রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


বনবিবির পায়ের কাছে দুখে, ডানদিকে গাজি আউলিয়া এবং বনবিবির বাম দিকে শাহ জঙ্গলি ও ব্যাঘ্ররূপী দক্ষিণরায়।

মানবজাতি আগে না দেবদেবী—কার সৃষ্টি আগে? এ প্রশ্নের উত্তর খুবই স্পষ্ট—মানবজাতির সৃষ্টি আগে। প্রাচীনকালে যখন মানুষের কাছে প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয় মোকাবিলা করার উপায় জানা ছিল না, নানা রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ জানা ছিল না তখন তারা কল্পনা করেছিল তাদের ওই অসহায়তা থেকে রক্ষা করতে পারে তাদের অলক্ষ্যে থাকা কোনও দৈব শক্তি। এ ভাবেই প্রাচীনকালে মানুষের কল্পনায় সৃষ্টি হয় দেবদেবী, আর সৃষ্টি হয় সেইসব দেবদেবীকে ঘিরে নানা কাহিনি। একইভাবে প্রাচীনকালে শ্বাপদসঙ্কুল গহন অরণ্য সংলগ্ন গ্রামে বা অরণ্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের কাছে অরণ্যচারী হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে বেঁচে ফেরার উপায় জানা ছিল না। পেটের দায়ে তাদের অরণ্যের গভীরে যেতেই হত, কিন্তু ভয়ানক হিংস্র জন্তুদের কাছে তারা ছিল অসহায়। এই অসহায়তা থেকেই ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় ‘অরণ্য দেবতা’। নানা দেশে নানা অরণ্য দেবতা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা লোককথা, উপকথা। সুন্দরবনও তার ব্যতিক্রম নয়।

সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ মূলত হিন্দু ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলেও তাদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি কখনওই ছিল না। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ধর্মীয় দেবদেবীর যত গুরুত্ব তার চেয়ে ‘অরণ্য দেবতা’-দের গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, অনেকক্ষেত্রে ধর্মীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠে দেবদেবীকেন্দ্রিক ধর্ম-সমন্বয় ঘটেছে। একই দেবতাকে আরাধনা করে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ। এ এক অদ্ভুত ধর্মীয় ঐক্য সুন্দরবনের অধিবাসীদের মধ্যে। সুন্দরবনের দেবদেবীরা তাই পৌরাণিক কোনও দেবদেবী নয়। তাঁরা মানুষের মধ্যে থেকে সৃষ্ট মানুষরূপী দেবদেবী বা লৌকিক দেবদেবী।
সুন্দরবনের লৌকিক দেবদেবীদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম হল বনবিবি। আমার ছোটবেলায় দেখতাম পৌষ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বহু গরিব মানুষ ‘বনবিবির মাগন’ চাইতে বাড়ি বাড়ি আসত। তারা গ্রামের সম্পন্ন বাড়িতে যেত মূলত চালের জন্য। কেউ কেউ বাগানের সবজিও দিত। সেই মাগন দিয়ে বনবিবির কাছে করা মানত পূরণ করত। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি আছে বকখালি ও মৌসুনি দ্বীপে রয়েছে বনবিবির থান। এখনও বহু মানুষ ওই দুই থানে যান পুজো দিতে। যেখানে বনবিবিকে পুজো করা হয় সেই স্থানকে বলে বনবিবির থান।

তবে বনবিবির থান কোনও সুদৃশ্য মন্দির নয়। গ্রামের কোনও সাধারণ কুটির বা গাছতলা হল বনবিবির থান। বনবিবি হলেন সুন্দরবনের রক্ষয়িত্রী দেবী। তিনি সুন্দরবনের প্রকৃতি, গাছগাছালি, পশুপাখি ও মানুষ সবার রক্ষয়িত্রী। মানুষের বিশ্বাস, তিনি সুন্দরবনের মানুষকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেন। আর তাই সুন্দরবন অঞ্চলের মৌলি, বাওয়ালি, মৎসজীবী, কাঁকড়াশিকারী, ক্ষেতমজুর ইত্যাদি পেশার সমস্ত প্রান্তিক মানুষ বনবিবির মাহাত্ম্যের মহিমায় বিভোর হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯: সুন্দরবনের লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৯: মুহূর্তে ফ্লোরে খুশির বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন উৎপল দত্ত, কেন?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭১: ইংরেজের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাগী আসামী’

কে এই বনবিবি?
সুন্দরবনের মানুষের কাছে তিনি কবে থেকে ও কীভাবে দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেন? ‘বিবি’ শব্দের অর্থ হল বিলাসিনী। দেবীরূপী এই চরিত্রের মধ্যে এমন এক আধ্যাত্মিকতার বিলাস চিত্রিত হয়েছে যা হিন্দু ও মুসলিম সবার কাছে সমানভাবে আদরণীয় ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে সুন্দরবনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অস্পৃশ্য অবর্ণ হিন্দু জাতিগোষ্ঠী এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা যখন কোণঠাসা তখন এই দেবীর মাহাত্ম্যে আকৃষ্ট হয় অবর্ণ হিন্দু ও মুসলিম জাতিগোষ্ঠী। দেবীর সাম্যধর্ম তাঁকে সুন্দরবনের দরিদ্র ও প্রান্তিক হিন্দু ও মুসলিমদের কাছে মায়ের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। মায়ের কোনও জাত-ধর্ম হয় না। তাই জননীরূপে বনবিবি সুন্দরবনের আপামর অধিবাসীর কাছে আজও ধর্মসমন্বয়কারী। হয়তো এই কারণেই ১৯৪৬ সালে কুখ্যাত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কোনও প্রভাব পড়েনি সুন্দরবনবাসীদের মধ্যে।

বনবিবি মেলা।

পীরমাহাত্ম্যবিষয়ক পাঁচালি কাব্য “বনবিবি জহুরানামা” থেকে জানা যায় পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতকে মক্কায় ইব্রাহিম বা বেরাহিম নামে এক ফকির ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ফুলবিবি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই ফুলবিবির অনুমতি নিয়ে বেরাহিম দ্বিতীয় বিয়ে করেন গুলালবিবিকে। কিন্তু এই বিয়েতে গুলালবিবি একটি শর্ত দেয় যে যখন তিনি চাইবেন তখন তার একটি মনোবাসনা পূরণ করতে হবে। গুলালবিবি গর্ভবতী হলে ফুলবিবি শর্তানুযায়ী বেরাহিমকে বলেন যে গুলালবিবিকে সুন্দরবনে নির্বাসিত করতে হবে। নিরুপায় হয়ে বেরাহিম গর্ভবতী গুলালবিবিকে সুন্দরবনে নির্বাসিত করেন। সেখানে গুলালবিবি জমজ সন্তানের জন্ম দেন—এক মেয়ে ও এক ছেলে। এই মেয়েটি হল বনবিবি এবং তার ভাই হল শাহ জঙ্গলি।

জন্মের পর থেকেই বনবিবির মধ্যে এক ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায়। বনের সমস্ত পশুপাখি হয়ে ওঠে তার বাধ্য। ছোট্টো বনবিবিকে পরিচর্যা করতে থাকে হরিণরূপী স্বর্গের দাসীরা। সাত বছর পর বেরাহিম নিজের কৃতকর্মে অনুশোচনাগ্রস্ত হয়ে দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসেন। কিন্তু সুন্দরবনের বন্য প্রকৃতির সাথে বনবিবির এতটাই সখ্যতা গড়ে উঠেছিল যে তিনি ফিরে যেতে রাজি হলেন না। তাঁর সঙ্গে ভাই শাহ জঙ্গলিও থেকে গেলেন সুন্দরবনে। ওই সময় সুন্দরবনের পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন দক্ষিণ রায়। তিনি বাঘের রূপ ধারণ করতে পারেন।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭: গৃহিণী সারদার প্রথম দক্ষিণেশ্বর আগমন

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-২: ভারতের স্থাপত্যশৈলীতে ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দিরের অবদান অপরিসীম

বনবিবির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার খবর তাঁর কানে পৌঁছলে তিনি বন্ধু সনাতন রায়কে পাঠালেন বনবিবি সম্বন্ধে খোঁজখবর করতে। সনাতন ফিরে এসে দক্ষিণ রায়কে যা বললেন তাতে তিনি বিপদ আঁচ করলেন। ফলে সৈন্যসামন্ত নিয়ে বনবিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু পুরুষ হয়ে মহিলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রীতিবিরুদ্ধ। তাই তাঁর মা নারায়ণী দেবীকে বনবিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠালেন। যুদ্ধে নারায়ণী দেবী পরাস্ত হলেন এবং বনবিবির সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হলেন। সন্ধির শর্তানুযায়ী দক্ষিণ রায়ের সাম্রাজ্যের উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ বনবিবি নিজের দখলে রেখে দক্ষিণ দিকে অরণ্যসহ অর্ধাংশ দক্ষিণ রায়কে দান করেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই অন্য এক ঘটনায় ভেস্তে যায় ওই সন্ধি।

বরিজহাটি নামক এক জায়গায় ধোনাই ও মোনাই নামে দুই মৌলি ব্যবসায়ী ভাই ছিল। তারা নৌকো নিয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে মধু সংগ্রহে যেত। একবার তারা মধু সংগ্রহে যাওয়ার সময় তাদের ভাইপো দুখেকে সঙ্গে নিল। দুখের বাবা নেই। দুঃখিনী অন্ধ মায়ের একমাত্র বালক সন্তান দুখে। রওনা হওয়ার সময় দুখেকে তার মা বলে দিয়েছিল জঙ্গলে কোনও বিপদে পড়লে মা বনবিবিকে স্মরণ করতে। জঙ্গলে ঢুকে ধোনাই ও মোনাই সারাদিন অনেক খুঁজে একটুও মধু সংগ্রহ করতে পারল না। আসলে দক্ষিণ রায় সমস্ত মধু লুকিয়ে রেখেছিল। হতাশ ধোনাই ও মোনাই নৌকায় ফিরে যখন ঘুমিয়ে পড়ল তখন তাদের স্বপ্নে দক্ষিণ রায় দেখা দিয়ে জানাল যে যদি তাদের সঙ্গে থাকা দুখেকে তারা উৎসর্গ করে তবেই তারা মধু পাবে। ঘুম থেকে উঠে দু’ভাই স্থির করল তারা দুখেকে দক্ষিণ রায়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করবে। ফলে পরের কয়েকদিন জঙ্গলে গিয়ে তারা এত মধু সংগ্রহ করল যে নৌকো ভর্তি হয়ে গেল। তারপর প্রতিশ্রুতিমতো তারা দুখেকে জঙ্গলের মধ্যে পুকুর থেকে জল আনতে পাঠিয়ে নৌকো ছেড়ে দিল।

বাসন্তীর ছোটো মোল্লাখালিতে পথপাশে বনবিবির মন্দির।

দুখে ফিরে এসে দেখে তাকে জঙ্গলে ফেলে তার দুই কাকা চলে গিয়েছে। বালক দুখে ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করল। এই সময় সেখানে বাঘবেশে দক্ষিণ রায় এসে হাজির হল। তখন দুখের মনে পড়ল মায়ের কথা। সে নিবিষ্ট চিত্তে “মা আমাকে রক্ষা করো” বলে বনবিবিকে স্মরণ করতে লাগল। দুখের কাতর আহ্বানে অকুস্থলে বনবিবি ভাই শাহ জঙ্গলিকে নিয়ে হাজির হলেন। বালক দুখেকে কোলে তুলে নিয়ে বনবিবি শাহ জঙ্গলিকে আদেশ দিলেন জঙ্গল থেকে যেন দক্ষিণ রায়কে চিরতরে তাড়িয়ে দেয়। শাহ জঙ্গলির কাছে পরাস্ত হয়ে দক্ষিণ রায় বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করে এবং শর্ত মেনে জঙ্গলের এক কোণে বসবাস করে। আর ওদিকে বনবিবির আশীর্বাদে দুখের মায়ের অন্ধত্ব ঘুচে যায় এবং তারা প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়।

সুন্দরবনে বনবিবির এই আখ্যান নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা যাত্রাপালা, পালাগান, পাঁচালি, গীতিনাট্য ও নাট্যগীতি। গত দেড়শো বছর ধরে বনবিবির এইসব আখ্যান সুন্দরবনের লোকমুখে ঘুরছে। “বনবিবি জহুরানামা” ১৮৭৮ সালে প্রথম ছাপার আকারে লেখেন মুন্সি বয়নুদ্দিন। বনবিবির পুজোর কোনও নির্দিষ্ট সময় না থাকলেও মাঘ মাসের পয়লা তারিখে অনেক জায়গায় বনবিবির পুজো হয় এবং সেই উপলক্ষ্যে স্থানীয় মেলাও বসে। আবার পৌষ থেকে বৈশাখ মাস জঙ্গলে মধু সংগ্রহের সময় বলে ওই সময় বনবিবির পুজো বেশি সংখ্যায় হয়। হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এই পুজোয় অংশগ্রহণ করে। অনেকে বনবিবির কাছে মুরগি মানত করে। মনোবাসনা পূর্ণ হলে তারা মুরগি উৎসর্গ করে। সেই মুরগি জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই কারণে সুন্দরবনের জঙ্গলে অনেক জংলি মুরগি দেখা যায়।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৬: ঐতিহাসিক বিরল বিবাহ ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

কলকাতার পথ-হেঁশেল: যাদবপুর—যদুকুল ও চপস্টিকস

পাখি সব করে রব, পর্ব-২: দুর্লভ পরিযায়ী পাখি ল্যাপউইং

পুজোর প্রসাদ মূলত শিন্নি। কখনও কখনও খিচুড়ি প্রসাদ হয়। সঙ্গে বাতাসা, জিলিপি ইত্যাদিও কোথাও কোথাও দেওয়া হয়। পুজোয় কোনও মন্ত্র নেই। ব্রাহ্মণ ছাড়াই হয় পুজো। স্থানীয় মানুষই পুজোয় পৌরোহিত্য করেন। পুজোয় অবশ্যই বনবিবির পাঁচালি পাঠ করা হয়। পাঠ শুরু হয় ‘জয় মা বনবিবি’ ও ‘এলাহি ভরসা’ বলে। পুঁথি পাঠ শেষ হলেই পুজো শেষ হয়।

যেহেতু বনবিবি একজন ভক্তবৎসলা ও নম্রস্বভাবের দেবী তাই প্রতিমাশিল্পীর কল্পনায় তিনি হয়ে ওঠেন অতি সুন্দরী লাবণ্যময়ী এক নারীমূর্তি। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে তাঁর মাথায় থাকে মুকুট এবং তিনি নানা অলঙ্কারভূষিতা হন। পরণে থাকে শাড়ি। আবার মুসলমানপ্রধান অঞ্চলে তাঁর মাথায় থাকে টুপি, চুল হয় বিনুনি করা, মাথায় থাকে টিকলি, গলায় থাকে নানারকমের হার ও মালা। তাঁর পোশাক হয় ঘাগরা ও ওড়না, আর পায়ে থাকে জুতো-মোজা। তবে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব অঞ্চলেই তাঁর কোলে বা পাশে থাকে বালক দুখের প্রতিমূর্তি হিসেবে একটি শিশু।

বকখালিতে বনবিবির মন্দির এবং পার্শ্ববর্তী বটগাছে মনস্কামনা পূরণের জন্য বাঁধা সুতো।

বনবিবি সঙ্গেই পুজো পায় তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলি। পাশেই থাকে তাঁর মূর্তি। আর থাকে একদা দক্ষিণ রায়ের বন্ধু গাজি আউলিয়া এবং ব্যাঘ্ররূপী দক্ষিণ রায়ের মূর্তি। কোথাও কোথাও ধনাই-মনাইয়ের মূর্তিও থাকে। পুজোর উপচার হিসেবে সাধারণতঃ বনবিবিকে শাড়ি ও বাকিদের লুঙ্গি দেওয়া হয়। তবে কোথাও কোথাও ধুতিও দেওয়া হয়। ইদানিংকালে ধুতি পরিহিত গাজি আউলিয়ার মূর্তিও দেখা গিয়েছে। বকখালিতে অতি সাধারণ বনবিবির মন্দিরের পাশে বটগাছে ভক্তরা মনস্কামনা পূরণের জন্য সুফি দরগার অনুকরণে সুতো বেঁধে আসেন। তবে ইদানিংকালে বনবিবিকে অনেকেই ‘বনদেবী’ বলে অপব্যাখ্যা করছেন এবং সম্ভবত বনবিবিকে মুসলিম প্রভাব থেকে মুক্ত করে হিন্দু দেবী হিসেবে প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করছেন।

সম্ভবত চারশো-পাঁচশো বছর আগে থেকে বনবিবির আরাধনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলাম ধর্মের যখন প্রসার ঘটছিল তখন ইসলাম ধর্মের প্রচারিকা হিসেবে বনবিবির আবির্ভাব হয়। হিন্দু রাজা দক্ষিণ রায়ের সাথে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বিরোধ হয়। এই বিরোধিতার পরিসমাপ্তি হয় মধুর সন্ধির মধ্যে দিয়ে। আর এভাবেই বনবিবি হয়ে ওঠেন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে আরাধ্যা জননীস্বরূপ।—চলবে।

ছবি: লেখক
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content