শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল যেমন সারা পৃথিবীর কাছে সুন্দরবনের একটা ব্র্যান্ড, তেমনই হল সুন্দরবন অঞ্চলের সর্বশ্রেষ্ঠ মেলা সাগরমেলাও হল আর একটা ব্র্যান্ড। ভারত তো বটেই, পৃথিবীর বহু দেশের বহু মানুষের কৌতূহল ও গবেষণার বিষয় হল এই সাগরমেলা। সুন্দরবনের পশ্চিমতম প্রান্তে বর্তমান সাগরদ্বীপ হল সাগরমেলার কেন্দ্রস্থল। প্রত্যেক বছর মকর সংক্রান্তিতে সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা আসেন এই মেলা প্রাঙ্গনে। মকর সংক্রান্তির ভোরে সমুদ্রের জলে স্নান করলে সমস্ত পাপ বিসর্জিত হবে এবং পুণ্য অর্জন হবে এই প্রত্যাশায় লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে সাগরমেলায়। সাগরদ্বীপ এই সময় সর্বার্থেই হয়ে ওঠে এক মহামিলনক্ষেত্র।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে —“সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার।” কারণ সুপ্রাচীনকাল থেকে সাগরদ্বীপের দুর্গমতা। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, সাগরদ্বীপের বয়স প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর। অতীতে এখানে ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। বিভিন্ন সময়ে মৌর্য, কুষান, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজত্বের অংশ ছিল সাগরদ্বীপ। মোগল রাজত্বের সময় বারো ভুঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ও দুর্গ ছিল এই সাগরদ্বীপে। কিন্তু সাগরদ্বীপের বর্তমান জনপদ গড়ে উঠেছে বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এবং দস্যুহানায় সাগরদ্বীপের জনপদ যেমন বহুবার নিশ্চিহ্ন হয়েছে, তেমনই এই দ্বীপের ভৌগোলিক পরিবর্তনও হয়েছে। কিন্তু সেই পৌরাণিক যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাগরদ্বীপ বিশ্ববাসীর কাছে স্বমহিমায় বিরাজমান।
আর এর একমাত্র কারণ গঙ্গাসাগর মেলা। ৩৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে লেখা পদ্ম পুরাণ, বায়ু পুরাণ ও মৎস্য পুরাণ এবং ২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে লেখা রামায়ণ ও মহাভারত থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতকে লেখা মঙ্গলকাব্যসমূহে সাগরদ্বীপের উল্লেখ দেখা যায়। সাগরদ্বীপকে নিয়ে তাই রয়েছে অজস্র কাহিনি। তবে সাগরসঙ্গমে গঙ্গাসাগর মেলার উৎপত্তি খুঁজতে গেলে মুখ্য যে চারটি চরিত্র উঠে আসবে সেগুলি হল – মহর্ষি কপিল, সগর রাজা, ভগীরথ এবং দেবী গঙ্গা।

কর্দম মুনি ও দেবাহুতির পুত্র মহর্ষি কপিল জন্মগ্রহণ করেছিলেন কপিলাবস্তু নগরে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে, অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের আগে। এই নগরেই গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মহর্ষি কপিলের নামেই নগরের নামকরণ হয়েছিল। ভাগবত পুরাণমতে কর্দম মুনি ভগবান বিষ্ণুর তপস্যা করে তাঁকে সন্তুষ্ট করলে বিষ্ণুর বরে দেবাহুতির গর্ভে পরপর নয়টি কন্যাসন্তান এবং শেষে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে কপিল জন্মগ্রহণ করেন। কপিলের সমস্ত দিদিই ছিলেন বিদূষী ও বেদজ্ঞ। কালক্রমে কপিলও বেদজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ সৃষ্টি করে বরেণ্য হয়ে ওঠেন। পঁচিশটি তত্ত্ব বা সূত্র সমণ্বিত তাঁর এই দর্শন সাংখ্য দর্শন নামে পরিচিত। তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না, অর্থাৎ মহর্ষি কপিল ছিলেন নাস্তিক। যদিও তিনি বেদে বিশ্বাস করতেন বলে ভারতীয় দর্শনের আস্তিক্য শাখার ছয়টি দর্শনের মধ্যে সাংখ্য দর্শনকে অন্যতম হিসেবে ধরা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি দ্বৈতবাদী দর্শন। তাঁর মতে জড় জগত থেকে এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৬: ইতিহাসে চা

গঙ্গা নদীর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে রয়েছে আর এক পৌরাণিক কাহিনি। একবার শখ করে দেবর্ষি নারদ সঙ্গীত সাধনা শুরু করলে ‘গানের গুঁতোয়’ সমস্ত রাগ-রাগিনী ত্রাহি-ত্রাহি করতে করতে বিষ্ণুর কাছে ছুটে গেলেন। বিষ্ণু তাঁদের শিবের কাছে নিয়ে গিয়ে এই সমস্যা নিরসনের উপায় বার করতে অনুরোধ করলেন। তখন শিব শুরু করলেন সঙ্গীত সাধনা। তাঁর সুরমুর্চ্ছনায় চরাচর বিগলিত হল। আর বিষ্ণুর জোড়া-পা থেকে উৎপন্ন হল বিপুল জলধারা গঙ্গা। কিন্তু এই জলধারা তো স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে! বিপদ বুঝে ব্রহ্মা তাঁর কমন্ডলুর মধ্যে গঙ্গাকে ভরে রাখলেন।

রামায়ণের রামের পূর্বপুরুষ সূর্য বংশের রাজা সগর ঋষি ঔর্বের নির্দেশে শততম অশ্ববেধ যজ্ঞ করার পরিকল্পনা করলেন। যদি সফল হন তবে তিনি হবেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। সেই মতো রাজা সগরের ষাট হাজার পুত্র সুসজ্জিত ঘোড়া নিয়ে দেশ পরিক্রমায় বের হলেন। যে ঘোড়া আটকাবে তার সাথে হবে রাজার যুদ্ধ। প্রমাদ গুণলেন দেবরাজ ইন্দ্র, কারণ তিনিই তখন সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা হিসেবে মর্যাদাসম্পন্ন। তিনি চালাকি করে ঘোড়া চুরি করে লুকিয়ে রাখলেন পাতালে মহর্ষি কপিল মুনির আশ্রমে। পাতালে তখন মহর্ষি কপিল গভীর ধ্যানমগ্ন। সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে ঘোড়া খুঁজতে খুঁজতে পাতালে এসে কপিল মুনির আশ্রমে ঘোড়াটিকে দেখতে পেয়ে কপিল মুনিকে ঘোড়া চোর বলে সাব্যস্ত করলেন। চোর অপবাদসহ ধ্যানভঙ্গের অপরাধে কপিল মুনি তাঁর চোখ থেকে নির্গত রোষানলে সগর রাজার ষাট হাজার ছেলেকে ভস্ম করে দিলেন। সগর রাজার বংশধররা অনেক চেষ্টা করেও তাঁদের প্রাণ ফেরাতে পারলেন না। ফলে তাঁদের আত্মার মোক্ষলাভ হল না।
এ দিকে পুরুষহীন রাজা সগরের বংশের দুই রানির সমকামিতা থেকে জন্ম নেয় পঞ্চম বংশধর ভগীরথ। নারীর ‘ভগ’ অর্থাৎ যোনি থেকে জন্ম বলেই তাঁর নাম হয় ভগীরথ। ভগীরথ ছিলেন অস্থিহীন মানুষ। তাই তাঁর শরীর ছিল বাঁকা। একদিন তাঁকে দেখে অষ্টাবক্র মুনি ভাবলেন যে ভগীরথ তাঁকে ব্যঙ্গ করছে। ক্রুদ্ধ ও অভিশাপ দিতে উদ্যত মুনিকে ভগীরথ সব খুলে বলার পর মুনি সদয় হলেন এবং তাঁর বরে ভগীরথ তাঁর স্বাভাবিক চেহারা পেলেন। অষ্টাবক্র মুনি বললেন, যদি ভগীরথ ব্রহ্মার তপস্যা করে তাঁকে তুষ্ট করে তাঁর কমন্ডলু থেকে গঙ্গাকে বের করে কপিল মুনির আশ্রমে নিয়ে যেতে পারেন তবে গঙ্গার স্পর্শে তাঁর ষাট হাজার পূর্ব পুরুষের আত্মার মোক্ষলাভ সম্ভব।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

বরসে গা সাওন: স্মরণে উস্তাদ রাশিদ খান

ভগীরথ শুরু করলেন ব্রহ্মার তপস্যা। ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে গঙ্গাকে তাঁর কমন্ডলু থেকে মুক্ত করতে রাজি হলেন। কিন্তু ওই বিপুল জলরাশির ভার তো পৃথিবীর পক্ষে ধারণ করা সম্ভব নয়। তখন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন শিব। তিনি তাঁর জটার মধ্যে গঙ্গার বেশিরভাগ জলধারাকে ধারণ করলেন এবং তিনটি ধারায় গঙ্গাকে প্রবাহিত করলেন—স্বর্গে মন্দাকিনী, পাতালে ভোগবতী, আর মর্ত্যে অলকানন্দা। শাঁখ বাজাতে বাজাতে অলকানন্দাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন ভগীরথ। পথে জহ্নু মুনির আশ্রম ভাসিয়ে দেওয়ায় ক্রুদ্ধ মুনি গঙ্গাকে তাঁর পেটের মধ্যে শুষে নিলেন। বিপদে পড়লেন ভগীরথ। অনেক সাধ্যসাধনায় মুনিকে তুষ্ট করে শেষে গঙ্গাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করলেন। জহ্নু মুনি তাঁর জানু বা হাঁটু কেটে গঙ্গাকে মুক্ত করলেন। তাই গঙ্গার আর এক নাম হল জাহ্নবী।
কিন্তু ভগীরথ এ বার পথ হারালেন। তখন আবার বিষ্ণুর আরাধনা করতে শুরু করলেন। ভক্তের আহ্বানে বিষ্ণু হাজির হয়ে গঙ্গাকে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হতে বললেন— সাত্ত্বিক, তামসিক ও রাজসিক। রাজসিক ও তামসিক ধারা পদ্মা হয়ে প্রবাহিত হল পুবে, আর সাত্ত্বিক ধারাকে নিয়ে মকর সংক্রান্তির দিন ভগীরথ পৌঁছোলেন কপিল মুনির আশ্রমে। গঙ্গার স্পর্শে সগর রাজার ভস্মীভূত পুত্রদের আত্মার শাপমুক্তি ঘটল। তখন থেকে সগর রাজার নামে সমুদ্রের নাম হল সাগর, ভগীরথের নামে গঙ্গার ধারার নাম হল ভাগীরথী এবং নদী ও সাগরের মিলনস্থলে দ্বীপের নাম হল সাগরদ্বীপ। আর এই কাহিনি ফিরে ফিরে আসে প্রতিটি মকর সংক্রান্তির দিনে। লক্ষ লক্ষ মানুষ গঙ্গা ও সাগরের মিলনস্থলে স্নান করে পাপ বিসর্জন দিয়ে পুণ্য অর্জন করে। মানুষের বিশ্বাস,ওই দিন সাগরসঙ্গমে একবার স্নান করলে একশোটি অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য অর্জন করা যাবে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

সাগরদ্বীপে প্রথম মন্দিরের অস্তিত্বের কথা জানা যায় ৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে। মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন রানি সত্যভামা দেবী। সম্ভবত সেই মন্দিরের অবস্থান ছিল বর্তমান মন্দির থেকে ২ কিমি দক্ষিণে। তবে সেটিই প্রথম মন্দির কিনা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ষোড়শ শতকের প্রাচীন পুঁথি ‘তীর্থতত্ত্বপ্রদায়িনী’—তে কপিল মুনির মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে। উনিশ শতকের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা ‘হরকরা’-র ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৭ সংখ্যায় গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে একটি প্রবন্ধে লেখা হয়েছে— “এই স্থানে যে এক মন্দির আছে তাহা লোকের কাছে ১৪০০ বছর হইল গ্রথিত হইয়াছে। এই মন্দিরে কপিল মুনি নামে প্রসিদ্ধ দেবরূপ এক সিদ্ধপুরুষ প্রতিষ্ঠিত আছেন।” আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তাঁর ‘পূজাপার্বণ’ গ্রন্থে যুক্তিসহকারে লিখেছেন— “কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সূর্যবংশীয় রাজা বৃহদ্বল নিহত হয়েছিলেন। ভগীরথ তাঁর পূর্বপুরুষ। উভয়ের মধ্যে ৫২ পুরুষের ব্যবধান। ৫৩ পুরুষে ১৩০০ বছর। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৪৪১ অব্দে। অতএব ভগীরথ খ্রিস্টপূর্ব ২৭৪১ অব্দে ছিলেন। এই সময়ে কপিল মুনির আশ্রম ছিল।”
সাগরদ্বীপে বর্তমান কপিল মুনির মন্দিরটি ১৯৭৩ সালে অযোধ্যার হনুমানগড়ি মঠের মহন্ত সীতারাম দাসের বংশধররা তৈরি করেন। এটি সম্ভবত কপিল মুনির সপ্তম (মতান্তরে অষ্টম) মন্দির। কথিত আছে, মেদিনীপুরের রাজা যদুরাম সূর্যবংশীয় ভগীরথের বংশধর সীতারাম দাসকে কপিল মুনির মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব দেন। সেই পরম্পরা আজও চলে আসছে। যাইহোক, সমুদ্রের গ্রাসে বিলীন হয়ে গিয়েছে আগের ছ’টি (বা সাতটি) মন্দির। প্রতিবার মন্দির ধ্বংস হয়েছে আর তারপর পিছিয়ে এসে তৈরি করা হয়েছে নতুন মন্দির। ১৮৬৪ সালে উইলসন সাহেবের এক বিবরণী থেকে জানা যায় মন্দির চত্ত্বরে ছিল এক প্রকান্ড বটগাছ আর তার তলায় ছিল হনুমান ও শ্রীরামের মূর্তি। সেই মন্দির আর বটগাছ যে সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে তা বলা বাহুল্য।—চলবে।

ছবি: সংগৃহীত।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content