সুন্দরবনের বাঘের নিকটাত্মীয় তুষার চিতা। ছবি: সংগৃহীত।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে করা হত যে, বাঘ হল সিংহ, চিতাবাঘ ও জাগুয়ারের ঘনিষ্ট আত্মীয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জিনগত বিশ্লেষণ করে জানা যাচ্ছে, বাঘ ও তুষার চিতা সম্পর্কে অনেক বেশি ঘনিষ্ট। এরা আজ থেকে ২৮.৮ লক্ষ বছর আগে সিংহ, চিতাবাঘ ও জাগুয়ারদের গোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদের সবার পূর্বপুরুষ সম্ভবত উত্তর-মধ্য এশিয়ার কোথাও উৎপত্তিলাভ করেছিল। তবে ওই পূর্বপুরুষ থেকে বাঘ ও তুষার চিতার গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয় মায়োসিন যুগের (২.৩ কোটি থেকে ৫৩ লক্ষ বছর আগে) কোনও এক সময়ে। ২০০৪ সালে চিনের গাংসু প্রদেশ থেকে আবিষ্কৃত হয় ২৫.৫-২১.৬ লক্ষ বছর আগের একটি আদিম বাঘের করোটি। এর নাম দেওয়া হয় লংডান বাঘ (Longdan tiger)। বিজ্ঞানসম্মত নাম দেওয়া হয় Panthera zdanskyi. এই লংডান বাঘই যে বর্তমান সুন্দরবনের বাঘ ও তুষার চিতার পূর্ববর্তী পূর্বপুরুষ সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিঃসন্দেহ।
আজ পৃথিবীতে যত বাঘ আছে তাদের সবার সাধারণ পূর্বপুরুষ এক লক্ষ আট হাজার থেকে বাহাত্তর হাজার বছর আগে বসবাস করত। তাদেরই কোনও একটি অংশ থেকে সুন্দরবনের বাঘ সৃষ্টি হয়। সুন্দরবনের বাঘ ছাড়াও সৃষ্টি হয়েছে আমুর বাঘ, মালয়ের বাঘ, দক্ষিণ চিনের বাঘ, সুমাত্রার বাঘ, ইন্দো-চায়না বাঘ, বালির বাঘ, জাভার বাঘ ও কাস্পিয়ান বাঘ। আমুর বাঘ রয়েছে দক্ষিণ রাশিয়ার পূর্ব প্রান্তে ও উত্তর চিনে। মালয়েশিয়া উপকূলে পাওয়া যায় মালয় বাঘ। দক্ষিণ চিনের বাঘের সংখ্যা নিতান্তই কম। ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপে সুমাত্রার বাঘের দেখা মেলে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, তাইল্যান্ড ও দক্ষিণ-পূর্ব চিনে রয়েছে ইন্দো-চায়না বাঘের বিচরণভূমি। ১৯৩৭ সালে শেষ বালির বাঘ ও ১৮৭০ সালে শেষ জাভার বাঘের মৃত্যু ঘটে। পৃথিবীর বুক থেকে ওরা আজ নিশ্চিহ্ন। কাস্পিয়ান সাগর সংলগ্ন অঞ্চলে এবং তুরস্ক ও উত্তর ইরানে একসময় যথেষ্ট সংখ্যায় কাস্পিয়ান বাঘ থাকলেও সম্ভবত বন্য অবস্থায় এদের আর কেউ বেঁচে নেই। শেষ সদস্যটি সম্ভবতঃ ২০০৩ সালে মারা গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৮: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-পরিচয়
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা
সম্ভবত ১২,০০০ বছর আগে প্লিস্টোসিন যুগের শেষ ভাগে সুন্দরবনের বাঘের কিছু পূর্বপুরুষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে হিমালয় পার হয়ে অরুণাচল প্রদেশ বা আসামের কোনও এক অংশ দিয়ে এসে পৌঁছেছিল ভারত উপমহাদেশে। তারপর তারা ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের নানা বনভূমিতে। এই ধারণার কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে এর থেকে বেশি বয়সের কোনও ব্যাঘ্র-জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়নি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় একটিও বাঘ না থাকলেও ১৯৮২ সালে ওই দেশে কুরুবিতার কাছে একটি বর্জ্যের স্তূপে সুন্দরবনের বাঘের প্রাচীনতম জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, ওই জীবাশ্মটির বয়স প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ বছর। আর ভারতে বাঘের সবচেয়ে পুরানো যে জীবাশ্মটি আবিষ্কৃত হয় তার বয়স প্রায় দশ হাজার বছর। বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্লিস্টোসিন যুগে যখন অতিশীতল হিমযুগ বজায় ছিল সেই সময় সমুদ্রের জলতল অনেক কমে যাওয়ায় ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার স্থলপথে সংযোগ ছিল। আর সেই পথেই সুন্দরবনের বাঘ পৌঁছেছিল শ্রীলঙ্কায়। প্রায় ১১ হাজার ৬৫০ বছর আগে হলোসিন যুগ শুরু হলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়তে শুরু করে। ফলে জলতল বৃদ্ধি পেয়ে ভারত ও শ্রীলঙ্কা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তারপর শ্রীলঙ্কা থেকে কীভাবে সুন্দরবনের বাঘ হারিয়ে গেল সে আজও রহস্য।
বাদাবনের রাজা সুন্দরবনের বাঘ। ছবি: সংগৃহীত।
এদিকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গল বিনাশ করে জনবসতি ও কৃষিজমি তৈরি হওয়ায় হিমালয় পেরিয়ে ভারতে আগত বাঘেদের পপুলেশন কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি পপুলেশন থেকে যায় উত্তর-পূর্ব ভারতে, একটি মধ্য ভারতে এবং আর একটি আমাদের সুন্দরবনের বাদাবনে। তবে আড়াইশো-তিনশো বছর আগে সুন্দরবন কিন্তু কলকাতা পেরিয়ে উত্তরেও বিস্তৃত ছিল। ফলে সুন্দরবনের বাঘের বিচরণভূমি ছিল বর্তমানের উত্তর ২৪ পরগনা ও কলকাতাতেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনের বাঘ মধ্য ও উত্তর-পূর্বের বাঘেদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় গত ২০০০ বছরের মধ্যে। তারপর বাদাবনের অনন্য পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য তার অসাধারণ অভিযোজন হয়েছে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৪: সে যেন অন্য এক ‘পূনর্মিলন’
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?
১৭৩৮ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘The Gentlemans’ Magazine’-এ লেখা হয় যে ১৭৩৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এক ভয়ানক ঝড় ও ভয়ানক ভূমিকম্পের যৌথ হানায় সরকারি হিসেবে ৩০০০ মানুষ মারা যায় (বেসরকারি মতে আরও অনেক গুণ বেশি)। আর তার সঙ্গে জলে ডুবে মারা যায় সুন্দরবনের অসংখ্য বাঘ ও গন্ডার। কলকাতা শহর গড়ে ওঠার আগে গোবিন্দপুর গ্রাম নাকি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। সেই জঙ্গল ছিল সুন্দরবনের বাঘেদের বিচরণভূমি। আজ যেখানে ফোর্ট উইলিয়াম সেখানে ছিল বাঘেদের নিশ্চিন্ত আস্তানা। বর্তমান সল্ট লেক অঞ্চলও ছিল একসময় বাদাবন ও সুন্দরবনের বাঘ অধ্যুষিত এলাকা।
সুন্দরবনের বাঘের পূর্বপুরুষ বিলুপ্ত লংডান বাঘ। ছবি: সংগৃহীত।
১৭৭২ থেকে ১৭৮৫ পর্যন্ত ভারতের বড়লাট স্যার ওয়ারেন হেস্টিংসের লেখা ব্যক্তিগত চিঠিপত্র থেকে জানা যায় তিনি হুগলি জেলার চুঁচুড়াতে গুলি করে চারটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, কয়েক শতাব্দী আগেও সুন্দরবন তথা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বিস্তার ছিল বহুদূর পর্যন্ত। বর্তমানে কলকাতার যেখানে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল গির্জা রয়েছে সেখানেও নাকি হেস্টিংস গুলি করে একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে মেরেছিলেন। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত গঙ্গার দু’পাড়েই ছিল জঙ্গল, আর তাতে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার নির্ভয়ে বিচরণ করত।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৩: ক্রোধ ও ক্ষমা, কোনটির প্রভাব বেশি? হিংসা ও প্রতিহিংসার ফল কী সুদূরপ্রসারী?
এখন সাগরদ্বীপে কোনও অরণ্য নেই। কিন্তু ২৩২ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৯২ সালে মুনরো নামে এক শিকারী সাগরদ্বীপে বাঘ শিকারে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা যান। এ সংবাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময় যে সব নাবিক ভুল করে সাগরদ্বীপের পশ্চিমদিকে মিডলটন পয়েন্টের কাছে নামতেন তাঁরা প্রায়শই সুন্দরবনের বাঘের আক্রমণের মুখে পড়তেন। ১৮১৯ সালে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় ছাপা হয় এক সংবাদ— উত্তর কলকাতার গৌরীপুরে বাঘের আক্রমণে এক মহিলা নিহত। এই সব তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে দুই-আড়াই শতক আগেও কলকাতাবাসীরা সন্ধেবেলা বাঘের ভয়ে তটস্থ থাকত।
ওড়িশার সিমলিপাল অভয়ারণ্যে মৃত কালো বাঘ। ছবি: সংগৃহীত।
জর্জ ইউল নামে এক ব্রিটিশ রাজকর্মচারী তাঁর পঁচিশ বছরের কর্মজীবনে নাকি চারশোর বেশি সুন্দরবনের বাঘ হত্যা করেছিলেন। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণ দিকের সমস্ত জেলাতেই ছিল বাঘের উপদ্রব। মানুষ তাদের শত্রু বলে মনে করত। আর তাই তাদের সুযোগ পেলেই হত্যা করত। মানবসভ্যতার উন্নয়ন সেই বাদাবন আর তার পাহারাদার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে করে দিয়েছে কোণঠাসা। মানুষের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পেতে বাঘেরা ভেবেছিল দক্ষিণ বাদাবনের গহন অরণ্য হবে নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল। কিন্তু তা আর হল কই? গত এক শতকে দক্ষিণ দিকে কোনঠাসা করতে করতে মানুষ মাত্র কয়েকটি দ্বীপের বাদাবনে তাদের আবদ্ধ করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৪: শোভনাসুন্দরী—ঠাকুরবাড়ির এক সরস্বতী!
অতীতে আমাদের দেশে সাদা বাঘ দেখা গেলেও এখন চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোনও অরণ্যে সাদা বাঘের অস্তিত্ব নেই। অনেকের ধারণা রয়েছে যে সাদা বাঘ হল অ্যালবিনো (Albino) বাঘ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বাঘ সাদা হয় জিনের মিউটেশনের কারণে। আর তাই এদের গায়ে হলুদের পরিবর্তে সাদা লোমের উপর যথারীতি কালো ডোরা রয়েছে। যদি প্রকৃত অ্যালবিনো হত তবে পুরোপুরি সাদা হত, কালো ডোরা থাকত না। কিন্তু বাঘপ্রেমীদের কাছে হতাশার খবর হল সুন্দরবনে কোনও সাদা বাঘের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে এদেশে কালো বাঘ দেখা যায়। যেমন ওড়িশার সিমলিপাল অভয়ারণ্যে কালো বাঘ রয়েছে। সে কালো কিন্তু কালো চিতাবাঘের মতো কুচকুচে কালো নয়। কালো ডোরাগুলো এত বেশি ও ঘন যে সেগুলো পরষ্পর জুড়ে গিয়েছে।
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের রাজকীয় রূপ। ছবি: সংগৃহীত।
স্বাধীনোত্তর ভারতে এক নথি (প্রেটার, ১৯৩৭) থেকে জানা যায় যে বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা বা বাখেরগঞ্জ এলাকায় একটি বাদামি রঙের বাঘ দেখা গিয়েছিল যার গায়ে নাকি কোনও কালো ডোরা ছিল না। ১৯৩৬ সালে ১৬ অক্টোবরের ‘টাইমস’ খবরের কাগজে সম্পাদকীয় এক পত্রে বিষয়টি জানা যায়। এমন রঙের জন্য বাঘটি জঙ্গলের ঝোপের মধ্যে আলো-আঁধারি পরিবেশে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারত না। বরং বালিময় অঞ্চলে তার রং অনেকটা মিশে যেত বলে ওইরকম এলাকাতেই সে আত্মগোপন করে থাকত। ২০২০ সালে সাতজেলিয়ার দুই মৎস্যজীবী দাবি করেন, তাঁরা নাকি ঝিলা-২ নম্বর জঙ্গলে এক বিরাট আকারের কালো বাঘ দেখেছেন এবং বাঘটি নাকি তাঁদের এক সঙ্গীকে আক্রমণ করে জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। তবে তাঁদের বক্তব্যের সত্যতা এখনও প্রমাণিত হয়নি।—চলবে।
>* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।