সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ।
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য বা বাদাবন হিসেবে সুন্দরবনের খ্যাতি জগৎজোড়া। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি হল আমাদের গর্বের সুন্দরবন। আবার অসংখ্য নদী-খাঁড়ি ঘেরা এই সুন্দরবনের গহন অরণ্যের অনেক স্থান এখনও মানুষের পদচিহ্নবিহীন, বিপদসঙ্কুল। এই অরণ্যের রাজা হল ‘সুন্দরবনের প্রহরী’ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। হাজারো উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবন হল বিশ্বের বিস্ময়।
বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের যে অংশটিকে আমরা সুন্দরবন বলে জানি, তা কিন্তু সুদীর্ঘকাল আগে এমনটা ছিল না। গাঙ্গেয় উপদ্বীপে সুন্দরবন বহুবার উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়েছে, আবার দক্ষিণ দিকে সরে এসেছে। সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থানটি কমপক্ষে ৪০০ বছরের পুরানো অবস্থান। ভূমির অবনমন, ঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প এবং আরাকান ও পর্তুগিজ দস্যুদের অবাধ লুণ্ঠন সুন্দরবনকে বহুবার ধ্বংস করেছে। তারপর ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংস হওয়া সুন্দরবনের উপরে আবার নতুন করে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। কিন্তু এই যে আমরা ভারত-বাংলাদেশের উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে বলছি সুন্দরবন তা কি সুদূর অতীতকাল থেকে এই নামেই পরিচিত ছিল? উত্তর হল, না।
ইদিলপুরের তাম্রশাসন যেখানে চন্দভন্দ জাতির কথা লেখা রয়েছে।
কোনও অঞ্চলের নামকরণ করে মানুষ। সুতরাং সুন্দরবনে মানুষের বসতি হওয়ার পর থেকেই ওই অঞ্চলের নামকরণ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সুন্দরবন অঞ্চলের জনপদ বহুবার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং জনপদ ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের সেই সময়ের নামেরও অবলুপ্তি হওয়া স্বাভাবিক। আজ আমরা যে সুন্দরবনকে দেখি তা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের সুন্দরবন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে এই অঞ্চলে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল তা আজ প্রমাণিত। সুতরাং সেই সময় ওই অঞ্চলের নামও ছিল।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪: সুন্দরবনের লবণ-বৃত্তান্ত
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০ অব্দে সংস্কৃত বৈয়াকরণ পানিনি তাঁর পতঞ্জলি মহাভাষ্যে আর্যাবর্তের সীমানা উল্লেখ করার সময় লিখেছেন, পূর্বদিকে ছিল ‘কালকবন’। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ‘কালকবন’-ই হল সুন্দরবন। ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা মহাভারত এবং প্রায় ২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে লেখা রামায়ণে গঙ্গার মোহনায় ‘শাকদ্বীপ’-এর কথা উল্লেখ আছে। অন্যান্য পুরাণেও এই শাকদ্বীপের কথা লেখা আছে। ঐতিহাসিক ধনঞ্জয় দাস মজুমদারের মতে, গুপ্ত যুগে (খ্রিস্টিয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক) আন্দামানে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের দরুণ যে প্রবল ভূমিকম্প হয় তার ফলে প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে শাকদ্বীপ ধ্বংস হয়।
সুন্দরী গাছের ফুল।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, ওই সময় সুন্দরবনের নাম ছিল শাকদ্বীপ। শাকদ্বীপে প্রথম রাজ্য স্থাপন করেন সমুদ্রগুপ্ত। ত্রয়োদশ শতক থেকে বাংলা তথা দেশে মুসলমান শাসনকালে সুন্দরবন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা পরিচিত ছিল ‘ভাটিপ্রদেশ’ নামে। এই অঞ্চলের সমস্ত নদীতে দক্ষিণদিকে ভাটা হয় বলে দক্ষিণের প্রদেশকে ভাটিপ্রদেশ বলা হত। মোগলযুগে এই অঞ্চলে বারো ভুঁইয়ার নাম অনুসারে দক্ষিণ প্রদেশকে বলা হত ‘বারো ভাটি বাংলা’।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!
কলকাতার পথ-হেঁশেল: যাদবপুর—যদুকুল ও চপস্টিকস
পাখি সব করে রব, পর্ব-২: দুর্লভ পরিযায়ী পাখি ল্যাপউইং
সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার যেমন প্রাণীদের রাজা তেমনই গাছেদের রানি হল সুন্দরী বৃক্ষ। প্রচণ্ড শক্ত সুন্দরীর কাঠ। তাছাড়া এই কাঠ উইপোকা প্রতিরোধী ও অপচনশীল। এই কারণে সুন্দরী বৃক্ষের কদর অত্যন্ত বেশি। অতি মূল্যবান সুন্দরী কাঠ থেকে নৌকো, আসবাব ইত্যাদি প্রাচীন কাল থেকে তৈরি হয়। তাই অধিকাংশ গবেষকের মতে, সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবন নামের সৃষ্টি হয়েছে।
অনেক সমালোচক বলেন, সুন্দরবনের সর্বত্র তো সুন্দরী গাছ নেই, তাহলে সমগ্র উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ অরণ্যের নাম কেন সুন্দরবন হল? আসলে সুদূর অতীতে পুরো সুন্দরবন অঞ্চল জুড়ে সুন্দরী বৃক্ষই ছিল প্রধান উদ্ভিদ। বর্তমানে ভৌগোলিক কারণে সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে সুন্দরী গাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে এখন সুন্দরী বৃক্ষের প্রাধান্য। এক সময় দুই চব্বিশ পরগনার সুন্দরবনে যে সুন্দরী গাছ প্রচুর পরিমাণে ছিল তার প্রমাণ আজও পাওয়া যায়। পুকুর, খাল ইত্যাদি খনন করার সময় মাটির ৮-১০ ফুট গভীর থেকে সুন্দরী গাছের মূলসহ গুঁড়ির কিছুটা অংশ আজও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। আমাদের দুটি পুকুরেই একাধিক এমন গুঁড়ি পাওয়া গিয়েছিল।
অনেক সমালোচক বলেন, সুন্দরবনের সর্বত্র তো সুন্দরী গাছ নেই, তাহলে সমগ্র উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ অরণ্যের নাম কেন সুন্দরবন হল? আসলে সুদূর অতীতে পুরো সুন্দরবন অঞ্চল জুড়ে সুন্দরী বৃক্ষই ছিল প্রধান উদ্ভিদ। বর্তমানে ভৌগোলিক কারণে সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে সুন্দরী গাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে এখন সুন্দরী বৃক্ষের প্রাধান্য। এক সময় দুই চব্বিশ পরগনার সুন্দরবনে যে সুন্দরী গাছ প্রচুর পরিমাণে ছিল তার প্রমাণ আজও পাওয়া যায়। পুকুর, খাল ইত্যাদি খনন করার সময় মাটির ৮-১০ ফুট গভীর থেকে সুন্দরী গাছের মূলসহ গুঁড়ির কিছুটা অংশ আজও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। আমাদের দুটি পুকুরেই একাধিক এমন গুঁড়ি পাওয়া গিয়েছিল।
বাংলাদেশে সুগন্ধা শক্তিপীঠ মন্দির (নবনির্মিত)।
কারও কারও মতে, ‘সমুদ্রবন’ শব্দ থেকে সুন্দরবন শব্দের উৎপত্তি। সাধারণ মানুষ সমুদ্রকে বলে সমুন্দুর। তাই সমুদ্রবন শব্দের অপভ্রংশ থেকে (সমুদ্রবন > সমুন্দুরবন > সুন্দরবন) সুন্দরবন কথাটি এসেছে। ঐতিহাসিক বিভারিজের মতে, বর্তমান বাংলাদেশের বাখেরগঞ্জে সুন্ধা নামে এক প্রবল নদী থেকে সুন্দরবন শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে ওই নদীর কূলে সতীমাতার ছিন্ন নাসিকা এসে পড়ে বলে সেখানে সতীর একটি পীঠস্থান গড়ে ওঠে এবং ওই স্থান ও নদীর নাম হয় সুগন্ধা। এই হিন্দু মন্দির সুগন্ধা শক্তিপীঠ নামে পরিচিত। অবশ্য প্রাচীন মন্দির ও মূর্তি বর্তমানে আর নেই। সাধারণ লোক সুগন্ধাকে উচ্চারণ করে সুন্ধা। সুন্ধার উপকূলের বনকে তাই লোকে বলত ‘সুন্ধারবন’। তা থেকেই সুন্দরবন নামের উৎপত্তি। তবে এই যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ, সুন্ধার উপকূলের বনকে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও সুন্ধারবন বলবে এটা বাস্তবোচিত নয়।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে ওই নদীর কূলে সতীমাতার ছিন্ন নাসিকা এসে পড়ে বলে সেখানে সতীর একটি পীঠস্থান গড়ে ওঠে এবং ওই স্থান ও নদীর নাম হয় সুগন্ধা। এই হিন্দু মন্দির সুগন্ধা শক্তিপীঠ নামে পরিচিত। অবশ্য প্রাচীন মন্দির ও মূর্তি বর্তমানে আর নেই। সাধারণ লোক সুগন্ধাকে উচ্চারণ করে সুন্ধা। সুন্ধার উপকূলের বনকে তাই লোকে বলত ‘সুন্ধারবন’। তা থেকেই সুন্দরবন নামের উৎপত্তি। তবে এই যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ, সুন্ধার উপকূলের বনকে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও সুন্ধারবন বলবে এটা বাস্তবোচিত নয়।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৮: সাইনাস নাকি কখনওই সারে না?
আবার কারও কারও মতে, বাখেরগঞ্জের দক্ষিণে যে বন ছিল তাকে লোক বলত চন্দ্রদ্বীপ বন, কারণ পূর্বে বাখরগঞ্জ ছিল চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্গত। চন্দ্রদ্বীপবনকে লোকে ছোটো করে বলত ‘চন্দ্রবন’। এই চন্দ্রবনই কালক্রমে সুন্দরবন নাম নিয়েছে। কারও মতে ‘চন্দভন্দ’ নামে লবণ প্রস্তুতকারক এক প্রাচীন জাতির নাম থেকে সুন্দরবন নাম এসেছে। বাখরগঞ্জের পটুয়াখালি এলাকায় এদের বাস ছিল। ইদিলপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে এদের কথা উল্লেখ আছে। তবে এইসব যুক্তি বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মানেন না।
সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে (প্রথম খণ্ড) লিখেছেন—“সুন্দরী কাষ্ঠ সুন্দরবনের রাজা এবং তাহারই নামানুসারে সুন্দরবন নাম হওয়া সঙ্গত ও স্বাভাবিক।” এ এফ এম আবদুল জলিল-ও তাঁর ‘সুন্দরবন’ গ্রন্থে লিখেছেন—“যুগ যুগ ধরিয়া ইহাই প্রমাণিত হইয়াছে যে, সুন্দরী বৃক্ষ সর্বত্র বিদ্যমান ছিল। সুন্দরীই সুন্দরবনে কাঠের রাজা বা সর্বোৎকৃষ্ট কাঠ এবং তজ্জন্য বনবিভাগের সুন্দরবন হওয়া যুক্তিযুক্ত ও স্বাভাবিক।”
সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে (প্রথম খণ্ড) লিখেছেন—“সুন্দরী কাষ্ঠ সুন্দরবনের রাজা এবং তাহারই নামানুসারে সুন্দরবন নাম হওয়া সঙ্গত ও স্বাভাবিক।” এ এফ এম আবদুল জলিল-ও তাঁর ‘সুন্দরবন’ গ্রন্থে লিখেছেন—“যুগ যুগ ধরিয়া ইহাই প্রমাণিত হইয়াছে যে, সুন্দরী বৃক্ষ সর্বত্র বিদ্যমান ছিল। সুন্দরীই সুন্দরবনে কাঠের রাজা বা সর্বোৎকৃষ্ট কাঠ এবং তজ্জন্য বনবিভাগের সুন্দরবন হওয়া যুক্তিযুক্ত ও স্বাভাবিক।”
পুকুরের নীচে পাওয়া কয়েকশো বছরের পুরানো সুন্দরী গাছের গুঁড়ি।
সুন্দরবন নামটি যে অতীতে একাধিক নামে পরিচিত ছিল এবং এটাই যে এই অঞ্চলের সর্বশেষ প্রদত্ত নাম তা নিয়ে দ্বিমত নেই। কথায় বলে—নামে কিবা আসে যায়! সত্যিই তো তাই। ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবেই এই সুন্দরবন একদিন ধ্বংস হবে। আবার কোনওদিন এখানে নতুন করে অরণ্য, নতুন নতুন দ্বীপভূমি ও নতুন জনপদ গড়ে উঠবে। সেদিন নাও থাকতে পারে সুন্দরবন নাম। কিন্তু তাতে সুন্দরবনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে না। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।