শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


গোবিন্দরামপুরে (কাকদ্বীপ) একসঙ্গে তিন দেবী— শীতলা, বিশালাক্ষী ও মনসা। ছবি: লেখক।

আমার গ্রামের বাড়ি থেকে পুবদিকে প্রায় এক কিলোমিটার মেঠো পথ পেরোলে যে গ্রাম শুরু হয় তা হল বামানগর। আমার বাড়ির সবচেয়ে কাছে যে বার্ষিক মেলার জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকতাম তা ওই গ্রামের সীমানাতেই এক মন্দির সংলগ্ন মাঠে হত। লোকমুখে ওই মেলার নাম ‘শিকারী মেলা’। আর যে মন্দির সংলগ্ন ওই মেলা তা হল শীতলা মন্দির। লোকে বলে শীতলা থান। তাই অনেকে ওই মেলাকে ‘শীতলা মেলা’-ও বলে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মধ্যে শীতলা পুজো উপলক্ষে সবচেয়ে বড় মেলা হল এই ‘শিকারী মেলা’।

শিকারী নাম হওয়ার কারণ ওই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা তাঁর জমিতে লাঙল করার সময় বিশালাকার এক কুমির নাকি গোরুকে কামড়ে ধরেছিল। তখন তিনি লাঙলের ইশ খুলে নিয়ে প্রহার করে কুমিরটিকে মেরেছিলেন। তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও সাহস দেখে গ্রামের মানুষ তাঁকে উপাধি দেয় ‘শিকারী’। পরে মা শীতলা তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে মন্দির গড়ে আরাধনা করতে নির্দেশ দেন। সেই থেকেই চলে আসছে শীতলা দেবীর পুজো এবং শিকারী মেলা।
যতদূর জানা যায় মন্দিরটি প্রায় দু’শো বছরের প্রাচীন মন্দির। ওই মন্দিরে দেবী শীতলার সাথে জ্বরাসুর ও মনসা দেবী পূজিত হয়ে আসছে মন্দিরের জন্মলগ্ন থেকে। বৈশাখ মাসে অক্ষয় তৃতীয়ার দু’দিন পর অর্থাৎ পঞ্চমী তিথি থেকে শুরু হয় পুজো। আর সেই উপলক্ষে মেলা হত চারদিন ধরে। আশৈশব দেখে এসেছি দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসত মেলায়। বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলেই মানুষ শীতলা দেবীর কাছে রোগমুক্তির জন্য মানত করত। ফলে শীতলার ছলন মাথায় নিয়ে ঢাকির বাজনা-সহ দলে দলে মানুষ যেত শীতলার থানে। অনেকে তো সুদীর্ঘ পথ দন্ডী কাটতে কাটতে যেত। শীতলার পুজো দিত আশেপাশের গ্রামের সমস্ত মানুষ। প্রত্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলে তখন একমাত্র বিনোদন ছিল এই বাৎসরিক মেলা। মেলা উপলক্ষে যাত্রাগানের আসর হত সারা রাত ধরে। শীতলামঙ্গল, মনসামঙ্গল ইত্যাদি পালাগান হত। তবে বর্তমানে প্রতিষ্ঠাতাদের শরিকি সমস্যায় মন্দিরের অবস্থা জরাজীর্ণ এবং সুন্দরবনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেলার জৌলুশ ম্লান। বর্তমানে মাত্র দু’দিন মেলা বসে এবং তা আয়তনেও অনেক ছোটো।

শৈশব থেকেই আমার মনে শীতলা সম্বন্ধে এক অদ্ভুত ভীতি কাজ করত। আমার আত্মীয়, প্রতিবেশী ও পরিচিত অনেকের মুখমন্ডল জুড়ে দেখতাম গুটি গুটি দাগ। বাবা, মা ও ঠাকুমার মুখে শুনতাম গুটি বসন্ত রোগ হলে মুখমণ্ডল ওইরকম হয়ে যায়। আবার গ্রীষ্মের দুপুরে না ঘুমিয়ে বাগানে বা পুকুর পাড়ে যাতে যেতে ভয় পাই তাই ঠাকুমা প্রায়ই বলত, “মা শীতলা বসন্তবুড়ির বেশ ধরে দুপুরবেলা একটা ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর কোনও বাচ্চা ছেলেকে দেখলে তার ঝোলায় পুরে নিয়ে চলে যায়।” এই কথাটা মন থেকে এতটা বিশ্বাস করেছিলাম যে ঝোলা কাঁধে কোনও বৃদ্ধা ভিক্ষুককে দেখলে দৌড়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে পড়তাম। প্রতি বছর পরিবারের সদস্যদের বসন্ত রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে আমাদের পরিবারে মা-জ্যাঠাইমাদের ‘বসন্তবুড়ি ব্রত’ পালন করে দেখেছি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

এখন আমাদের জানা দরকার কে এই শীতলা দেবী? আর তাঁর উৎপত্তির পেছনে রয়েছে কোন ইতিহাস? শীতলা যে লৌকিক দেবী এ ব্যাপারে প্রায় সমস্ত বিশেষজ্ঞ একমত। কিন্তু তাহলে দেশের কোনও এক অঞ্চলে তাঁর সীমাবদ্ধ থাকার কথা অন্য লৌকিক দেবদেবীর মতো এবং পুরাণে তাঁর উল্লেখ না থাকারই কথা। কিন্তু শীতলার ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। কেবল বাংলায় বা সুন্দরবন অঞ্চলে নয়, ভারতের বেশিরভাগ এলাকায় তিনি পূজিতা। বাংলায় তিনি বসন্ত রোগের অধিষ্ঠাত্রী ও প্রশমনকারী দেবী হিসেবে পূজিতা হলেও ভারতের সব জায়গায় তিনি তা নন। মহারাষ্ট্রের পুনেতে মেয়ের বিয়ের সময় মায়েরা মেয়ের কল্যাণের জন্য শীতলার পূজা করেন। মুম্বইতে পুত্রসন্তান কামনায় শীতলা দেবীর পুজো করা হয়। আবার বিহার ও উত্তরপ্রদেশে শীতলা দেবী বাংলার মতোই বসন্ত রোগের দেবী হিসেবে পুজো পান। ওড়িশাতে কিন্তু বসন্ত রোগের দেবীর নাম ‘ঠাকুরানি’, আর অসমে ‘আই’। মহীশূরে বসন্ত ও হামের দেবীর নাম ‘সুখজম্মা’। তামিলনাড়ুর আর্কটে আবার এই দেবীর নাম ‘কানিয়ম্মা’। এই বৈচিত্র্য পৌরাণিক দেবী হলে দেখা যেত না।

(বাঁ দিকে) কাকদ্বীপ অক্ষয়নগরে শীতলা ও বিশালাক্ষীর যৌথ মন্দির। গাববেড়িয়া শীতলা মন্দির (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বিষ-চিকিৎসা পদ্ধতিতে শীতলাকে বসন্ত রোগের দেবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়ুর্বেদ-শাস্ত্র ‘ভাবপ্রকাশ’-এ শীতলা দেবীর যে স্তব রয়েছে তা ‘স্কন্দপুরাণ’-এর অন্তর্গত ‘কাশী খন্ড’ থেকে গৃহীত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল, অনার্য সমাজে শীতলার প্রবল গুরুত্ব তাঁকে আর্যীকরণের দিকে নিয়ে যায়। ফলে কেউ কেউ তাঁর নামে শ্লোক তৈরি করে স্কন্দপুরাণে অন্তর্ভুক্ত করে দেন। বৈদিক পুরোহিতরা তাঁর পূজাপদ্ধতি তৈরি করে বৈদিক সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত করে দেন। লোকদেবদেবীদের উৎপত্তির পেছনে একটাই কারণ রয়েছে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ। আর ঠিক এই কারণেই ভয়ঙ্কর বসন্ত রোগ অধ্যুষিত অঞ্চলে এই রোগের অধিষ্ঠাত্রী ও নিরাময়কারী লোকদেবী হিসেবে শীতলার সৃষ্টি হয়েছে।
বজ্রযান বৌদ্ধতন্ত্রে ‘হারিতী’ নামে এক দেবী আছেন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ওই বৌদ্ধ দেবী হারিতী থেকে শীতলার উদ্ভব। বৌদ্ধ মতে হারিতী হলেন সন্তানের জন্মদাত্রী ও শিশু রক্ষাকারী দেবী। সেখানে বসন্ত রোগের কোনও উল্লেখ দেখা যায় না। তাই শীতলার উৎপত্তি হারিতী থেকে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। তবে দক্ষিণ ভারতে ‘শীতলাম্মা’ নামে এক লৌকিক দেবী আছেন যিনি জলদেবী হিসেবে পূজিতা হন। আবার দক্ষিণ ভারতে কোথাও কোথাও লৌকিক জলদেবতা বা জলদেবীকে বসন্ত রোগ নিরাময়কারী দেবদেবী হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপটনমে লৌকিক জলদেবী ‘গঙ্গম্মা’ হলেন বসন্ত রোগের দেবী। যেহেতু দাক্ষিনাত্য ও বাংলার লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যোগসূত্র পাওয়া যায় তাই বিশেষজ্ঞদের মতে শীতলাম্মা ও শীতলা হলেন একই লৌকিক দেবী। হয়তো অতীতে শীতলা জলদেবীই ছিলেন। কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে একদা যে প্রাচীন শীতলা মন্দির ছিল তা ছিল জলের উপরেই। জলের উপর যে শীতলা পূজা করা হয় তা শীতলার স্তবে উল্লেখ করা হয়েছে—“যস্তামুদকমধ্যে তু কৃতা সংপূজয়েন্নরঃ”। তাছাড়া “শীতল” শব্দ থেকে স্ত্রীলিঙ্গে শীতলা নামটি এসেছে। জল তো শীতলই হয়। বসন্ত রোগে শরীরে প্রদাহসহ যে তাপ উৎপন্ন হয় তা শীতল করার প্রয়োজন হয়।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১১: আমার নাম, তোমার নাম— তুং নাম, তুং নাম!

পরিযায়ী মন, পর্ব-১২: নেতারহাটের নাশপাতি বাগান

দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন রোগের যেসব লৌকিক দেবদেবী রয়েছেন তাঁদের পূজা হয় প্রস্তরখন্ডে। তাঁদের নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। আদিম বা অনার্য সমাজে মাটি, গাছ, পাথর ইত্যাদি বস্তুকে দেবদেবী জ্ঞানে পূজা করা হত। তাই এখনও দক্ষিণ ভারতে পুরোহিত পাথরের খন্ডে সিঁদুর লেপে শীতলাম্মার পুজো করেন। বঙ্গদেশেও আদিতে শীতলা প্রস্তরখন্ড হিসেবে পূজিতা হতেন। সেই পাথরের উপর ব্রণের মতো ফোটা দেওয়া থাকত যা বসন্ত রোগে উৎপন্ন গুটির সাথে তুলনীয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর লেখা “Discovery of Living Buddhism in Bengal” গ্রন্থে কলকাতায় ধর্মঠাকুরের মন্দিরে পাথরের খন্ড রূপে শীতলার কথা লিখেছেন। সুন্দরবন অঞ্চলেও প্রস্তরখন্ডরূপী শীতলার থান থাকার সম্ভাবনা থাকে। তবে বারংবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সেইসব প্রমাণ হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে।
তবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাবে শীতলা দেবীর প্রস্তরমূর্তি মানুষ্যরূপ পাবে না তা কি হয়? ব্রহ্মবৈবর্ত্যপুরাণে মনসা হয়ে গেলেন রক্তবর্ণ বসন পরা এক দেবী যাঁর বাহন হল ময়ূর এবং তাঁর হাতে ধরা একটি মোরগ। কালক্রমে অঞ্চলভেদে তাঁর রূপের কিছু পরিবর্তন হল। সেইসঙ্গে শীতলাকেন্দ্রিক নানা কাহিনি পুরাণে সংযোজিত হতে লাগল। এমনই একটি কাহিনি বলা যাক। স্বর্গের দেবী পার্বতী পৃথিবীর সমস্ত অপশক্তিকে দূর করতে ঋষি কাত্যায়নের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁর নাম হয় কাত্যায়নী। সেই সময় মর্ত্যে জ্বরাসুর নামে এক দুষ্ট অসুর বাচ্চাদের মধ্যে বসন্তসহ নানা রকম রোগ ছড়াচ্ছিল। তাঁকে রুখতে কাত্যায়নী শীতলার রূপ ধরেন এবং জ্বরাসুরকে ধ্বংস করার জন্য তাঁর বন্ধু বটুককে অনুরোধ করেন। বটুক হলেন শিবের এক রূপ। বটুক ও জ্বরাসুরের প্রবল যুদ্ধ হল।

যুদ্ধে প্রথমে জ্বরাসুর জয়ী হলেও জাদুশক্তি প্রয়োগ করে বটুক শেষে জ্বরাসুরকে বধ করেন। আর ওদিকে শীতলা তাঁর শীতলতা শক্তি দিয়ে বাচ্চাদের বসন্তসহ সমস্ত জ্বরের রোগ সারিয়ে তুললেন। স্কন্দপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত্য পুরাণে শীতলাকে গুটি বসন্তের দেবী হিসেবে দেখানো হয়েছে যিনি রোগ ছড়াতে পারেন, আবার নিরাময়ও করতে পারেন। বলা হয়েছে, যজ্ঞের শীতল ভস্ম থেকে তাঁর জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত শিশুকে নানারকম জ্বরের প্রকোপ থেকে বাঁচাতে ব্রহ্মা মানবজাতিকে শীতলাকে এবং সাথে জ্বরাসুরকে পূজা করার পরামর্শ দেন। অসুর হল অনার্য জাতি। সুতরাং জ্বরাসুর হলেন অনার্যদের প্রতিনিধি। আর তাই শীতলা ও জ্বরাসুরের সহাবস্থান শীতলার অনার্য উৎপত্তির তত্ত্বকে সুদৃঢ় করে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৭: মা সারদার ভগবতী সাধনা

শীতলা দেবী দেখতে সুশ্রী বিবাহিতা বাঙালি রমণীর মতো। তাঁর কপালে সিঁদুরের বড়ো টিপ, হাতে শাঁখা। আজানুলম্বিত এলোকেশী। পরণে লাল পাড় সাদা শাড়ি। গায়ের রঙ সবুজাভ যা তাঁর শীতলতাকে প্রকাশ করে। বাহন হিসেবে তিনি নির্বাচন করেছেন গাধাকে। এ এক ভারী আশ্চর্যজনক বাহন। গাধাকে প্রাণীজগতে নির্বুদ্ধিতার প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। প্রাণীসমাজে সে মর্যাদাহীন। কিন্তু গাধা হল এমন প্রাণী যে চুপ করে কষ্টকর কাজ করে এবং কারও কোনও ক্ষতি করে না। জগতের কোনও ক্ষতি না করে সমস্ত রোগভার নীরবে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মতো গুরুভার কাজ করার ক্ষমতা গাধার আছে বলেই মনে হয় শীতলার বাহন হয়েছে গাধা। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, যেহেতু শীতলা অনার্য দেবী থেকে পরে আর্যসমাজে প্রবেশ করেছেন তাই তখন বাহনের অভাব দেখা দিয়েছিল। সমস্ত পৌরাণিক দেবদেবী মর্যাদাসম্পন্ন বাহনগুলোকে দখল করে নিয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে গাধাই হয়েছে সম্বল। তবে এ মনে হয় নিছক রসিকতা।

বঙ্গদেশে বর্তমানে যত শীতলা প্রতিমা দেখা যায় তার দুটি হাত, যদিও অন্য প্রদেশে বা প্রাচীন মূর্তিতে চারটি হাত দেখা যায়। তাঁর ডান হাতে ধরা থাকে একটি ঝাঁটা আর বাম হাতে থাকে একটি জলপাত্র। শীতলার হাতে ঝাঁটা প্রতীক বসন্ত রোগের জীবাণু সহ সমস্ত আবর্জনা যা নানা রোগের কারণ তাকে ঝেঁটিয়ে পরিবেশকে নির্মল করা এবং মানুষকে রোগমুক্ত রাখাকে নির্দেশ করে। তাঁর সবুজ গাত্রবর্ণ নির্মল পরিবেশের প্রতীকও বটে। জলপাত্রে থাকে শীতল জল যা মৃত্যুপথযাত্রীকে জল পান করিয়ে তার জীবন রক্ষাকে নির্দেশিত করে। জল জীবনের প্রতীকও। শীতলা দেবী তো বসন্ত রোগীর প্রাণদায়িনী দেবী। যেখানে প্রতিমার চার হাত রয়েছে সেখানে অন্য দু’হাতে থাকে কলসি ও কুলো। কলসিতে থাকে জল। ধুলো ঝাঁট দেওয়ার সময় আমরা আগে জল ছিটিয়ে দিয়ে তবে ঝাঁট দিই যাতে ধুলো বেশি উড়তে না পারে। তাছাড়া বসন্ত রোগাক্রান্ত তপ্ত দেহে ওই শীতল জল সিঞ্চন করলে তাপজনিত প্রদাহ থেকে রোগী আরাম পায়। গ্রামাঞ্চলে কুলোর হাওয়া দিয়ে চাল থেকে তুষ আলাদা করা হয়, অর্থাৎ অবিশুদ্ধতার মধ্যে থেকে বিশুদ্ধতাকে পৃথক করা হয়। রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে গেলে মানুষকে দিতে হয় বিশুদ্ধ পরিবেশ। সুতরাং কুলো হল বিশুদ্ধতার প্রতীক।

(বাঁ দিকে) কাকদ্বীপের বামানগর গ্রামে প্রাচীন শীতলা মন্দিরের শীতলা (ছবি: লেখক)। পৈলান, বৈদ্যপাড়া শীতলা মন্দিরের প্রতিমা (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

প্রত্যন্ত সুন্দরবনে একসময় গুটি বসন্ত রোগ মহামারি আকারে আবির্ভূত হয়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নিত। যারা বেঁচে যেত তাদের অনেকেই অন্ধ বা বধির হয়ে যেত, নয়তো সারাজীবন চেহারায় বিকৃতি নিয়ে থাকত। ফলে তখন শীতলা দেবীর পুজো হত রমরমিয়ে। গ্রামে গ্রামে তৈরি হয়েছিল শীতলার থান। সে-সব থান এখনও অনেক আছে, কিন্তু গুটি বসন্তের নিবিড় টিকাকরণের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালের পর পৃথিবী থেকে রোগটি নির্মূল হয়ে যাওয়ায় সারা বঙ্গদেশের সাথে সুন্দরবনেও শীতলার প্রভাব কিছুটা কমেছে। তবে হারিয়ে যায়নি, তার কারণ সাপের উপদ্রব সুন্দরবনে আজও প্রবল। ফলে সর্পদেবী মনসার রমরমা বাজার সুন্দরবনে। যেহেতু মনসার সাথে শীতলা একসঙ্গে পুজো পান, তাই মনসার থানে শীতলা কিংবা শীতলার থানে মনসাকে দেখা যায়। সাথে জ্বরাসুরও। অনেক জায়গায় সঙ্গে থাকেন বিশালাক্ষী দেবীও। সুন্দরবনে দেবীদের এই জোট শীতলা বা জ্বরাসুরকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। হারিয়ে যেতে দেয়নি মঙ্গলকাব্যও। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে কবি বল্লভ, কৃষ্ণরাম দাস, দ্বিজ হরিদেব, কবি জগন্নাথ ও মানিকরাম গাঙ্গুলি বিরচিত শীতলামঙ্গল পালা বা শীতলা কথা আজও সুন্দরবনের নানা গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। আর তাই সুন্দরবনে শীতলা দেবী এখনও প্রতি বছর গাধার পিঠে চড়ে আসছেন এবং ঝেঁটিয়ে জীবাণু বিদায় করছেন। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content