়ে গিয়েছে। গত শতাব্দীতে বাংলাদেশে কোথাও কোথাও শুয়োরে হরিণ দেখা যেত। ২০০০ সালে এদের বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

সুন্দরবনে বিলুপ্ত বুনো মহিষ।

সুন্দরবনে গত শতাব্দীর প্রথম দিকে আরও এক সুন্দর দেখতে হরিণের প্রজাতি ছিল। শাখা-প্রশাখাযুক্ত প্রায় আড়াই ফুট লম্বা শিং এদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। চেহারাতেও এরা বেশ বড়ো, প্রায় ৩.৫-৪ ফুট উঁচু ও প্রায় ৬ ফুট লম্বা। জঙ্গল ও তৃণভূমি ছাড়াও এদের জঙ্গল-সন্নিহিত অঞ্চলে যেখানে জলাভূমি রয়েছে সেখানে এদের দেখা যায় বলে ইংরেজিতে এদের বলে সোয়াম্প ডিয়ার, বাংলায় জলাভূমির হরিণ। সুন্দর শিংয়ের জন্য এদের বারশিঙ্গা হরিণও বলা হয়। ভারতে কোনও কোনও সংরক্ষিত বনে এদের দেখা মিললেও সুন্দরবন থেকে এরা গত শতাব্দীর শেষের দিকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। জঙ্গল ধ্বংস করে জনবসতি গড়ে তোলার জন্য এদের বাসস্থান সঙ্কোচন হয়েছে। মানুষ শিকারও করেছে ব্যাপক হারে। আর তাই আজ ওরা সুন্দরবন থেকে নিশ্চিহ্ন।

প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও মানুষের কারণে এত দ্রুত সুন্দরবনের বাস্তুতান্ত্রিক পরিবর্তন হচ্ছে যে, আগামীদিনে আরও অনেক প্রজাতি এই তালিকায় নাম লেখাতে পারে। আমাদের সচেতনতা ও সহমর্মিতা পারে ওদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে।—চলবে।

সব ছবি: সংগৃহীত।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content