বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


বসন্ত রায়ের ঘটপুজো।

বসন্ত রায়—নামটা শুনলে ইনি যে কোনও দেবতা হতে পারেন তা মনে আসে না। কারণ দেবতাদের নামের শেষে কোনও পদবি থাকতে দেখা যায় না। কিন্তু ব্যতিক্রম সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা দক্ষিণ রায়, কালু রায় বা বসন্ত রায়। তাহলে কি ওই নামে কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি কখনও ছিলেন যাঁরা পরবর্তীকালে স্থানীয় মানুষের কাছে দেবতা হিসেবে পূজিত হতে থাকেন? আর এভাবেই কি সৃষ্টি হয় মানুষের লৌকিক দেবতা-সংস্করণ? সে উত্তর নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।

তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মথুরাপুর-২ নং ব্লকের অন্তর্গত খাড়ি নামক গ্রাম যেখানে অবস্থিত সেখানে যে একদা বসন্ত রায় নামে এক অতি শক্তিশালী শাসক ছিলেন তা “শীতলা মঙ্গল” কাব্য থেকে জানা যায়। এই খাড়ি অঞ্চলেই ছিল বসন্ত রায়ের রাজধানী। আর ইতিহাস থেকে জানা যায় যে তিনি ছিলেন রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের কাকা। তবে এই বসন্ত রায় আর লৌকিক দেবতা বসন্ত রায় একই ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
লৌকিক দেবতা বসন্ত রায় কে? দুই ২৪ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলে ইনি বসন্ত রোগের প্রসারক ও নিয়ন্ত্রক দেবতা বলেই পরিচিত। শুনতে অদ্ভুত লাগল, তাই না? যে দেবতা রোগ ছড়ান, তিনিই আবার রোগ সারান! তাহলে শীতলা মঙ্গল কাব্যের কাহিনিটি একটু শোনানো যাক। বসন্ত রায় বুঝতে পারছিলেন দিনে দিনে মানুষের কাছে তাঁর ও শীতলার জনপ্রিয়তা কমছে। তাঁদের আর কেউ পুজো করছে না। তাই পুজো পাওয়ার জন্য বসন্ত রায় এক ফন্দি করলেন। তিনি দেখলেন সপ্তগ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি মদন দাস বসন্ত রায় বা শীতলাকে স্বীকার করেন না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৪: সুন্দরবনের রাজমাতা দেবী নারায়ণী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৪: চাঁদ ঢাকার কৌশল

মদন দাস ছিলেন শুল্ক আদায়কারী (জগাতি)। সপ্তগ্রামে ব্যবসা করতে গেলে মদন দাসকে শুল্ক দিয়ে তবেই ব্যবসা করা যেত। বসন্ত রায় পরিকল্পনামাফিক এক ব্যবসায়ীর বেশ ধরলেন এবং নানা খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে তাঁর অনুচর নানা রোগকে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে চললেন সপ্তগ্রামে। কিন্তু নদী পেরনোর সময় এবং তারপর খাদ্যপণ্য নিয়ে নগরে প্রবেশ করে মদন দাসকে ইচ্ছাকৃতভাবে এক পয়সাও শুল্ক দিলেন না। ফলে মদন দাসের সঙ্গে তাঁর ঝামেলা লাগল।

মদনের নির্দেশে তার লোকজন ব্যবসায়ীবেশী বসন্ত রায়ের আনা সমস্ত খাবার লুঠ করে খেতে লাগল। মদনও খেল। আর সঙ্গে সঙ্গেই মদন ও তার লোকজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভয়ানক যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগল। মদন বুঝতে পারল যে এ ব্যবসায়ী কোনও সাধারণ মানুষ নন, নিশ্চিত কোনও দেবতা। তাই করজোড়ে তাঁর পরিচয় জানতে চেয়ে রোগ থেকে মুক্ত করার কাতর অনুরোধ করল এবং তাঁকে পুজো করার প্রতিশ্রুতি দিল।
“কাতর মদন দাস কহে করপুটে।
করিলাম অনেক দোষ তোমার নিকটে।।
কোন মহাশয় তুমি পরিচয় কর।
পূজিব চরণ-যুগল যদি ব্যধি হর।।”

বাড়িভাঙা আবাদ, খাড়িতে শীতলা মন্দিরে শীতলার পাশে বসন্ত রায়।

মদন দাসের অনুরোধে বসন্ত রায় তাঁর পরিচয় দিয়ে বললেন যে তিনি মা শীতলার পুত্র। আর যদি তাঁর পুজা করা হয় তবে সুখ ও সমৃদ্ধি হবে।
“পরিচয় দিলেন রায় গুণের সাগর।
শীতলার পুত্র আমি বসন্ত ঈশ্বর।।
আমার ঘটে পূজা কর না পাইবে দুখ।
অনেক তোর বাড়িবে নানা জাতি সুখ।।”


তখন মদন দাস অধুনা লুপ্ত আদিগঙ্গার তীরে খাড়ি নামক স্থানে সুন্দর এক মন্দির নির্মাণ করল এবং সেখানে মা শীতলা ও বসন্ত রায়ের মূর্তি স্থাপন করে ভক্তিভরে পুজো করল এবং ছাগল ও ভেড়া বলি দিল। তখন বসন্ত রায়ও খুশি হয়ে বরদান করলেন।
“মনোহর মন্দির গঙ্গার তীরে দিল।
শীতলা বসন্ত রায় তথায় স্থাপিল।।
ছাগ-মেষ বলি দিএ হরষিত।
সপুটে করিল পূজা একমনচিত।।
সদয় হইয়া রায় দিলেন প্রসাদ।
সকল জগাতি নাচে জয় জয় নাদ।।”


শুধু মদন দাসকে তিনি ‘শিক্ষা’ দেননি, এক কাজিকেও তিনি অনুরূপ শিক্ষা দেন। ওই কাজি বসন্ত রায়কে স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। তখন বসন্ত রায় নানা রোগব্যাধি দিয়ে কাজিকে আক্রমণ করেন। ভীত কাজি বাধ্য হয়ে বসন্ত রায়ের মন্দির ও মূর্তি গড়ে দেন।
“গ্রামের ভিতরে দিল উত্তম মন্দির।
গড়াইল শতকুম্ভ নেতোর প্রাচীর।
গঠিল বসন্ত রায় ঘোড়ার উপর।
গলায় সোনার হার রূপ মনোহর।।”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪২: আন্তোনিয়োর মুখোমুখি

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৫: মন বলে আমি মনের কথা জানি না!

এইসব কাহিনি থেকে স্পষ্ট হয় যে বসন্ত রায় নিজের ও শীতলার প্রচার বাড়ানোর জন্য মানুষকে রোগাক্রান্ত করেন ও তারপর সেই রোগ নিরাময় করে মানুষের মনে আস্থা অর্জন করেন। তবে খাড়ি গ্রামে বর্তমানে বসন্ত রায়ের কোনও মন্দির নেই। বস্তুতঃ এককভাবে কোথাও এখন বসন্ত রায়ের মন্দির নেই। বহুকাল আগে অনার্য প্রভাবিত সুন্দরবনে বসন্ত রোগ নিরাময়ের দেবী শীতলার উদ্ভব হয়েছিল। পরবর্তীকালে শীতলার আর্যীকরণ ঘটে। একই কারণে অনার্য দেবী শীতলা ও লৌকিক দেবতা বসন্ত রায়ের উদ্ভব হওয়ায় এই দুই দেবদেবী মাতা-পুত্রের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু সুন্দরবন অঞ্চলে মাতৃ উপাসকদের প্রাধান্যের সময় শীতলার গুরুত্ব বেড়ে যায় ও বসন্ত রায় হয়ে যান ব্রাত্য। তাই এখন কোনও কোনও শীতলা দেবীর মন্দিরে শীতলার সাথে বসন্ত রায় পুজো পান। সুন্দরবন এলাকায় তাঁর একক কোনও মন্দির আজ নেই।

বসন্ত রায়ের চেহারা কেমন? তিনি অত্যন্ত সুন্দর দেখতে, যেন এক অশ্বারোহী বীরপুরুষ বা কোনও এক রাজকুমার। গায়ের রঙ হরিদ্রাভ অর্থাৎ ফরসা। এক হাতে তলোয়ার, অন্য হাতে ধনুক। পিঠে তূণ আর ঢাল।
কৃষ্ণরাম দাসের লেখা “শীতলা মঙ্গল” কাব্যে বসন্ত রায়ের চেহারার বর্ণনায় বলা হয়েছে—
“সাজিল বসন্ত রায় তুরকি ঘোড়ায়।
কলেবর শোভা পাএ লোচন জুড়ায়।।
হাতে শক্তি শরাসন তূণ পূর্ণ বান।
চাঁদ করে ঝকমক পিঠে ঢালখান।।”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

অসাধারণ রূপের জন্য তাঁকে অনেকে নিশির ঠাকুর বলে ডাকেন। তাঁর কোঁকড়া চুল, মাথায় মুকুট, কানে কুন্ডল। তাঁর পরণে থাকে হয় ধুতি, কাঁধে উত্তরীয় আর আজানুলম্বিত যজ্ঞোপবীত কিংবা রাজবেশ পায়জামা ও চাপকান। শীতলার সাথে যখন তিনি একসাথে অধিষ্ঠান করেন তখন তাঁর মূর্তি হয় দন্ডায়মান, কিন্তু একা থাকলে ঘোড়ার পিঠে আসীন। বসন্ত রায় যদি রুষ্ট হন তবে তিনি নানা ব্যাধি ছড়ান। তাই সুদূর অতীতে সুন্দরবনের মানুষ রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পেতে তাঁর আরাধনা করত। তবে বণিকরাও সমুদ্র পেরিয়ে বানিজ্যে যাওয়ার সময় খাড়িতে এসে তাঁকে পুজো দিয়ে যেতেন যাতে কোনও বিপদে না পড়েন। “শীতলা মঙ্গলে” তাই বলা হয়েছে—
“মন্দ আগোন ব্যাধি একে একে চাপে।
রুষিলে বসন্ত রায় রাখে কার বাপে।।

***

পূজিল বসন্ত রায় খাড়িতে আসিয়া।
কৃপায় পাইনু কূল সাগরে ভাসিয়া।।”

কালিকাপুর, খাড়িতে শীতলা মন্দিরে শীতলার পাশে বসন্ত রায়।

এখন আদিগঙ্গা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে খাড়ি গুরুত্ব ও গরিমা হারিয়ে পরিণত হয়েছে এক গন্ডগ্রামে। আবার বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে একসময় মহামারি সৃষ্টিকারী রোগ গুটিবসন্ত চিরবিদায় নিয়েছে। কেবল চিকেন পক্স রয়ে গেলেও তার প্রকোপ এখন অনেক কম, প্রাণঘাতীও নয়। তবুও সুন্দরবনের কোথাও কোথাও চিকেন পক্সের প্রকোপ কিছু বেশি হলে বসন্ত রায় এখনও পূজিত হন। তখন তাঁর পৃথক মূর্তি তৈরি করে বা ঘট স্থাপন করে কোনও বারোয়ারিতলায় বা হরিবাসরের প্রাঙ্গণে এলাকার মানুষ তাঁর বারোয়ারি পুজোর আয়োজন করে। বসন্ত রায়ের পালাগানে তাই বলা হয়—
“তুমি দেব চূড়ামণি, মানবে কি স্তব জানি
কৃপায় হইবে শূলপাসন।
ভনে পীতাম্বর দ্বিজ, উরগো বসন্তরাজ
দূরিতে সকল রোগশোক।
বটুক কৈলাসবাসী, বারায় বসিল আসি
হরি হরি বল সর্ব্বলোক।।”

যেহেতু শীতলার সঙ্গেই বসন্ত রায় এখন পূজা পান তাই বর্ণ ব্রাহ্মণরাই শীতলার সঙ্গে বসন্ত রায়ের পুজো করেন। তবে কোথাও কোথাও ‘পন্ডিত’রাও পুজো করেন। পুজো শেষে উপাসকদের হাতে দেওয়া হয় শীতলা ও বসন্ত রায়ের চরণামৃত। যেহেতু সুন্দরবনে শীতলার প্রভাব এখনও যথেষ্ট রয়েছে তাই সঙ্গী হিসেবে বসন্ত রায়ের অস্তিত্ব এখনও টিম টিম করে টিকে আছে। ভবিষ্যতে শীতলার গুরুত্ব হ্রাস পেলে সুন্দরবনবাসীর কাছে বসন্ত রায় কতদিন তাঁর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।—চলবে।

ছবি: লেখক। সংগ্রহীত।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content