রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


দুই বোন-সহ ওলাবিবি।

‘ওলাবিবি’ শব্দটির সঙ্গে আমার পরিচিতি আশৈশব। কারণ প্রায় অর্ধশতক আগে দারিদ্র্যপীড়িত সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে এক বিভীষিকাময় রোগ ছিল বিসূচিকা বা কলেরা। তখন গ্রামে সরকারি নলকূপের সংখ্যা ছিল খুব কম বা কোথাও আদৌ নেই। অধিকাংশ সাধারণ মানুষ পানীয় জল হিসেবে পুকুরের জল খেতে বাধ্য হত। ছিল না কোনও স্থায়ী শৌচাগার। ফলে সমস্ত মানুষ খোলা মাঠে মল ত্যাগ করত আর শৌচকর্ম করত পুকুরে। আবার সেই পুকুরের জল রান্নার কাজে বা পানীয় জল হিসেবে ব্যবহৃত হত।

তাছাড়া স্নান এবং জামাকাপড় ধোয়াও হত সেই পুকুরে। কখনও একটা বড়ো পুকুর পাড়ার অনেক পরিবারও ব্যবহার করত। ফলে জলবাহিত রোগ কলেরায় প্রতি বছর প্রচুর মানুষ মারা যেত। শিশুদের রোগপ্রতিরোধক্ষমতা কম হওয়ায় সুন্দরবনে শিশুমৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। অবশ্য আমি শৈশবে বিসূচিকা বা কলেরা শব্দদুটোর সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিলাম না। সাধারণ মানুষের মুখে শুনতাম রোগটির নাম ‘ওলাউঠা’। ঝগড়াঝাটির সময় একজন আর একজনকে অভিশাপ দিতে শুনেছি—“তোর ওলাউঠা হবে।” সুতরাং কলেরা বা ওলাউঠা নিয়ে মানুষের ভয়ানক আতঙ্ক ছিল। জলা-জঙ্গলঘেরা সুন্দরবনে তখন রোগমুক্তির জন্য দেবদেবীর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া মানুষের গত্যন্তর ছিল না। ওলাবিবি হলেন সেই ওলাউঠা রোগের অধিষ্ঠাত্রী লৌকিক দেবী।
যদিও ওলাবিবি বর্তমান সুন্দরবন এলাকার বাইরে, এমনকি অন্যান্য কয়েকটি জেলাতেও পূজিতা হন। তবে সুন্দরবন তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় এই দেবীর প্রভাব সর্বাধিক। ‘ওলা’ কথার অর্থ হল পাতলা পায়খানা, আর ‘উঠা’ কথার অর্থ বমন। যেহেতু কলেরা রোগের প্রধান লক্ষণ হল পাতলা পায়খানা ও বমি তাই রোগের নাম ওলাউঠা। আর তা থেকেই এই লৌকিক দেবীর নাম হয়েছে ওলাবিবি। তবে অনেক জায়গায় এঁকে ওলাইচন্ডী বা বিবিমা-ও বলা হয়। ওলাবিবির কোনও পাকা মন্দির হয় না। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কোনও বৃক্ষের নীচে বা মাটির কুঁড়ে ঘরে পুজো হয়। ইনি কারও বাড়িতে পূজিতা হন না।

তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, করঞ্জলি, জয়নগর, বারুইপুর ইত্যাদি নানা জায়গায় ওলাবিবির থান আছে। থানগুলিতে তাঁর নিত্য পুজো হয়। তাতে কোনও আড়ম্বর থাকে না। নৈবেদ্য হিসেবে সন্দেশ, বাতাসা, পান, সুপারি, আতপ চাল, পাটালি ইত্যাদি দেওয়া হয়। তবে বছরে বিশেষ দিনে আড়ম্বর সহকারে পুজো হয়। সেই পুজোয় গান, উৎসব, ছাগ বলি ইত্যাদি হয়।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৭: আমি শুধুই উদাস, জলজ্যান্ত লাশ

ওলাবিবি সুন্দরবনের অন্য লৌকিক দেবদেবীর মতো হিন্দু বা মুসলিম কোনও একটি সম্প্রদায়ের দেবী নন। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে পুরোহিত বা ফকিরের হাতে নৈবেদ্য তুলে দিতে বা হাত থেকে প্রসাদ নিতে কুন্ঠাবোধ করে না। সাধারণত হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে হিন্দু পুরোহিত ও মুসলিম প্রধান অঞ্চলে মুসলিম ফকির দ্বারা ওলাবিবি পূজিতা হন। তাই হিন্দুপ্রধান ও মুসলিম প্রধান অঞ্চলে তাঁর মূর্তিতেও কিছু তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।

হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে তাঁর প্রতিমার মুখ খুব সুশ্রী, অনেকটা লক্ষ্মী বা সরস্বতীর মতো। রং হলুদ, চোখ টানা, দুটো বা তিনটে চোখ, নানা অলঙ্কারে ভূষিতা, মাথায় মুকুট, কখনও বা এলোকেশী, পরণে নীল শাড়ি। তিনি কখনও দাঁড়িয়ে থাকেন, কখনও বা উপবিষ্ট। উপবিষ্ট অবস্থায় তাঁর কোলে কখনও কখনও শিশু সন্তান দেখা যায়। মুসলিম প্রধান অঞ্চলে তাঁর মূর্তি বর্ধিষ্ণু মুসলিম বাড়ির বালিকার মতো। পরণে ঢিলা জামা, পায়জামা, ওড়না, টুপি, নাগরা জুতো ও মোজা। টিকলি, ঝুমকো, টায়রা, নাকছাবি, বাউটি ইত্যাদি অলঙ্কারে ভূষিতা। হাতে আসাদণ্ড।

ওলাবিবির থান, গাছতলায়।

অনেক থানে ওলাবিবি এককভাবে পূজিতা হন। আবার অনেক থানে তিনি তাঁর অন্য ছয় বোনের সঙ্গে পূজিতা হন। এঁরা হলেন আসানবিবি, ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি ও ঝেটুনেবিবি। এই সব থানকে বলে সাতবিবির থান। তবে সাত বোনের মধ্যে ওলাবিবির গুরুত্ব বেশি। হাম ও বসন্তের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে ওলাবিবির পরে ঝোলাবিবির গুরুত্ব। মধ্যযুগে রচিত “সাতবিবির গান” কাব্যসমূহে এঁদের মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়। কোথাও কোথাও আবার নয় বিবি-ও বলা হয়। এঁদের সাথে মড়িবিবি নামও শোনা যায়। মুসলিম ফকির বা গুণিনরা তাঁদের মন্ত্রে আবার ফতেমাবিবি, ফুলবিবি, গুলালবিবি, দুলছায়াবিবি, মাইচাম্পাবিবি, খুরশানবিবি, রসুনবিবি, জটেমাবিবি প্রমুখের নাম নেন।

কিন্তু কেন সাত বোনকে একসাথে পুজো করা হয়? এই রীতির উৎস কোথায়? অনেক লোকসংস্কৃতি গবেষকের মতে, বীরভূম ও বাঁকুড়ার গ্রামাঞ্চলে ‘সাতবাউনী’ বা সাত বনদেবী (চমকিনী, সনকিনী, রঙ্কিণী প্রমুখ) এবং জঙ্গলমহলে ‘জামমালা’ দেবীর সাত বোনের (বিলাসিনী, কাজিজাম, বাশুলি, চণ্ডী প্রমুখ) সঙ্গে ওলাবিবিসহ সাত বোনের আকৃতি ও পুজোপদ্ধতিতে যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়। লোকসংস্কৃতি গবেষক বিনয় ঘোষের মতে, এই বনদেবীরা মুসলিম আমলে নিম্নবঙ্গে সাতবিবিতে রূপান্তরিত হয়েছেন। লোকসংস্কৃতি গবেষক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর মতে, সাতটি দেবীর একত্রে পূজার প্রথা ভারতে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছিল।
মহেঞ্জোদাড়ো থেকে প্রাপ্ত পোড়ামাটির একটি ফলকে সাতটি নারীর দন্ডায়মান মূর্তি দেখা গিয়েছে। আবার দক্ষিণ ভারতে কোনও রোগের প্রাদুর্ভাব হলে মীনাক্ষী ও তাঁর ছয় বোনের পূজার প্রথা সুন্দরবনে সাতবিবির পুজোকে স্মরণ করায়। গোপেন্দ্রকৃষ্ণবাবু লিখেছেন, “দক্ষিণ ভারতের ‘মারাম্মা’, ‘আনকাম্মা’ ও উড়িশার ‘যোগিনী দেবী’ কলেরার দেবীরূপে পূজিত। ইঁহাদের পূজা-পদ্ধতি ওলাবিবির অনুরূপ।”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১২: জয়রামবাটিতে প্রত্যাবর্তন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

অবশ্য ওলাবিবি অনেক মন্দিরে অন্য দেবতাদের পাশাপাশি থেকেও পূজিতা হন। যেমন কলকাতার বেলগাছিয়া ওলাইচণ্ডী মন্দির অনেক প্রাচীন। এখানে অন্য দেবতাদের মূর্তি থাকলেও ওলাইচচণ্ডী বা ওলাবিবির মূর্তি হল একটি পাথরের খন্ড। এসএন ব্যানার্জি রোডে শীতলা মন্দিরে ও বাঞ্ছারাম অক্রুর লেনের ধর্মঠাকুরের মন্দিরেও ওলাবিবির মূর্তি রয়েছে। হাওড়া শহরের দক্ষিণ প্রান্তে ওলাবিবি লেনে যে স্থায়ী থান রয়েছে সেখানে মূর্তির বদলে রয়েছে সাত বিবির সাতটি প্রতীক স্তূপ। টালিগঞ্জে বাবুরাম ঘোষ স্ট্রিটের ওলাবিবি মন্দিরেও স্তূপ পুজো হয়, তবে এখানে স্তূপের সংখ্যা তিন। জয়নগরে রক্তা খাঁ পল্লীর ওলাবিবির থানের খ্যাতি রয়েছে খুব ‘জাগ্রত’ হিসেবে। এখানেও কোনও মূর্তি নেই। থানের মধ্যে রয়েছে দুটি সমাধি যার মধ্যে একটি ওলাবিবি হিসেবে পূজিতা হন। অন্যটি সম্ভবত রক্তা খাঁ গাজীর সমাধি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

গ্রামাঞ্চলে ওলাবিবির পূজাপদ্ধতির একটি বিশেষ রূপ রয়েছে। পুজোর যাঁরা উদ্যোক্তা তাঁরা কয়েকজন দল বেঁধে গ্রামের বিভিন্ন লোকের বাড়ি ‘মাঙন’ চাইতে যান। মাগা বা চাওয়া অর্থে মাঙন কথাটি ব্যবহৃত হয়। মাঙন হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল, ডাল, ফল, সবজি, টাকা ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়। আমি ছোটবেলায় দেখতাম মাঝে মাঝেই চার-পাঁচ জন দরিদ্র মুসলিম মহিলা দল বেঁধে বাড়িতে এসে বলত, “ওলাবিবির মাঙন দাও মা!” তাদের কারও হাতে থাকত বেতের তৈরি ছোটো ‘খুপি’ (চুবড়ির মতো) বা কারও মাথায় বেতের ধামা। বেশির ভাগ লোক মাঙন হিসেবে চাল দিত। আমরাও চাল দিতাম। যে বছর বন্যা হত সেই বছর একাধিক দল মাঙন চাইতে একাধিকবার আসত, বন্যা হলে কলেরার প্রকোপ বাড়ত। এই ‘মাঙন’ রীতিটি গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর মতে—“সম্ভবত কোন আদিম যুগের Food-gathering or Food Collecting কালের নিদর্শন এবং গ্রাম্য মোড়ল বা গোষ্ঠীপতির নায়কত্বে সমষ্টিগত পুজোর রীতি Community worship হয়ত আর্য-পূর্ব যুগের একটি পূজাচার কোনও মতে—দ্বীপাবদ্ধ, বিচ্ছিন্ন ও রক্ষণশীল পল্লীসমাজে আজও থেকে গেছে।”

ওলাবিবি—স্তূপ পুজো।

আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামেই ছিল ওলাবিবির থান। গ্রামের থানে ওই গ্রামের মোড়ল বা কোনও প্রতিনিধি ওলাবিবির পুজো করেন। অনেকে মানত করে থানের নিকটস্থ কোনও বৃক্ষের ডালে বা থানের রেলিং-এ একটা ঢিল বেঁধে ঝুলিয়ে দেন। একে বলে ‘ঢিল-বাঁধা মানত’। মনস্কামনা পূরণ হলে ভক্তরা দেবীর ‘ছলন’ (দেবতা বা পশুর ক্ষুদ্রাকৃতি মূর্তি) দিয়ে বা জাঁকজমক করে পুজো দেন। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে শনি ও মঙ্গলবার নিয়মিত পূজা হয়। সেখানে ওলাবিবি না বলে ওলাইচণ্ডী নাম প্রচলিত। অনেক ক্ষেত্রে মহিলারা পুজো করেন। যেখানে হাড়ি বা ডোম শ্রেণির মানুষ বাস করেন সেখানে তাঁরাই পুরোহিত হন এবং সেখানে হাঁস বা মুরগি বা ছাগ বলি হয়। মুসলিম প্রধান অঞ্চলে ওলাবিবি বা বিবিমা নাম বেশি প্রচলিত। বার্ষিক পূজা-হাজোতের সময় অনেক জায়গায় পালাগানের আসর বসে। এমনই একটি পালাগানের বন্দনা গান হল—
বন্দিলাম নূরনদী মা ওলাবিবি
তোমরা বিবি আলমের সার
তোমাদের জহুরা যতো
তাহা বা বলিব কত
বিধিমতে করিলে অপার।

ওলাবিবি পালাগানের গায়েন ও বায়েনরা প্রায় সবাই হন অবর্ণ হিন্দু। এঁদের মধ্যে পৌন্ড্র জনগোষ্ঠির লোক বেশি। বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন কলেরা রোগে মৃত্যুর হার অনেক কমে গিয়েছে। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতি পাড়াতে এখন পানীয় জলের নলকূপ। প্রায় সব বাড়িতেই পাকা শৌচাগার। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে সুন্দরবনের জনবসতি দ্বীপগুলো আর আগের মতো দুর্গম নয়। কলেরার আধুনিক চিকিৎসা এখন সুন্দরবনবাসীর কাছে অনেক সহজলভ্য। মানুষের সচেতনতাও অনেক বেড়েছে। আর তাই ওলাবিবি বা ওলাইচণ্ডীর গুরুত্ব এখন অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। তার প্রমাণ, এখন ওলাবিবির মাঙন চাইতে আর কাউকে আসতে দেখি না।—চলবে।

ছবি: লেখক।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content