বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


মাতলার বুকে জেগে ওঠা চর।

সুন্দরবনের নদীর কথা উঠলেই কল্পনাবিলাসী বাঙালির মনে ভেসে ওঠে শিকারের সন্ধানে ওৎ পেতে থাকা নোনা জলের কুমির আর নদীর পাড়ে ম্যানগ্রোভের ঝোপে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এ কল্পনা অমূলক নয়। কিন্তু তা বাদেও সুন্দরবনের নদীর রয়েছে আরও অনেক রূপ ও বৈচিত্র্য। পুরো সুন্দরবন জুড়েই জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় নদী। কিন্তু নদীর সংজ্ঞা সুন্দরবনের সব নদীর ক্ষেত্রে খাটে না। নদী মানেই তা উচ্চগতি থেকে মিষ্টি জল বয়ে নিয়ে সমুদ্রে মোহনায় গিয়ে মেশে।

সুদূর অতীতে হিমালয় এবং ছোটোনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন অনেক নদীর মিষ্টি জলের স্রোত সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে মিশত। কিন্তু বর্তমানে এমন নদীর সংখ্যা মাত্র চারটি—হুগলি, বলেশ্বর, তেতুলিয়া ও মেঘনা। এগুলির মধ্যে একমাত্র হুগলি নদী ছাড়া বাকি তিনটির অবস্থান বাংলাদেশে। মিষ্টি জলের উচ্চগতি রুদ্ধ হওয়ার কারণে সুন্দরবনের অনেক মুখ্য নদী হয় অবলুপ্ত, নয়তো বিপুপ্তির দিন গুনছে। সুন্দরবন সংক্রান্ত নানা দেশি ও বিদেশি লেখকের বই থেকে জানা যায় যে সুন্দরবনে দ্বীপের সংখ্যা ১০২, যার মধ্যে মানুষের বসতি রয়েছে ৫৪টি দ্বীপে আর জঙ্গল রয়েছে ৪৮টি দ্বীপে। কিন্তু বর্তমানে মানুষের বসতিযুক্ত দ্বীপের সংখ্যা ৩৫। এ থেকে বোঝা যায় যে বিগত কয়েক দশকে বেশ কিছু নদী মজে যাওয়ার কারণে কিছু দ্বীপ পরষ্পর জুড়ে গিয়েছে।
বহুকাল আগে হুগলি নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে অনেকগুলি নদী উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। হুগলি নদী-সহ এগুলি হল সুন্দরবনের মুখ্য নদী। হুগলি ছাড়া ভারতীয় অংশের অন্য মুখ্য নদীগুলি হল সপ্তমুখী, ঠাকুরান, মাতলা, বিদ্যা, গোসাবা ও হাড়িভাঙা। আর যে নদীটি একসময় সুন্দরবনের অন্যতম মুখ্য নদী হিসেবে ইতিহাসে ও সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছিল সেটি হল আদি গঙ্গা। বলাবাহুল্য, আদি গঙ্গা আজ লুপ্ত, কেবল রেখে গেছে কলকাতার গার্ডেনরিচ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সূর্যপুর পর্যন্ত তার কিছু স্মৃতি। বলাবাহুল্য, কলকাতার টলির নালা আদি গঙ্গারই বেদনাময় স্মৃতি।

সুন্দরবনের মুখ্য নদীগুলি উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হলেও অন্যান্য নদীগুলির অধিকাংশ পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত। এরা দুটি মুখ্য নদীর মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে বলে এদের বলে দোয়ানি। এই নদীগুলির পূর্ব ও পশ্চিম মুখ দিয়ে একইসঙ্গে জোয়ারের জল প্রবেশ করে এবং ভাটার সময় দুই মুখ দিয়ে সেই জল বেরিয়ে যায়। এ ছাড়াও কিছু সংযোগকারী নদী রয়েছে যেগুলি উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। এদের বলে ভারানি। এদের দক্ষিণ মুখ দিয়ে আগে জোয়ারের জল প্রবেশ করে উত্তর দিকে এগোতে থাকে। উত্তর মুখ দিয়ে জোয়ারের জল প্রবেশ করার আগেই দক্ষিণ মুখ দিয়ে প্রবেশ করা জল সেখানে পৌঁছে যায়।

সুন্দরবনে নদীর জাল গঠন করে রেখেছে এইসব দোয়ানি ও ভারানি। এদের মধ্যবর্তী ভূখন্ডগুলি হল এক একটি দ্বীপ। কোনও দোয়ানি বা ভারানি মজে গেলে উভয় দিকের ভূখন্ড জুড়ে যায়। এভাবেই সুন্দরবনে মানুষের বসতি দ্বীপের সংখ্যা কমেছে নদীর বিলুপ্তির কারণে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল জঙ্গলাবৃত দ্বীপগুলির ক্ষেত্রে তা হয়নি। সুতরাং এ থেকে সিদ্ধান্তে আসা মোটেই কষ্টকর নয় যে মনুষ্য কর্মকান্ডই সুন্দরবন অঞ্চলে নদীর বিলুপ্তি বা বিলুপ্তির সম্ভাবনাকে ত্বরাণ্বিত করেছে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

প্রথমে আসা যাক আদি গঙ্গার কথায়। এই নদীটি কলকাতার দক্ষিণ দিকে গার্ডেনরিচ অঞ্চলের কাছে হুগলি নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে কালীঘাট, বৈষ্ণবঘাটা, বোড়াল, রাজপুর, বারুইপুর, সূর্যপুর, দক্ষিণ বারাসাত, জয়নগর-মজিলপুর, বিষ্ণুপুর, ছত্রভোগ ও খাড়ির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। তারপর এসে মিশেছিল বঙ্গোপসাগরে। ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের বাংলা মঙ্গলকাব্যসমূহে এই নদীর বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন হুগলি নদীর মূল স্রোত আদি গঙ্গা দিয়েই প্রবাহিত হত। আর তাই এই নদী ছিল পবিত্র নদী। নানা মন্দির গড়ে উঠেছিল এই নদীর উভয় তীরে। নদীপথে বানিজ্যের অন্যতম প্রধান পথ ছিল এই নদী। আর তাই এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল নানা সমৃদ্ধ জনপদ এবং হিন্দুমতে শবদেহ সৎকারের জন্য অনেক শ্মশান।

প্রাচীন নানা মানচিত্রে বিষ্ণুপুরের পর খাড়িগ্রাম পর্যন্ত আদি গঙ্গার অবস্থান ও গতিপথ স্পষ্ট বোঝা গেলেও তারপর কোন পথে গিয়ে সমুদ্রে মিশেছিল তা নিয়ে আজও ধন্ধ কাটেনি। একটি মত হল, আদি গঙ্গা মথুরাপুর থানার অধীন খাড়িগ্রামের দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বর্তমানের গোবদিয়া নদীতে মেশে। তারপর ওই প্রবাহ কালনাগিনী নদীর মধ্যে দিয়ে পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হয়ে ঘিবাটি বা ঘিবতি (Ghibati) নদীর মাধ্যমে কাকদ্বীপের কাছে বর্তমানের বড়তলা / মুড়িগঙ্গা নদীতে মেশে। অন্য এক মতে আদিগঙ্গা কুলপি হয়ে সমুদ্রে মিশেছিল। বিভিন্ন মজা বা মজাপ্রায় খাল কিংবা লুপ্তপ্রায় ক্ষীণ স্রোতধারা প্রমাণ হিসেবে আজও রয়ে গেছে। আবার এক মতে আদিগঙ্গা সপ্তমুখী নদী হয়ে সমুদ্রে মেশে। ভৌগোলিক নানা তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের নানা মতামত বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে আদিগঙ্গা সমুদ্রে মেশার আগে অনেকগুলি শাখায় বিভক্ত হয়ে সমুদ্রে মিশেছিল।

এই সব শাখাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কালনাগিনী আর ঘিবতি বা ঘিয়াবতী। নাব্যতায়, বানিজ্যে ও পবিত্রতায় আদিগঙ্গা যে একদা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তথা সুন্দরবন অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী ছিল তা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আজ সেই দুর্দম স্রোতস্বিনী এক আবলুপ্ত প্রত্ন-স্রোতধারা।

চুনপিড়ি ও ঘিয়াবতীর মধ্যে সংযোগকারী নদীর বর্তমান অবস্থা।

কালনাগিনী আর ঘিবতি নদীর প্রসঙ্গ যখন এল এই নদীর কথা কিছু না বললেই নয়। বর্তমানে কালনাগিনী নদী একদিকে গোবদিয়া ও আর একদিকে মুড়িগঙ্গা বা বড়তলা (সাগরদ্বীপের আগে দ্বিধাবিভক্ত হুগলি নদীর পূর্ব শাখা) নদীর সঙ্গে যুক্ত। যদিও আগেই বলা হয়েছে যে, সম্ভবত আদি গঙ্গার ধারা কালনাগিনী হয়ে ঘিবতীর সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ত। গত পাঁচ দশকের মধ্যে কালনাগিনী মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছে। এর কারণ কাকদ্বীপ শহরের যাবতীয় বর্জ্য। দিনের পর দিন এই বর্জ্য কালনাগিনীর বুকে জমে মুড়িগঙ্গার দিকের অংশ প্রায় মজে গিয়েছে। তাছাড়া নদীর উপর ঘরবাড়ি ও দোকান তৈরি হয়েছে। কালনাগিনী আদতে দোয়ানি হলেও এখন কেবল গোবদিয়ার দিক থেকে জোয়ারের জল কালনাগিনীতে ঢোকে। ভাটার সময় কালনাগিনীর পশ্চিম অংশ জলশূন্য হয়ে যায়।

কালনাগিনীর সঙ্গে যুক্ত অপর দুই নদী বা খাল ছিল বাঁশতলা খাল ও বালি খাল। এগুলি এখন প্রায় মজে গেছে। কাকদ্বীপ ব্লকে শিবকালীনগর ও কাশীনগরের মাঝে এক সময় একটি নামহীন নদী মুড়িগঙ্গার সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৬৮ সালে আঁকা মানচিত্রে এর স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও এখন তা প্রায় বিলুপ্ত। ওই মানচিত্রে রামতনুনগরের পুর্বদিকে থাকা সুকনামারি নদীও বর্তমানে অস্ত্বিত্বহীন। আবার পাথরপ্রতিমা ও কাকদ্বীপের মধ্যে বিভাজনকারী গোবদিয়া নদীর এক শাখা কালোয়া বর্তমানে কাশিয়াবাদের কাছ থেকে অতি ক্ষীণস্রোতা হয়ে গিয়েছে। ঘিয়াবতী ও চুনপিড়ি নদীর মধ্যে সংযোগকারী এবং ঘুঘুডাঙা দ্বীপের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি শাখা নদী বা খাল একশো বছর আগেও ছিল প্রবল স্রোতযুক্ত। এটি আমার গ্রামের বাড়ির সামনে দিয়েই প্রবাহিত হত। বর্তমানে এটি সম্পূর্ণ মজে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: ‘সজনী শিন্ডে কা ভাইরাল ভিডিয়ো’ সামাজিক বার্তা দেয়

সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

এ বার আসি ঘিবতী বা ঘিয়াবতীর কথায়। এটি আদি গঙ্গার শেষাংশের নাম। কাকদ্বীপে কালনাগিনী নদীর পরবর্তী অংশ ছিল ঘিবতী বা ঘিয়াবতী। বর্তমানে এই নদী মজে যাওয়া একটি নালা যা স্থানীয়ভাবে ঘিয়াবতী খাল নামে পরিচিত। আজ থেকে অর্ধশতক আগেও ঘিয়াবতীতে নিয়মিত জোয়ারভাটা খেলত। যথেষ্ট নাব্যতা থাকায় বড়ো বড়ো মালবাহী নৌকোও চলাচল করত। কিন্তু বর্তমানে একমাত্র ভরা কটালে ঘিয়াবতীর সামান্য অংশে জোয়ারের জল পৌঁছয়। ১৯৬৮ সালে অঙ্কিত মানচিত্রে দেখা যায় ঘিয়াবতী বিলুপ্তপ্রায় এক প্রাগৈতিহাসিক খাঁড়ি। সহস্রাধিক বছর আগে পলি জমে আদিগঙ্গার মোহনায় যে চর জেগে উঠেছিল তা কালক্রমে ১১০ নম্বর লট (সমগ্র বুধাখালি, প্রসাদপুর, বুদ্ধপুর ও আংশিক রাজনগর গ্রাম) নামে পরিচিত হয় আর আদি গঙ্গার শাখা হিসেবে তৈরি হয়ে যায় ১১১ নম্বর লট বা ঘুঘুডাঙা লাট ও ১১০ নম্বর লটের মধ্যবর্তী ঘিয়াবতী নদী।

নামখানার হরিপুরের পশ্চিমদিকে এক শতক আগে সক্রিয় এক শাখা নদী বা খাল ছিল যা নারায়ণতলা খাল নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এই খাল মজে গেছে। পাতিবুনিয়ার পূর্বদিকে এডোয়ার্ডস ক্রিক বা খাঁড়ি আর হরিপুরের দক্ষিণে আইনস্লে ক্রিক বা খাঁড়ি এক সময় প্রবল বেগবতী থাকলেও এখন সঙ্কীর্ণ জলধারা। নামখানার সি-প্লটের কাছে প্রায় একশো বছর আগেও ছিল সুন্দরিয়া-দোয়ানিয়া নদী বা খাঁড়ি। এটি সপ্তমুখীর সাথে যুক্ত ছিল। এখন এই নদী বিলুপ্ত। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীর সঙ্গে যুক্ত দেবনগর সংলগ্ন শাখা নদী বা খাল কাঁকড়াবুনিয়াও বর্তমানে অতি ক্ষীণকায়া। দুর্গানগর ও ফটিকপুর সংলগ্ন চুনপিড়ি নদী বা খালও ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

কালনাগিনী নদী এখন।

কুলতলির যে বেলেডোনা নদী ৫০/৬০ বছর আগেও যথেষ্ট নাব্য ছিল, নিয়মিত জোয়ার-ভাটা খেলত আজ তা এক মজা খাল। কুলতলিতে হুকাহারানিয়া নদী একটি দোয়ানি নদী। এটি পুবে মাকড়ি ও পশ্চিমে ঠাকুরান নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কিন্তু উভয় মুখে বেঁধে দেওয়ার কারণে এই নদী এখন মৃত। এই কারণে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে ঠাকুরান ও মাকড়ি নদীর কারণে ভাঙন প্রবল আকার ধারণ করেছে। অনুরূপ আর একটি নদী হল পেটকুলচাঁদ। একই কারণে এটিও লুপ্তপ্রায়।
এ দিকে বসতি এলাকায় প্লাবন ও নদীবাঁধ ভাঙনের কারণে নদীর দুই পাড় উঁচু করে বেঁধে দেওয়ার ফলে জোয়ারের জল আর দু’পাশের নীচু এলাকায় প্রবেশ করতে পারে না। ফলে জোয়ারের জলে বাহিত পলি জমছে নদীগর্ভে।

এ ভাবে সুন্দরবনের অনেক দোয়ানি ও ভারানি মজে গিয়েছে বা মজে যেতে বসেছে। আবার প্রাকৃতিক কারণেও বেশ কিছু দোয়ানি ও ভারানি মজে যেতে বসেছে। কারণ উত্তর দিক থেকে মিষ্টি জলের প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই নদীগুলি জোয়ারের জলের উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। জোয়ারের স্রোতের গতিবেগ অনেক বেশি হওয়ায় পলি মিশ্রিত বিপুল জলরাশি জোয়ারের সময় নদীগুলিতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ভাটার স্রোত তুলনায় কম হওয়ায় জলে থাকা পলির অনেকটাই নদীগর্ভে জমা হয়ে যায়। যেমন সামশেরনগরের পুবদিক দিয়ে বয়ে যাওয়া কুড়েখালি নদী এভাবেই মজে যাচ্ছে। চব্বিশ ঘণ্টায় দু’বার করে জোয়ার-ভাটা হয় বলে সুন্দরবনের নদীগুলিতে পলি সঞ্চয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

এই পলি সঞ্চয়ের কারণেই ভারতীয় সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান নদী মাতলা আজ বিলুপ্তির প্রহর গুণছে। এর মাতাল করা ঢেউয়ের জন্যই নাম হয়েছিল মাতলা। কিন্তু এখন এই নদীর বুক থেকে জেগে উঠছে একের পর এক চর। একসময় এর নাব্যতা এতটাই বেশি ছিল যে ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশরা কলকাতা বন্দরের পরিপূরক হিসেবে ক্যানিং বন্দর তৈরি করার পরিকল্পনা করে। এজন্য ভারতের দ্বিতীয় রেলপথ হিসেবে শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হয়। যদিও সামুদ্রিক সাইক্লোনের প্রকোপে ব্রিটিশরা সেই পরিকল্পনা বাতিল করে, কিন্তু সুন্দরবনের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোহনা সম্বলিত অতীতের সুগভীর মাতলা নদীর নাব্যতা আজ নেই বললেই চলে। ক্যানিং শহরের সম্প্রসারণ ক্রমশ গ্রাস করেছে মাতলাকে। কোথাও নদীর প্রবাহকে বাঁধ দিয়ে রুদ্ধ করে তৈরি করা হচ্ছে মাছের ভেড়ি।

হুগলি নদী থেকে সৃষ্ট বিদ্যাধরী ছিল মাতলায় মিষ্টি জলের মুখ্য সরবরাহকারী নদী। কিন্তু বিদ্যাধরী বর্তমানে মৃতপ্রায়। এর উত্তরমুখ মজে যাওয়ায় হুগলি থেকে মিষ্টি জলের প্রবাহ বন্ধ। ফলে মাতলা দিয়ে মিঠে জলের প্রবাহও রুদ্ধ। এই কারণে এবং মাতলার উপর সেতু নির্মাণের কারণে জোয়ার-ভাটার প্রবাহ বাধা পাওয়ায় দ্রুত পলি জমছে মাতলার বুকে। যে অংশ দিয়ে কিছুদিন আগেও নৌকোয় মানুষ পারাপার করত এখন ভাটার সময় সেখান দিয়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। এইভাবে চললে আদি গঙ্গার মতো মাতলাও অদূর ভবিষ্যতে ইতিহাস হয়ে যাবে।

আদি গঙ্গার শেষাংশ ঘিয়াবতী এখন এক বদ্ধ ও মজা খাল।

সুন্দরবন অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন ও জীবিকা নদী-নির্ভর। নদীর মজে যাওয়া বা বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে কৃষিকাজ এবং মাছ ও কাঁকড়া শিকার যাঁদের জীবিকা তাঁরা বিপন্ন হয়ে পড়ছেন। আবার নদীতে মিষ্টি জলের প্রবাহ কমে যাওয়ায় অনেক স্থানে ম্যানগ্রোভের ঘনত্ব কমে গেছে। কোথাও কোথাও ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ আকারে ছোটো হয়ে গিয়েছে। আবার নদী সঙ্কীর্ণ হয়ে যাওয়ায় জঙ্গল থেকে বাঘ নদী পেরিয়ে সহজেই লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। সর্বোপরি পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের। ইতোমধ্যে বহু প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং নদীর জন্ম ও মৃত্যু প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু তা যদি মানুষের কারণে ত্বরাণ্বিত হয় তবে পরিবেশের উপর তার প্রভাব হয় ব্যাপক।

উন্নয়নের জোয়ার আনতে গিয়ে সুন্দরবনে বহু নদীর উপর তৈরি হয়েছে সেতু। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নদী ঘিরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য বেআইনি মাছের ভেড়ি। এগুলো নদীর মৃত্যুকে ত্বরাণ্বিত করছে। প্রায় দু’শো বছর আগে জঙ্গল হাসিল করে যখন সুন্দরবনে বসতি গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীর মৃত্যুকাহিনি লেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ কাহিনির শেষ কোথায় আমরা জানি না।—চলবে।

ছবি: লেখক ও সংগৃহীত।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content