বাঘের উপর কালু রায়। ছবি: সংগৃহীত।
সুন্দরবনের প্রেক্ষিতে একটা প্রবাদ বাংলায় বহুল প্রচলিত—জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। জল-জঙ্গল ঘেরা সুন্দরবনে প্রাচীন কাল থেকে জল ও স্থলের দুই ভয়ঙ্কর প্রাণী কুমির ও বাঘের সঙ্গে মানুষের বাস। ফলে হিংস্র বাঘ ও কুমিরের সঙ্গে নিত্য লড়াই করে সুন্দরবনবাসীকে বাঁচতে হয়েছে। অনার্য আদিম প্রাচীন সুন্দরবনবাসী, তাই পৃথিবীর অন্যান্য আদিম সংস্কৃতির মতো ভয়ঙ্কর সেই সব জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচতে তাদের মধ্যে দেবত্ব আরোপ করে তাদের পুজো শুরু করে।
এ ভাবে আর্যেতর সুন্দরবনের মানুষের কাছে বাঘ, কুমির, সাপ ইত্যাদি প্রাণী এককালে পুজো পেতে শুরু করে। পরবর্তীকালে পৌরাণিক বা বৌদ্ধ দেবদেবী, মুসলিম পীর বা সমাজের পূজ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব গ্রাস করে নেয় ওইসব পশুপ্রাণীকে। ফলে সৃষ্টি হয় ওই সব বিপদের থেকে রক্ষাকারী মানব চেহারার দেবদেবী, আর পশুপ্রাণীরা পরিণত হয় সে-সব দেবদেবীর বাহনে। এভাবেই এককালে পূজিত কুমির রূপান্তরিত হল কুমিরের দেবতা কালু রায়ে, আর কুমির হয়ে গেল তাঁর বাহন।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২২: সুন্দরবনে গোয়াল পুজো আর ‘ধা রে মশা ধা’
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৩: অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু
কালু রায়ের অস্তিত্ব মূলত দুই ২৪ পরগনার বর্তমান ও আদি সুন্দরবন অঞ্চল এবং পূর্ব মেদিনীপুর। সব জায়গায় অবশ্য তাঁর বাহন যে কুমির তা নয়। কোথাও কোথাও তিনি দক্ষিণ রায়, বনবিবি, বড়ো খাঁ গাজী প্রমুখের মতো ব্যাঘ্রদেবতা। আবার কোথাও কোথাও তিনি বাঘ ও কুমির উভয়ের দেবতা। সুন্দরবন এলাকায় তিনি দক্ষিণ রায় বা বড়ো খাঁ গাজী বা বনবিবির সঙ্গী হিসেবে পূজা পান। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি, ঘাটাল, হিজলী ইত্যাদি অঞ্চলে কালু রায় বাঘ ও কুমিরের দেবতা হিসেবে এককভাবে পূজিত হন।
এখানে কালু রায়ের অনেক থান দেখা যায়। সেখানে তাঁর মূর্তি বা ঘটের দু’পাশে দুটি বাঘ ও পায়ের কাছে একটি কুমিরের মূর্তি রাখা হয়। আবার এখানে কোথাও কোথাও তিনি মহিষের দেবতা হিসেবে পূজিত হন। মনে হয় মহিষ অধ্যুষিত অঞ্চলে কালু রায়ের বাহন হল মহিষ। তাই হয়তো পূর্ব মেদিনীপুরে মহিষাদল, ওই জেলার নন্দকুমার ব্লকে মহিষগোট নামে জায়গা রয়েছে। এখানে কালু রায়ের মন্দিরও রয়েছে। রাঢ় বঙ্গের প্রাচীনতম দেবতা ধর্মঠাকুর কোথাও কোথাও কালু রায় নামে পূজিত হন। আবার কোথাও তাঁকে ধর্মরাজ অর্থাৎ যমরাজ বলা হয়। যমরাজের বাহন হল মহিষ। সুতরাং সব মিলেমিশে কালু রায়ের বাহন মহিষ হওয়া অসম্ভব নয়।
কাচরাপাড়ার কাছে কাপা গ্রামে কালু রায় ও দক্ষিণ রায়ের মন্দির। ছবি: সংগৃহীত।
কালু রায়ের মূর্তির সঙ্গে দক্ষিণ রায়ের মূর্তির সাদৃশ্য দেখা যায়। মাথায় পাগড়ি বা মুকুট, যোদ্ধাদের মতো পোশাক, এক হাতে ঢাল ও অন্য হাতে অস্ত্র, পিঠে তীর-ধনুক, কোমরবন্ধে নানা রকমের অস্ত্র ঝোলানো, কানে দুল, কপালে রক্ত তিলক, ডাগর চোখ, মোটা গোঁফজোড়া কান পর্যন্ত বিস্তৃত কিন্তু দাড়িবিহীন, টিকালো নাক আর বাবরি চুল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁর বাহন হল ঘোড়া।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৩: অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু
পরিযায়ী মন, পর্ব-১৫: তিনচুলে ও লেপচাজগৎ এর মেঘ-আলয়ে
তবে বাহন হিসেবে বাঘও দেখা যায়। সুন্দরবন অঞ্চলে একসময় যে কালু রায়ের প্রভাব যথেষ্ট বেশি ছিল তা মধ্যযুগে রচিত ‘কালু রায় মঙ্গল’, ‘কালু রায় গীত’ ইত্যাদির জনপ্রিয়তা থেকে বোঝা যায়। তবে বাঘ ও কুমিরের আক্রমণ অনেক কমে যাওয়ায় বর্তমানে সুন্দরবনে দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে কালু রায়ের প্রভাব অনেক কমে গেছে। সুন্দরবনের কোনও কোনও গ্রামে এখনও দক্ষিণ রায় ও কালু রায় যৌথ দেবতার থান আছে। যেখানে বন আছে সেখানের থানে শনি ও মঙ্গলবার নিয়মিত পুজো ছাড়াও বনে প্রবেশ করার আগে মৌলে, বাউলে ও মৎসজীবীরা এই দুই দেবতার পুজো করে। ঘটা করে পুজো হয় মকর সংক্রান্তির রাতে। তখন রাতভর পুজো ও অনুষ্ঠান চলে। পশু-পাখি বলি হয়। নৈবেদ্য হিসেবে মদও দেওয়া হয়। একে বলে জাঁতাল পুজো। পুজোয় বুনো ঝাউয়ের ফুল অবশ্যই লাগে। ব্রাহ্মণ বা দেয়াসীরা পুজো করেন।
সুন্দরবন অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীর বারামূর্তি বা মুন্ডমূর্তির পুজো বহুকাল আগে থেকে প্রচলিত। এ হল আদিম অনার্যসমাজের পূজাপদ্ধতি। সুন্দরবনে একজোড়া পুরুষের মুখ আঁকা যে জোড়া বারামূর্তির পুজো প্রচলিত তা বিশেষজ্ঞদের মতে দক্ষিণ রায় ও কালু রায়ের মূর্তি। আবার কারও কারও মতে একই লৌকিক দেবতার জোড়া বারামূর্তি পূজিত হয়, দুই ভিন্ন দেবতা নয়, কারণ দেশের অন্যত্র আদিবাসীদের মধ্যে এমন পূজা পদ্ধতি দেখা যায়। সে যাইহোক, সুন্দরবনে এই জোড়া বারামূর্তি হল দক্ষিণ রায় ও তাঁর দাদা বা সহচর কালু রায়।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?
বাস্তুবিজ্ঞান, পর্ব-২০: বাড়িতে ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করতে চান? কোন দিকে দেবদেবীদের রাখা শাস্ত্রসম্মত?
আবার কোথাও কোথাও কালু রায়ের কোনও মানবমূর্তি দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে এক, তিন বা পাঁচটি ছোটো পাথরের খন্ড প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়। এই পাঁচ খন্ড সম্ভবত দক্ষিণ রায়, উত্তর রায়, চণ্ডী, মঙ্গলা এবং কালু রায়। লোককাহিনি অনুযায়ী কালু রায় হলেন উত্তর রায় ও দক্ষিণ রায়ের বড়ো ভাই। কালু রায়ের একদিকে থাকেন উত্তর রায় আর একদিকে দক্ষিণ রায়। আর ডানদিকে থাকেন চন্ডী ও বামদিকে মঙ্গলা দেবী। আবার কোথাও কোথাও থান নেই, গাছের তলায় তাঁর পুজো হয়। এ নিয়ে সুন্দরবনে প্রচলিত কালু রায় গীত-এ রয়েছে—
উত্তর দক্ষিণ রায়ে রাখি দুই পাশে,
মধ্যস্থলে জ্যেষ্ঠ কালু রায় বসে।
সবার দক্ষিণে চন্ডী বামেতে মঙ্গলা,
পঞ্চরূপে পৃথিবীতে করেন লীলাখেলা।
কোথা একা, কোথা তিন, কোথা পঞ্চ জন,
নির্ভয়েতে কালু রায় করেন বিচরণ।
ঘরবাড়ি নাহি কিছু বাস বৃক্ষতল,
সদা চিন্তা কি যে হবে গ্রামের মঙ্গল।
বন্দো কালু রায়ে সবে গ্রামের দেবতা,
গ্রামের ভরসা বিপদেতে রক্ষাকর্তা।
মুসলিমপ্রধান এলাকায় কালু রায় আবার বড়ো খাঁ গাজীর ভাই বা সহচর হিসেবে হাজোত পান। তাঁর নামও পালটে হয় মগর পীর কালু গাজী। তখন তাঁর মাথায় ফেজ টুপি, গালে নুর দাড়ি দেখা যায়, আর গায়ের রং হয় কালো।
মধ্যস্থলে জ্যেষ্ঠ কালু রায় বসে।
সবার দক্ষিণে চন্ডী বামেতে মঙ্গলা,
পঞ্চরূপে পৃথিবীতে করেন লীলাখেলা।
কোথা একা, কোথা তিন, কোথা পঞ্চ জন,
নির্ভয়েতে কালু রায় করেন বিচরণ।
ঘরবাড়ি নাহি কিছু বাস বৃক্ষতল,
সদা চিন্তা কি যে হবে গ্রামের মঙ্গল।
বন্দো কালু রায়ে সবে গ্রামের দেবতা,
গ্রামের ভরসা বিপদেতে রক্ষাকর্তা।
মুসলিমপ্রধান এলাকায় কালু রায় আবার বড়ো খাঁ গাজীর ভাই বা সহচর হিসেবে হাজোত পান। তাঁর নামও পালটে হয় মগর পীর কালু গাজী। তখন তাঁর মাথায় ফেজ টুপি, গালে নুর দাড়ি দেখা যায়, আর গায়ের রং হয় কালো।
(বামদিকে) কাচরাপাড়ার কাপায় মন্দসিরে কালু রায় ও দক্ষিণ রায়ের বিগ্রহ (ডানদিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
আদিম সমাজের পশুরূপী দেবতা সমাজ বিবর্তনকালে মনুষ্যরূপ পায় এবং পশু হয়ে যায় তাঁর বাহন। আবার প্রাচীন সমাজে জমিদার বা প্রভাবশালী মানুষ ব্যক্তিপূজা পেত। কালক্রমে সেই ব্যক্তি ও দেবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তার সাথে যুক্ত হয় আঞ্চলিক দেবতা ও ধর্মীয় প্রভাব। ফলে একই দেবতা নানা রূপে ধরা দেয় প্রবহমান সমাজে। আবার প্রয়োজনের তাগিদে কোনও দেবদেবীর গুরুত্ব বাড়ে বা কমে। আর ঠিক এই কারণেই সুন্দরবনে কালু রায় উপস্থিত হয়েছেন নানা রূপে এবং বর্তমানে তিনি তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি খুইয়ে ফেলেছেন।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।