বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


মাকাল ঠাকুর।

জন্মাবধি দেখছি আমার গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উত্তর-পূর্বে একটা বেশ বড় পাড়া আছে যা ‘বাগদি পাড়া’ বা ‘দোলুই পাড়া’ নামে পরিচিত। চেহারায় ও স্বভাবে ওরা আমাদের, অর্থাৎ ভিন জেলা থেকে এসে সুন্দরবনবাসী হওয়া মানুষের থেকে স্বতন্ত্র। ওদের সবার পদবি দোলুই। গায়ের রঙ কালো। উচ্চতা কম। কোঁকড়া চুল। নাক সামান্য চ্যাপ্টা। ওদের ভাষা বাংলা হলেও কথার টান স্বতন্ত্র।

আমার ছাত্রাবস্থায় দেখেছি খুব কম বাচ্চাই স্কুলে যেত। ওদের মধ্যে একজন আমার সহপাঠী ছিল। কিন্তু তার পড়াশুনা নবম শ্রেণির পর আর এগোয়নি। ওই বাগদি পাড়ার মধ্যে দিয়ে আমাকে স্কুলে যেতে হত। স্কুলে যাওয়ার সময় দেখতাম ওদের বাচ্চারা রাস্তার পাশে ছোট ডোবা বা পুকুরে বা খালে ছাকনি জাল টেনে মাছ ধরছে কিংবা এমনিই খেলা করছে। বড়রাও দেখতাম খ্যাপলা জাল ফেলে বা টানা জাল দিয়ে মাছ ধরছে।

স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখতাম অনেকে তখনও মাছ ধরছে। বাড়িতে ওরা গোরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস ও মুরগি পুষত। সরু গরাণ শাখা ও মাটি দিয়ে তৈরি দেয়াল ও খড়ের ছাউনির ছোট ছোট কুঁড়ে ঘরে ওরা থাকত। অপেক্ষাকৃত অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। বেশভূষা বা শরীরও অপরিচ্ছন্ন। নারী-পুরুষ দল বেঁধে হাটে যেত। গাছে উঠতে খুব পটু ছিল ওরা। বেশ দারিদ্র্যের মধ্যে ওরা জীবনযাপন করত। ওই পাড়া এখনও আছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়েছে ওই বাগদিদের।
বাগদি সম্প্রদায়ের মধ্যে মাকাল ঠাকুরের পুজোর বেশ প্রচলন দেখেছি। মাকাল ঠাকুর হল সুন্দরবনের এক লৌকিক দেবতা। ইনি হলেন মাছের দেবতা। সুন্দরবন মানেই জল আর জঙ্গল। জল মানেই তাতে হরেক মাছ, আর সেই মাছ এলাকার বাসিন্দাদের অন্যতম জীবন-জীবিকা আজও। তাই মাছের দেবতা থাকবে না, তা কি হয়? তবে এই দেবতার বিশেষত্ব হল এঁর কোনও নির্দিষ্ট মনুষ্য-রূপ নেই। সামান্য মাটি নিয়ে ওলটানো গ্লাসের মতো ঢিবি তৈরি করে তাকেই মাকাল ঠাকুর হিসেবে পুজো করা হয়।

মনুষ্য আকার বিহীন দেবতার পুজো প্রচলিত হয়েছিল আদিম সমাজে, যখন মানুষ বিভিন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে কাল্পনিক কোনও শক্তির উপাসনা শুরু করেছিল। কোনও জড় বস্তুকে শক্তিজ্ঞানে উপাসনা করার ‘টোটেম সংস্কৃতি’ হল আদিম মানবসমাজের সংস্কৃতি। তাহলে এই বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষ কি আসলে প্রাগৈতিহাসিক সুন্দরবন অঞ্চলের প্রথম আধিবাসী? সুন্দরবনে আর্য আগ্রাসনের আগে কি এরাই ছিল সুন্দরবনের বাসিন্দা? ওরা তাহলে এল কোথা থেকে?
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২: চলমান সুন্দরবন

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬২: মাছের পোনার পুষ্টির গুণমান ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে নিশ্চিত আয় সম্ভব

এ বিষয়ে খ্যাতনামা সুন্দরবন গবেষক তথা ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রণেতা সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয় কী বলছেন দেখুন। “বকচঞ্চুবৎ আকৃতির জন্যই সম্ভবতঃ ইহার (ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যে এক ত্রিকোণাকার ভূমিখণ্ড) নাম হইয়াছিল বকদ্বীপ। ইহাকেই আমরা ইংরাজির অনুকরণে ব’দ্বীপ করিয়া লইয়াছি। বকদ্বীপই বৌদ্ধ আমলে ভাষার অপকর্ষবশতঃ বগ্দি নামে পরিণত হয়। … ব’দ্বীপ বা বগদির জঙ্গলাকীর্ণ ভূভাগে যে অসভ্য জাতি বাস করিত, তাহারা এখনও বাগ্দি বলিয়া পরিচিত আছে।”

সম্প্রতি সুন্দরবন গবেষক একে মন্ডল এবং আরকে ঘোষ তাঁদের লেখা ‘সুন্দরবন’ গ্রন্থে ওই বিষয়ে চমকপ্রদ কথা লিখেছেন। তাঁদের লেখার মূল বক্তব্য হল— শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সুন্দরবন অঞ্চলের প্রাচীনতম স্থায়ী মৎসজীবী অধিবাসীরা নিশ্চিতভাবে নিগ্রয়েড উৎস থেকে আগত। এদের কোঁকড়ানো চুল, ঠোঁট, নাক, কালো রং বৈশিষ্ট্যগুলি এদের নিগ্রয়েড উৎসকে নিশ্চিতভাবে নির্দেশ করে। সুন্দরবনের অন্যান্য আদি অধিবাসীদের মধ্যে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড উৎস লক্ষ্য করা যায়।

হরিনারায়ণপুরে প্রাপ্ত নব্য প্রস্তর যুগের বারা দেবতা।

বর্তমানে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩৭ শতাংশ মানুষ তফসিলি জাতিভুক্ত এবং ৫ শতাংশ মানুষ তফসিলি আদিবাসী। ৪৫টি তফসিলি জাতির মানুষের বাসভূমি হল সুন্দরবন। আর তফসিলি আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে ছ’টি। এই আদিবাসীরা সুন্দরবনের আদিম অধিবাসী নয়। জঙ্গল হাসিল করে বসতি গড়ে তোলার কাজের জন্য এদের ঝাড়খণ্ড এবং বিহার থেকে আনা হয়েছিল। পরে তারা স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। তফসিলি জাতির মধ্যে ৯১ শতাংশ হল পাঁচটি জাতিভুক্ত মানুষ — বাগদি, কেওরা, নমঃশূদ্র, পৌন্ড্র ও রাজবংশী। বাগদি জাতির মানুষ সবচেয়ে বেশি রয়েছেন কাকদ্বীপ, মথুরাপুর, পাথরপ্রতিমা, জয়নগর, ক্যানিং, বাসন্তি, হাড়োয়া ও সন্দেশখালি ব্লকে।

এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কবে থেকে অতি প্রাচীন সুন্দরবনে এরা বসতি স্থাপন করেছিল। নেহাত বসতি ছিল, নাকি সুন্দরবনে এদেরই কোনও সভ্যতা ছিল? আমরা ইতিহাস থেকে জানি পৃথিবীর বড় বড় নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সভ্যতাগুলি। যেমন সিন্ধু নদের তীরে সিন্ধু সভ্যতা, নীল নদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমিয় সভ্যতা, হুয়াং হে নদীর তীরে প্রাচীন চৈনিক সভ্যতা ইত্যাদি। তাহলে প্রাচীন গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় প্রাচীন কোনও সভ্যতা গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪০: সে এক স্বর্গপুরীর ‘চিরকুমার সভা’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৬: মাছের তেল হার্ট অ্যাটাক আটকায়?

সুন্দরবনের সৃষ্টি ও লয়, উন্নতি ও অবনমন, অগ্রগামিতা ও পশ্চাতগামিতা, জাগরণ ও নিমজ্জন এতবার হয়েছে যে প্রাচীন সভ্যতার প্রমাণ পাওয়া খুব দুরূহ ব্যাপার। তাছাড়া সরকারি উদ্যোগে অনুসন্ধানের কাজও হয়নি। যেটুকু হয়েছে তা নিতান্তই ব্যক্তিগত আগ্রহে ও উৎসাহে। আর সেই সামান্য উদ্যোগেই জানা গিয়েছে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে এখানে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। প্রাচীনকালে সুন্দরবন আজকের অবস্থান থেকে অনেক উত্তরে, এমনকি দুর্গাপুর, দার্জিলিং ও ভুটান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রাচীন সুন্দরবনের বেশ কিছু প্রত্নস্থল ছড়িয়ে রয়েছে ডায়মন্ড হারবারের আশেপাশে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল দেউলপোতা ও হরিনারায়ণপুর।

ডায়মন্ড হারবার থেকে ৫ কিমি পশ্চিমে দেউলপোতায় পাওয়া গিয়েছে মধ্য ও নব্য প্রস্তর যুগের প্রস্তর নির্মিত নানা হাতিয়ার। কয়েকটি অস্থি নির্মিত হাতিয়ারও আবিষ্কৃত হয়েছে। পাওয়া গিয়েছে খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকে দ্বিতীয় রোম সম্রাট দ্বিতীয় কন্সট্যানটিয়াসের স্বর্ণ মুদ্রা। এ থেকে বোঝা যায় যে, ওই অঞ্চলের সঙ্গে মধ্য প্রাচ্যের নৌ যোগাযোগ ছিল। ডায়মন্ড হারবারের ৯ কিমি দক্ষিণে হুগলি নদীর তীরে হরিনারায়ণপুরেও প্রাগৈতিহাসিক যুগের অনেক পুরাবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে অধিকাংশ পুরাবস্তু আজ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সাগরদ্বীপের মন্দিরতলাতেও পাওয়া গিয়েছে নব্য প্রস্তরযুগের উপকরণ।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৫: আমার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ, আমি জ্ঞান হারিয়েছি

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১১: অধীনস্থ কর্মীদের উৎসাহ দিয়ে মানবসম্পদকে কী করে ব্যবহার করতে হয় সে বিদ্যা সুদক্ষ শাসকের থাকা উচিত

তবে মেগাস্থিনিস, প্লিনি, টলেমি, প্লুটার্ক প্রমুখের বিবরণে ও মানচিত্র থেকে জানা গিয়েছে যে, খ্রিস্টপূর্বকালে গঙ্গা ও পদ্মার মধ্যবর্তী অঞ্চলে এক উন্নত সভ্যতা ছিল। আলেকজান্ডার ভারতজয়ের লক্ষ্যে ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে বিপাশা নদী পর্যন্ত পৌঁছে খবর পেয়েছিলেন, নৌযুদ্ধে পারদর্শী দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীসমৃদ্ধ এক রাজ্য আছে গাঙ্গেয় অববাহিকায়। ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস এই বিবরণ দিয়েছেন। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে প্লুটার্ক লেখেন যে, আলেকজান্ডারকে প্রতিরোধ করার জন্য ওই রাজ্যের রাজা হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিকের বিশাল বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এই সংবাদে আলেকজান্ডারের ক্লান্ত সেনাবাহিনী আর অগ্রসর হতে চায়নি।

তবে খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে জনৈক গ্রিক নাবিকের লেখা পুস্তক ‘পেরিপ্লাস অব দি এরিথ্রিয়ান সি’ এবং ভূতত্ত্ববিদ ও জ্যোতির্বিদ ক্লদিয়াস টলেমির মানচিত্র থেকে জানা যায়— বর্তমান সাগরদ্বীপে ছিল এক সমৃদ্ধ বন্দর-শহর তথা বানিজ্যকেন্দ্র। এখানে পান, মুক্তো, প্রবাল, উৎকৃষ্ট মসলিন ইত্যাদি কেনাকাটা চলত। তিনি এই শহরের নাম লিখেছেন ‘গঙ্গে’। আর এই শহরটি যে রাজ্যের অন্তর্গত সেটিও ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ রাজ্য যার নাম ‘গঙ্গারিডি’। এই রাজ্যের অধিবাসীদের লেখক নাম দিয়েছেন ‘গঙ্গারিডই’। মেগাস্থিনিস এই জাতির শৌর্যের কথাই লিখেছিলেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-ও গঙ্গে বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন।

টলেমির মানচিত্রে গঙ্গারিডি রাজ্য ও গঙ্গে বন্দর।

গঙ্গারিডি রাজ্য ও গঙ্গে বন্দরের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সহমত না হলেও এটা নিশ্চিত যে গঙ্গে বন্দরের অবস্থান ছিল সমুদ্রতীরে। প্রয়াত সুন্দরবন গবেষক নরোত্তম হালদারের মতে, বর্তমান সাগরদ্বীপ বা তার কাছেই ছিল গঙ্গে বন্দর এবং পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের দক্ষিণ অংশকে গ্রিক লেখকরা ‘গঙ্গারিডি’ রাজ্য নামে অভিহিত করেছেন। টলেমির মানচিত্রেও আমরা গঙ্গারিডি রাজ্য ও গঙ্গে বন্দরের উল্লেখ পাই। টলেমির মানচিত্র সঠিক অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ অনুসারে আঁকা না হলেও গঙ্গে বন্দরের অবস্থান বুঝতে অসুবিধা হয় না।

মহাভারতের সভা পর্বে বেদব্যাস উল্লেখ করেছেন, যুধিষ্টিরের রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষ্যে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম বিভিন্ন রাজাদের পরাজিত করে শেষে সমুদ্রকূলের ‘ম্লেচ্ছদিগকেও’ পরাস্ত করেন। এই ম্লেচ্ছরা যে গঙ্গারিডি রাজ্যের অধিবাসী তা সহজেই অনুমান করা যায়। সুতরাং দুই সহস্রাব্দ পূর্বেও প্রাচীন সুন্দরবন অঞ্চল জুড়ে গঙ্গারিডি রাজ্য, গঙ্গে বন্দর এবং গঙ্গারিডই জাতি যে ছিল সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। কালের স্রোতে সেই বন্দর তলিয়ে গিয়েছে সমুদ্রের গর্ভে।

নরোত্তমবাবুর মতে, প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের জনগোষ্ঠীকেই গ্রিক লেখকরা গ্রিক নামকরণের নিয়মানুসারে গঙ্গারিডই বলেছেন। বর্তমানে সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারী পৌন্ড্র, বাগদি, নমঃশূদ্র প্রভৃতি জনগোষ্ঠী হল সুন্দরবন অঞ্চলের প্রাচীনতম জনগোষ্ঠী।—চলবে।
ছবি: লেখক।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content