কুলপির টেপাখালি পঞ্চানন মন্দিরে বাবা পঞ্চানন। ছবি: সংগৃহীত।
পঞ্চানন নামটা পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব পাড়াতেই পাওয়া যাবে। নাম পঞ্চানন, পদবি পঞ্চানন, এমনকি পাড়া বা গ্রামের নামও পঞ্চানন দিয়ে। পঞ্চানন কথার অর্থ পাঁচটি আনন অর্থাৎ মুখ বিশিষ্ট দেবতা। তাই পঞ্চানন যে শিব তা সবারই জানা। আর শিব যে পৌরাণিক দেবতা তাও সবার জানা। কিন্তু সুন্দরবন অঞ্চল-সহ প্রায় সারা বাংলা জুড়ে অসংখ্য গ্রাম ও শহরে যে দেবতার ভক্তের সংখ্যা সর্বাধিক তা হল সম্ভবত পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ। আর এই দেবতা কিন্তু পৌরাণিক নন, লৌকিক। তবে তিনি পুরোপুরি আঞ্চলিক নন। বাংলার প্রায় সমস্ত জেলায় প্রচুর পঞ্চানন্দের মন্দির রয়েছে। ধর্মঠাকুর ছাড়া আর কোনও লৌকিক দেবতা বাঙালির কাছে এত সম্মান পান না।
যে দেবতা পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ তিনিই মূলত দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বাবাঠাকুর নামে বেশি প্রচলিত। বাবাঠাকুর নামটিতে কিন্তু পৌরাণিকতার ছোঁয়া নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, পঞ্চানন ঠাকুরের আদিতম নাম হল বাবাঠাকুর। আদিম তথা অনার্য সমাজের দেবতা থেকে কালক্রমে বাবাঠাকুর আর্যীকরণের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছেন পঞ্চানন ঠাকুরে। “বাংলার লৌকিক দেবতা” গ্রন্থের প্রণেতা গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু লিখেছেন—“লৌকিক দেবতার নাম শুদ্ধ বা সংস্কৃত ভাষায় আর্যীকরণ প্রচেষ্টা কালে হয়েছে, ওই সকল দেবতারা যে কালে ও যে সমাজে প্রথম উদ্ভূত বা কল্পিত হয়েছিলেন সে সময়ে আরণ্যক সমাজের লোকেরা নিজেদের ভাষায় তাদের নাম দিয়েছিল, শুদ্ধ বা সংস্কৃত ভাষায় দেয়নি, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
(বাঁ দিকে) কুলপিতে পঞ্চানন্দ মন্দির। টালিগঞ্জে বাবা পঞ্চাননের মন্দির (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
পরবর্তীকালে বা বর্তমানে শিক্ষার প্রসার ও পল্লীর সঙ্গে উন্নত স্থানের ব্যবধান কমে যাওয়ায় গ্রামবাসীরাও তাদের দেবতার লোকায়ত নাম ত্যাগ করে উন্নত ভাষার নামই ব্যবহার করছে। … মনে করা যায় ওই সব দেবতা আর্যপূর্ব যুগের কোনও জাতির (হয়ত বা অস্ট্রিক মোঙ্গল ভাষাভাষীদের) এবং তারা তাদের ভাষাতেই ওই দেবতার নামকরণ করেছিল—সে ভাষা আমরা জানি না, বর্তমানে অর্থহীন মনে হচ্ছে, অর্থহীন ওই দেবতাদের আদি নাম একথাও অনুমান করা যায়।”
গোপেন্দ্রকৃষ্ণবাবু আরও লিখেছেন—“দাক্ষিণাত্যে তানজোর অঞ্চলে দ্রাবিড়বংশোদ্ভূত তামিল তেলেগু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ‘তীরুবয়র’ দেবতা আজও পূজিত হন তাঁর সঙ্গে এই পঞ্চানন্দের আকৃতিগত সাদৃশ্য বিস্ময়জনক, পূজাচারেও মিল আছে। ‘বিশ্বকোষের’ মতে উক্ত তীরুবয়র ও পঞ্চানন্দ অভিন্ন।” আবার বাবাঠাকুর নাম প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন—“গুজরাট অঞ্চলে ভীলদের সমাজে অনুরূপ নামের একটি বহুজন-পূজ্য দেবতা আছে, দেবতাটির নাম ‘বাবাদেও’। সকল দেবতাকেই ‘বাবা’ ভক্তরা বলে কিন্তু পঞ্চানন্দের সঙ্গে উক্ত বাবাদেও দেবতার ধারণা-বিশ্বাস-গত মিল আছে…।” এই বক্তব্যগুলি থেকে একথা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ ঠাকুর আসলে লৌকিক দেবতা।
গোপেন্দ্রকৃষ্ণবাবু আরও লিখেছেন—“দাক্ষিণাত্যে তানজোর অঞ্চলে দ্রাবিড়বংশোদ্ভূত তামিল তেলেগু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ‘তীরুবয়র’ দেবতা আজও পূজিত হন তাঁর সঙ্গে এই পঞ্চানন্দের আকৃতিগত সাদৃশ্য বিস্ময়জনক, পূজাচারেও মিল আছে। ‘বিশ্বকোষের’ মতে উক্ত তীরুবয়র ও পঞ্চানন্দ অভিন্ন।” আবার বাবাঠাকুর নাম প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন—“গুজরাট অঞ্চলে ভীলদের সমাজে অনুরূপ নামের একটি বহুজন-পূজ্য দেবতা আছে, দেবতাটির নাম ‘বাবাদেও’। সকল দেবতাকেই ‘বাবা’ ভক্তরা বলে কিন্তু পঞ্চানন্দের সঙ্গে উক্ত বাবাদেও দেবতার ধারণা-বিশ্বাস-গত মিল আছে…।” এই বক্তব্যগুলি থেকে একথা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ ঠাকুর আসলে লৌকিক দেবতা।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১২: স্বপ্নাদেশের দেবী ভবানী
পঞ্চানন্দ বা পঞ্চানন বা বাবাঠাকুর বাঙালির কাছে পাঁচুঠাকুরের মতোই শিশুরক্ষক দেবতা হিসেবে স্বীকৃত। মানুষের বিশ্বাস, তিনি শিশুদের রিকেট ও টিটেনাস রোগ থেকে রক্ষা করেন এবং গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভস্থ ভ্রূণকেও রক্ষা করেন। কোনও কোনও গ্রামে গৃহপালিত পশু-পাখিদের রক্ষক হিসেবেও তিনি পুজো পান। খুব কম ক্ষেত্রে হলেও দেখা যায় দু’ এক জায়গায় তাঁকে শস্যের দেবতা হিসেবে কৃষকরা পুজো করেন। বর্তমানে অধিকাংশক্ষেত্রেই এই দেবতার অধিষ্ঠান পাকা মন্দিরে। শনি ও মঙ্গলবার নিয়মিত পুজো হয়। বর্তমানে ব্রাহ্মণরাই এঁর পুজোর দায়িত্ব নিয়েছেন। কোথাও কোথাও এখনও প্রাচীন রীতি মেনে গাছতলায় পুজো হয় এবং অব্রাহ্মণরা পুজো করেন। মন্দিরে ছাগল বলি বা লাউ বলি দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও ‘পঞ্চানন্দের মাহাত্ম্য’ গাওয়া হয়। কোথাও কোথাও পুজো উপলক্ষ্যে কীর্তনগানের আসরও বসে। যাঁরা মানত করেন তাঁরা মন্দিরের রেলিং-এ বা গাছের ডালে ঢিল বেঁধে ঝুলিয়ে দেন। তাঁদের ধারণা, ওই ঢিলের দিকে দেবতার দৃষ্টি পড়লে তিনি তাঁদের মনোবাসনা পূরণ করবেন।
মথুরাপুরের চিত্রগঞ্জ মন্দিরে বাবা পঞ্চানন। ছবি: সংগৃহীত।
পঞ্চানন্দ দেখতে কিছুটা শিবের মতো হলেও পার্থক্যই বেশি। পঞ্চানন্দের দেহের রং টকটকে লাল। বিরাট গোলাকার তিনটে রক্তচক্ষু দেখে ভীতিসঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। টিকালো নাক। কান পর্যন্ত লম্বা মোচা গোঁফ। মাথায় চূড়া করে বাঁধা জটা। জটার কিছু চুল কপালের উপরে এবং কিছু চুল বুকে ও পিঠে বিস্তৃত। বলিষ্ঠ দেহ কিন্তু কোমরে জড়ানো ব্যাঘ্রচর্ম ছাড়া শরীরে আর কোনও বসন নেই। অবশ্য কোথাও কোথাও ব্যাঘ্রচর্মের পরিবর্তে কাপড় পরা। যেমন খিদিরপুরে ৩০০ বছরের পুরানো পঞ্চানন্দ মন্দিরে দেবতা সাদা থান পরে থাকেন। দু’কানে গোঁজা কলকে ফুল। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। হাতে রুদ্রাক্ষের তাগাও থাকে। পায়ে থাকে খড়ম। তাঁর এক হাতে থাকে ত্রিশূল ও অন্য হাতে ডমরু। কোনও কোনও মূর্তিতে ত্রিশূল ও ডমরু রাখা থাকে পাশে, আর দু’হাত থাকে বরাভয় মুদ্রায়। পাশে অনেক সময় থাকে পাঁচমুখো কলকে। আর কখনও কখনও তাঁর মাথায় ও গায়ে সাপ জড়ানো থাকে।
এঁর দুই অনুচর হলেন ধনু ও টঙ্কার বা পেঁচো ও খেঁচো নামক দু’জন অপদেবতা। এই অপদেবতাদের চেহারা ভয়াবহ। পঞ্চানন্দের সঙ্গে এরাও পূজা পায়। আবার কোথাও অনুচর হিসেবে থাকেন অন্য দুই লোকদেবতা জরাসুর ও পাঁচুঠাকুর। পঞ্চানন্দের বাহন হিসেবে বামন, গোভূত, মামদো ভূত, বাঘ, ঘোড়া, হরিণ, ষাঁড় বা ভালুক ইত্যাদিও থাকে। পঞ্চানন্দ ঠাকুর অধিকাংশ ক্ষেত্রে উঁচু কোনও বেদির উপরে উপবিষ্ট থাকেন। বসার ভঙ্গীও আরামদায়ক—এক পায়ের উপর আর এক পা তোলা। কোথাও কোথাও পঞ্চানন্দের মুণ্ডমূর্তি বা ঘটমূর্তি পূজিত হয়। যেমন হাওড়া জেলার ডোমজুড়ে নারনা গ্রামে ৫০০ বছরের পুরানো পঞ্চানন্দ মন্দিরে ঘট পুজো হয়।
এঁর দুই অনুচর হলেন ধনু ও টঙ্কার বা পেঁচো ও খেঁচো নামক দু’জন অপদেবতা। এই অপদেবতাদের চেহারা ভয়াবহ। পঞ্চানন্দের সঙ্গে এরাও পূজা পায়। আবার কোথাও অনুচর হিসেবে থাকেন অন্য দুই লোকদেবতা জরাসুর ও পাঁচুঠাকুর। পঞ্চানন্দের বাহন হিসেবে বামন, গোভূত, মামদো ভূত, বাঘ, ঘোড়া, হরিণ, ষাঁড় বা ভালুক ইত্যাদিও থাকে। পঞ্চানন্দ ঠাকুর অধিকাংশ ক্ষেত্রে উঁচু কোনও বেদির উপরে উপবিষ্ট থাকেন। বসার ভঙ্গীও আরামদায়ক—এক পায়ের উপর আর এক পা তোলা। কোথাও কোথাও পঞ্চানন্দের মুণ্ডমূর্তি বা ঘটমূর্তি পূজিত হয়। যেমন হাওড়া জেলার ডোমজুড়ে নারনা গ্রামে ৫০০ বছরের পুরানো পঞ্চানন্দ মন্দিরে ঘট পুজো হয়।
আরও পড়ুন:
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৯: যত সুর সবই তোমার…
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?
পঞ্চানন্দ ঠাকুরের পুজোয় যে-সব মন্ত্র ব্যবহৃত হয় তা কিন্তু সব জায়গায় একরকম নয়। এই লৌকিক দেবতার আর্যীকরণের সময় নানা স্থানে নানারূপ ধ্যানমন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। সে-সব ধ্যানমন্ত্র সংস্কৃতে হলেও কোথাও কোথাও সংস্কৃত ও আদিম ভাষার মিশ্রণে বিচিত্র এক ভাষায় ধ্যানমন্ত্র শোনা যায়। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বিনয় ঘোষ মহাশয় লিখেছেন যে, তিনি আরামবাগ অঞ্চলে পঞ্চানন্দের এমন বন্দনামন্ত্র শুনেছেন—
টং টং বিটং কপানি বিটেং
রং রং রক্তবর্ণং রক্তজিহ্বা
রক্তজিহ্বা করালং
ধুং ধং ধূমবর্ণ শকট বিকট নয়নং
পঞ্চাননং ক্ষেত্রপালং নমঃ।
আসলে পঞ্চানন্দের জনপ্রিয়তা দেখে ব্রাহ্মণসমাজ এঁকে শাস্ত্রীয় আচারে পুজো করতে শুরু করে এবং মনগড়া প্রচার চালাতে থাকে যে পঞ্চানন্দ হলেন শিবের রূপভেদ। শিবের আকারের সাথে অনেকটা মিল থাকায় তাঁদের এই প্রচার অনেকটা মান্যতা পেয়েছে। কেউ কেউ বলেন, পঞ্চানন্দ হলেন শিবের পুত্র। আবার কারও মতে ইনি হলেন বটুক ভৈরব। কেউ কেউ বলেন, ইনি হলেন আর এক লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের অন্য রূপ। গোপেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর মতে—“স্থান বিশেষ ধর্মঠাকুরের প্রাধান্য ও পুজোর ব্যাপকতা কাভ করলে পঞ্চানন্দ ও ধর্মঠাকুর মিশ্রিত হয়ে যান, খুবই নিবিড়ভাবে, কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিত ধর্মঠাকুর পঞ্চানন্দকে আত্মসাৎ করতে পারলেন না। নাথযোগীরা যাঁরা এখন পঞ্চানন্দকে ধর্মঠাকুরের আকৃতিভেদ বলে প্রচার করেন, তাঁরাও পূজা কালে ‘পঞ্চানন্দ ধর্মরাজ’ যুগ্ম নামে আহ্বান করেন…।” কিন্তু ব্রাহ্মণেরা বা নাথযোগীরা যা-ই প্রচার করুন না কেন পঞ্চানন্দ শিব বা ধর্মঠাকুর কোনওটাই নন।
টং টং বিটং কপানি বিটেং
রং রং রক্তবর্ণং রক্তজিহ্বা
রক্তজিহ্বা করালং
ধুং ধং ধূমবর্ণ শকট বিকট নয়নং
পঞ্চাননং ক্ষেত্রপালং নমঃ।
আসলে পঞ্চানন্দের জনপ্রিয়তা দেখে ব্রাহ্মণসমাজ এঁকে শাস্ত্রীয় আচারে পুজো করতে শুরু করে এবং মনগড়া প্রচার চালাতে থাকে যে পঞ্চানন্দ হলেন শিবের রূপভেদ। শিবের আকারের সাথে অনেকটা মিল থাকায় তাঁদের এই প্রচার অনেকটা মান্যতা পেয়েছে। কেউ কেউ বলেন, পঞ্চানন্দ হলেন শিবের পুত্র। আবার কারও মতে ইনি হলেন বটুক ভৈরব। কেউ কেউ বলেন, ইনি হলেন আর এক লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের অন্য রূপ। গোপেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর মতে—“স্থান বিশেষ ধর্মঠাকুরের প্রাধান্য ও পুজোর ব্যাপকতা কাভ করলে পঞ্চানন্দ ও ধর্মঠাকুর মিশ্রিত হয়ে যান, খুবই নিবিড়ভাবে, কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিত ধর্মঠাকুর পঞ্চানন্দকে আত্মসাৎ করতে পারলেন না। নাথযোগীরা যাঁরা এখন পঞ্চানন্দকে ধর্মঠাকুরের আকৃতিভেদ বলে প্রচার করেন, তাঁরাও পূজা কালে ‘পঞ্চানন্দ ধর্মরাজ’ যুগ্ম নামে আহ্বান করেন…।” কিন্তু ব্রাহ্মণেরা বা নাথযোগীরা যা-ই প্রচার করুন না কেন পঞ্চানন্দ শিব বা ধর্মঠাকুর কোনওটাই নন।
মন্দিরবাজার ব্লকের বাজারবেড়িয়ায় পঞ্চানন মন্দির। ছবি: সংগৃহীত।
পঞ্চানন্দ যে শিবের আদি রূপ হতেও পারে তার সমর্থনে গোপেন্দ্রকৃষ্ণবাবু লিখেছেন, “শিব আদিতে অনার্যদের উপাস্য ছিলেন পরে আর্যদেবকুলস্থ হয়েছেন, আরও পরে বৌদ্ধ-ধর্মের প্রাবল্য কালে তিনি মহাযোগী রূপে কল্পিত হয়েছেন, বৌদ্ধ প্রভাবে রূপান্তরিত শিব-মূর্তিই আমরা বর্তমানে দেখি, আদি মূর্তি কি ছিল তা জানবার উপায় নেই। তবে ইনি যখন ব্রাত্যদের কল্পিত দেবতা সেদিক দিয়ে অনুমান করা যায় এঁর আদিরূপ নিশ্চয়ই এত সুন্দর ও সৌম্য ছিল না।
আর্যপূর্ব যুগের আদিবাসীরা দেবতাকে মঙ্গলদাতা, করুণাময় বা মহাযোগী বলে কল্পনা করত না, দেবতা বলতে তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ, সদাক্রুদ্ধ, অশরীরী শক্তিই মনে করত, যখন তারা কিছু উন্নত হয়ে সেই অশরীরী আত্মার নিজেদের মতো মনুষ্যরূপ দিতে থাকে সেগুলির আকৃতি অতি ভয়াবহ, উগ্র ভাবব্যঞ্জক ছিল। পরে উন্নত স্থানে ওই শিব শান্তরূপ ধরলেন। আদি শিব আদি উৎপত্তি সমাজে পূর্বরূপ নিয়েই থাকলেন, ‘বাবাঠাকুর’ হয়ত এর আদিনাম ছিল, পরে পঞ্চানন্দ নাম লাভ করলেন, কিন্তু শিবের সঙ্গে এঁর সম্পর্কের কথা ব্রাত্যরা ভুললেন না।” আর এভাবেই আদিম রক্তপিপাসু ভয়াবহ কোনও লৌকিক দেবতার সঙ্গে শান্ত-সৌম্য শিবের মিশ্রণে পঞ্চানন্দ বর্তমান রূপ পেয়েছেন।
আর্যপূর্ব যুগের আদিবাসীরা দেবতাকে মঙ্গলদাতা, করুণাময় বা মহাযোগী বলে কল্পনা করত না, দেবতা বলতে তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ, সদাক্রুদ্ধ, অশরীরী শক্তিই মনে করত, যখন তারা কিছু উন্নত হয়ে সেই অশরীরী আত্মার নিজেদের মতো মনুষ্যরূপ দিতে থাকে সেগুলির আকৃতি অতি ভয়াবহ, উগ্র ভাবব্যঞ্জক ছিল। পরে উন্নত স্থানে ওই শিব শান্তরূপ ধরলেন। আদি শিব আদি উৎপত্তি সমাজে পূর্বরূপ নিয়েই থাকলেন, ‘বাবাঠাকুর’ হয়ত এর আদিনাম ছিল, পরে পঞ্চানন্দ নাম লাভ করলেন, কিন্তু শিবের সঙ্গে এঁর সম্পর্কের কথা ব্রাত্যরা ভুললেন না।” আর এভাবেই আদিম রক্তপিপাসু ভয়াবহ কোনও লৌকিক দেবতার সঙ্গে শান্ত-সৌম্য শিবের মিশ্রণে পঞ্চানন্দ বর্তমান রূপ পেয়েছেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৩: নহবতবাড়ির ‘এতটুকু বাসা’
পরিযায়ী মন, পর্ব-৮: চোখিধানির জগৎখানি
তবে লৌকিক দেবতা পঞ্চানন্দ যে বাঙালি আর্যসমাজে বহুকাল আগে উচ্চ আসনে অধিষ্টিত হয়েছেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া গিয়েছে ‘বৃহদ্রুদ্রযামল’ নামক প্রাচীন পুঁথি আবিষ্কারের পর। এটি হল সংস্কৃতে রচিত একটি তান্ত্রিক পুঁথি। এই পুঁথির তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ডে পঞ্চানন্দের কথা উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, পঞ্চানন্দ পাঁচ মুখবিশিষ্ট দেবতা। তাঁর রং সাদা। তিনি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসে কয়েকজন ব্রাহ্মণকে রোগাক্রান্ত করেন এবং পরে রোগমুক্তও করেন। আর এভাবেই তিনি সবার কাছে শ্রদ্ধার দেবতা হয়ে ওঠেন। রেভারেন্ড লালবিহারী দে মহাশয়ের লেখা “Bengal Peasant Life” (১৮৭২) গ্রন্থেও শ্বেতবর্ণ ও পঞ্চমুখবিশিষ্ট পঞ্চানন্দের উল্লেখ রয়েছে। কলকাতার সাউথ সিঁথি রোডে পঞ্চানন্দের মন্দিরে এই চেহারায় পঞ্চানন্দ আজও আছেন।
মনসা, শীতলা, জরাসুরের সাথে পঞ্চানন্দ কুলপির পঞ্চানন্দ মন্দিরে। ছবি: সংগৃহীত।
প্রায় সব জেলায় পঞ্চানন্দের মন্দির থাকলেও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় তাঁর মন্দির ও প্রভাব সর্বাধিক। জয়নগর-মজিলপুর পুরসভার মধ্যে রয়েছে ১৫/১৬ টি পঞ্চানন্দ মন্দির। কুলপি ব্লকের করঞ্জলিতে পঞ্চানন্দ ঠাকুরের প্রভাব ব্যাপক। পঞ্চানন্দ ঠাকুরের অনেক মন্দির রয়েছে কাকদ্বীপ, মন্দিরবাজার, মথুরাপুর, বিষ্ণুপুর ইত্যাদি এলাকায়।
এই জেলার শহর, মফঃস্বল ও গ্রামে প্রচুর দেখা যায় ‘পঞ্চানন্দ ভান্ডার’, ‘পঞ্চানন্দ স্টোর্স’, ‘পঞ্চানন্দ বস্ত্রালয়’ ইত্যাদি নামের দোকান। মধ্যযুগীয় কাব্য “তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব”-এ এবং দ্বিজ দুর্গারাম বিরচিত “পঞ্চানন মঙ্গল” নামক মঙ্গলকাব্যে পঞ্চানন্দের দেখা পাই। রূপরামের লেখা “ধর্মমঙ্গল” কাব্যেও পঞ্চানন্দের কথা উল্লেখ আছে। বাংলার লৌকিক দেবদেবীর আর্যীকরণের দৌড়ে সম্ভবতঃ প্রথম স্থান অধিকার করে নিয়েছেন পঞ্চানন্দ বা পঞ্চানন বা বাবাঠাকুর।—চলবে।
এই জেলার শহর, মফঃস্বল ও গ্রামে প্রচুর দেখা যায় ‘পঞ্চানন্দ ভান্ডার’, ‘পঞ্চানন্দ স্টোর্স’, ‘পঞ্চানন্দ বস্ত্রালয়’ ইত্যাদি নামের দোকান। মধ্যযুগীয় কাব্য “তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব”-এ এবং দ্বিজ দুর্গারাম বিরচিত “পঞ্চানন মঙ্গল” নামক মঙ্গলকাব্যে পঞ্চানন্দের দেখা পাই। রূপরামের লেখা “ধর্মমঙ্গল” কাব্যেও পঞ্চানন্দের কথা উল্লেখ আছে। বাংলার লৌকিক দেবদেবীর আর্যীকরণের দৌড়ে সম্ভবতঃ প্রথম স্থান অধিকার করে নিয়েছেন পঞ্চানন্দ বা পঞ্চানন বা বাবাঠাকুর।—চলবে।