শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আটেশ্বর মন্দিরের প্রতিমা, কাকদ্বীপ (বাম দিক থেকে শীতলা, বিশালাক্ষী, আটেশ্বর বা শিব ও মনসা)। ছবি: সংগৃহীত।

সুন্দরবনের নানা লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে অতি প্রাচীন এক দেবতা হলেন আটেশ্বর। তবে অতীতে তাঁর যথেষ্ট প্রাধান্য থাকলেও পরবর্তীকালে বনবিবি, দক্ষিণ রায় বা বড় খাঁ গাজীর তুলনায় প্রাধান্য হ্রাস পেয়েছে। আটেশ্বর হলেন মূলত গ্রামরক্ষক দেবতা। বনাকীর্ণ নিম্নবঙ্গ অঞ্চলের গ্রাম্য মানুষের কাছে তিনি অরণ্য রক্ষক ও গ্রামের পশুরক্ষক দেবতা হিসেবে পূজা পেয়ে থাকেন। এক সময় বনে প্রবেশের আগে মৌলে, বাউলে বা শিকারীরা আটেশ্বরকে পুজো দিত। কৃষকরাও ফসল ও গৃহপালিত পশুদের রক্ষার জন্য পুজো দিত। এই কারণে দুই ২৪ পরগনার নানা জায়গায় একসময় আটেশ্বরের থান তৈরি হয়েছিল। তবে সব থানে আটেশ্বরের মূর্তি নেই। অনেক জায়গায় তিনি প্রাচীন আরণ্যক সমাজের রীতিতে মাটির স্তূপ হিসেবে পূজিত হন।
আবার মেদিনীপুরেও কাঁথি এলাকায় আটেশ্বরের উপস্থিতি দেখা যায়। অবশ্য এখানে তিনি অশরীরী অপদেবতা হিসেবে তাঁর অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন। এখানে মানুষের বিশ্বাস আটেশ্বর গাছে থাকেন। এখানে যে গাছে আটেশ্বর আছেন বলে মানুষ বিশ্বাস করে সেই গাছকেই তারা পুজো করে। মানুষের বিশ্বাস, আটেশ্বর গ্রামেরই কোনও মানুষের রূপ ধারণ করে যার সাথে দেখা করেন তার মারাত্মক অসুখ হয়। এই বিশ্বাস অবশ্য উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় নেই। আটেশ্বরকে অঞ্চলভেদে ‘আট-মুনসি’ বা কেবল ‘আট’-ও বলা হয়।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১২: সুন্দরবনের আর এক ব্যাঘ্রদেবতা বড় খাঁ গাজী

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

আটেশ্বর দেখতে কেমন? সত্যি বলতে কী আটেশ্বরের নির্দিষ্ট মূর্তি নেই। এই লৌকিক দেবতার চেহারার বিবর্তন লক্ষ্যণীয়। সবচেয়ে প্রাচীন মূর্তিটিতে দেখা যায় গায়ের রং হালকা নীল বা সবুজ, মাথায় যোদ্ধাদের মতো পাগড়ি, মল্লযোদ্ধার মতো মালকোঁচা মেরে পরা হলুদ রঙের কাপড়, বাবরি ছাঁটের বড় চুল, কানে মাকড়ি, হাতে বালা, গলায় হার, একজোড়া মোচা গোঁফ কিন্তু দাড়ি নেই, বড় বড় চোখ, বলিষ্ঠ পেশিবহুল চেহারা। চেহারায় একটা আদিমতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর বাম হাত মুষ্টিবদ্ধ এবং ডান হাতে ধরা একটা মুগুর।

এই মুগুরের চেহারা সুন্দরবনের মউলেদের ব্যবহার করা কাঁটা-মুগুরের মতো। গরান বা গর্জন গাছের শেকড় সহ গোড়ার দিকের অংশ কেটে নিয়ে কিছুটা শেকড় রেখে ছেঁটে দেওয়া হয়। বাঘের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এই মুগুর প্রাচীন কাল থেকে সুন্দরবনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আঘাত করলে সূচালো শেকড়গুলো কাঁটার মতো বাঘের গায়ে গেঁথে যায়। ফলে বাঘ জব্দ হয়, এমনকি মারাও যায়। এই মুগুরকে ছাঁটা-মুগুরও বলে। যেহেতু আটেশ্বর গ্রামরক্ষক দেবতা তাই তাঁর হাতে এমন অস্ত্র খুব মানানসই। অবশ্য কোথাও কোথাও পৌরাণিক দেবতাদের মতো রাজবেশে আটেশ্বরকে দেখা যায়।

আটেশ্বর মন্দির, কাকদ্বীপ (বাঁ দিকে)। এখানেই আটেশ্বর মেলাও বেশ জনপ্রিয় (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

সুন্দরবন অঞ্চলের কোথাও কোথাও আটেশ্বর রূপান্তরিত হয়েছে শিব বা শিবপুত্রে। শিব বা শিবপুত্র হলেন পৌরাণিক দেবতা, আর আটেশ্বর হলেন লৌকিক দেবতা। যেমন আমার নিবাস কাকদ্বীপ শহরের উপকন্ঠে রয়েছে পুরোনো আটেশ্বর মন্দির। প্রতি বছর সেখানে মাঘী পূর্ণিমায় জাঁকজমক সহকারে পুজো হয়। মন্দিরটি খুব বেশি পুরোনো নয়। যাঁরা মানত করেন তাঁরা মন্দিরের পাশে বট গাছে লাল ডোর বেঁধে যান। আর তাঁরা মানত পূরণ হওয়ার পর মন্দিরে আটেশ্বরের ছোট মূর্তি রেখে যান। মন্দিরে কোনও পুরোহিত নেই। নিজেরাই পুজো দেন। পুজোর পদ্ধতি অনেকটা আরণ্যক। আগুনে গোটা শোলমাছ পুড়িয়ে ভাতের সঙ্গে নৈবেদ্য হিসেবে কলাপাতায় সাজিয়ে পাশের কোনও ঝোপে রেখে আসতে হয়। রাখার পর পেছন ফিরে দেখার নিয়ম নেই।

স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, সবাই চলে গেলে আটেশ্বর এসে নৈবেদ্য গ্রহণ করেন। কিন্তু কাকদ্বীপের আটেশ্বর মন্দিরে যেসব মূর্তি মানতকারীরা দেন বা যে মূর্তি পূজিত হয় তা হল শিবের মূর্তি। এখানে আটেশ্বরের প্রকৃত মূর্তি অতীতে ছিল কিনা জানা যায় না, কিন্তু বর্তমানে শিবের মূর্তিই বিরাজমান। তবে তাঁর সঙ্গে পূজিত অন্য আরও তিন দেবীকে দেখা যায় যাঁরা সুন্দরবন অঞ্চলে খুবই খ্যাত—শীতলা, বিশালাক্ষী ও মনসা। আমরা ছোটবেলায় একটা ছড়া শুনতাম—“জয় বাবা আটেশ্বর / হুঁকো ছেড়ে কলকে ধর।” কলকেতে গঞ্জিকা সেবনকারী হিসেবে খ্যাত শিব। তাই কি এভাবেই আটেশ্বর লৌকিক দেবতা থেকে পৌরাণিক দেবতায় বিবর্তিত হচ্ছেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন লোকসংস্কৃতির গবেষকরা।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

পরিযায়ী মন: নীলনদের দেশে পিরামিড মানে অপার বিস্ময়

কাকদ্বীপ শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বামানগর গ্রামে চড়কতলায় রয়েছে আটেশ্বরের আরও একটি প্রাচীন থান। আগে মন্দির লাগোয়া একটা বটগাছের নীচে পুজো হত। রীতিমাফিক এখনও সেখানে পুজো হলেও পাশে নবনির্মিত মন্দিরে ঘটা করে পুজো হয়। মন্দিরে পুজোর জন্য স্থায়ী পুরোহিত রয়েছে। মাঘী পূর্ণিমায় প্রতি বছর পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে। কয়েক রাত ধরে যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এখানে মন্দিরে আটেশ্বরের মূর্তি যোদ্ধা বেশধারী এবং তিনি ঘোড়ার উপরে আসীন। আর আটেশ্বরের হাতে ছাট মুগুরের পরিবর্তে রয়েছে তীর-ধনুক।

মানতকারীরা যোদ্ধাবেশী আটেশ্বরের মূর্তি দান করলেও শিবের মূর্তিও কেউ কেউ দেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাট-২ ব্লকে পূর্ব কামারপুকুরিয়া গ্রামে, মথুরাপুরের পাটকেলবেড়িয়া বা রায়দিঘির আটেশ্বরতলায় যে মূর্তি দেখা যায় তা ওই যোদ্ধাবেশী, বাবরি চুলযুক্ত আটেশ্বরের মূর্তি। বাংলার লৌকিক দেবতা বিষয়ে গবেষক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু বলেছেন—“অনেক পল্লীবাসী এঁকে ‘আটেশ্বর শিব’ অর্থাৎ শিবের আকৃতিভেদ মনে করেন। উন্নত পল্লীর থানে বর্ণ-ব্রাহ্মণরা এঁর পূজা করেন। পুজোয় ব্রাহ্মণ্য বিধান অনুসরণ করা হয়, সংস্কৃত মন্ত্রও ব্যবহার করা হয়।”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৫: একটাই ডেনজার জুজু যদি ধরে

আটেশ্বর যদি লৌকিক দেবতা হন তবে সুদূর অতীতে এই নামে কি কোনও ব্যক্তি ছিলেন? সুন্দরবন অঞ্চলে কোথাও কোথাও ‘আট’ মানে উঁচু জমি। মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ‘আটান’ কথাটি প্রচলিত আছে। আমার পরিবারেও শব্দটি ব্যবহৃত হয় ফসল চাষের উঁচু জমি বা চাষযোগ্য বাস্তুজমি বোঝাতে। যেহেতু এই দেবতা গ্রামরক্ষক, তাই তাঁর অবস্থান উঁচু জমিতেই হওয়া সম্ভব। তাই ‘আট’ বা ‘আটান’ থেকে আটেশ্বর নামকরণ হওয়া অসম্ভব নয়। আবার ‘আট’ মানে বনকেও বোঝায়। সেক্ষেত্রে অরণ্য রক্ষক বা অরণ্যের দেবতা অর্থে আটেশ্বর নামকরণ অস্বাভাবিক নয়।

কাকদ্বীপের বামানগরে আটেশ্বর (বাঁ দিকে)। মগরাহাট-২ ব্লকের পূর্ব কামারপুকুরিয়া গ্রামে আটেশ্বর (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

লোকসংস্কৃতি গবেষক অরুণকুমার রায় আটেশ্বরের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ফ্রিজিয় দেবতা ‘আটিশ’ (Attis)-এর নাম ও চেহারায় মিল খুঁজে পেয়েছেন। ‘আটিশ’-ও অরণ্যরক্ষক দেবতা এবং তাঁরও বাবরি ছাঁটের চুল। আমরা জানি প্রাচীন সুন্দরবনের জনবসতি ছিল খুব সমৃদ্ধ এবং সেই বসতির সাথে বানিজ্যসূত্রে বহু দেশের যোগাযোগ ছিল। এভাবে বিশ্ব লোকসংস্কৃতির সাথে সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতির একটা যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। সুতরাং আটেশ্বরের উৎপত্তি ‘আটিশ’ থেকে হওয়াও অসম্ভব নয়।

উৎপত্তি যেভাবেই হোক সুন্দরবন অঞ্চলে আটেশ্বরের জনপ্রিয়তা আগের মতো না হলেও এখনও যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। যতই আটেশ্বরকে পৌরাণিক দেবতায় উন্নীত করার চেষ্টা হোক না কেন অনেক থানে তাঁর চেহারা এবং পূজাপদ্ধতিতে আজও আছে আদিমতা। এখন দেখার, বাবা আটেশ্বর কতদিন তাঁর এই আদিমতা ধরে রাখতে পারেন। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content