শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি সংগৃহীত।

নদীটির নাম বরাক। পাহাড়ের নাম বড়াইল। এই নদী আর পাহাড় ঘেরা উপত্যকাটি বরাক উপত্যকা। শিলচর শহর থেকে একটু এদিক-ওদিক ঘুরতে গেলেই সবুজ পাহাড়টি মাঝে মধ্যেই উঁকি দেয়। নদীও তার উপস্থিতি জানায়। বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে চা বাগান। তবে নদীর কথা বললে এও বলতে হয়, চিরি, জিরি কুশিয়ারা এবং আরও অনেক ছোট-বড় নদী রয়েছে এই উপত্যকায়।

বরাক নদীর প্রাচীন নাম বরবক্র ছিল বলে জানা যায়। বরাক উপত্যকার শোভাবর্ধনে যার ভূমিকা স্বীকার করতেই হয়। আছে ভুবন পাহাড়। কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলকান্দি এই তিন জেলা নিয়ে আমাদের এখনকার বরাক উপত্যকা। স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত ভারতে এ অঞ্চলকে ‘সুরমা উপত্যকা’ বলা হত। ১৮৭৪ সালে ইংরেজ আমলে শাসন কাজের সুবিধার্থে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও বেশ কিছু পার্বত্যকে অঞ্চল নিয়ে অসম প্রদেশ গঠন করা হয়।
রাজনৈতিক প্রয়োজনে বাংলার শ্রীহট্ট জেলাকে তৎকালীন অসমের প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আসলে ইংরেজ সরকারের মূল উদ্যেশ ছিল অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা। কিন্তু এ অঞ্চলের সঙ্গে বৃহত্তর অসমের সব বিষয়ে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান, এ অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং মূলত ভাষা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার থেকে আলাদা থাকায় বাংলা ভাষা প্রধান শ্রীহট্ট ও কাছাড়কে নিয়ে একটি পৃথক প্রশাসনিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। আর সেখানকার প্রধান নদীর নামে নাম রাখা হয় ‘সুরমা ভ্যালি ডিভিশন’।

কাছাড় জেলায় ছিল শিলচর ও হাইলাকান্দি মহকুমা। করিমগঞ্জ ছিল শ্রীহট্ট জেলায়। এখানে ইতিহাসের আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়, যার সঙ্গে বরাক উপত্যকার ভাগ্য জড়িয়ে গেল। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ সাধারণ মানুষ মেনে নিল না, ১৯১২ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেল। সেই সময় অসম পরিণত হল একটি গভর্নর শাসিত প্রদেশে। রাজনৈতিক সুবিধার্থে আবার সুরমা উপত্যকাকে তৎকালীন অসমের অন্তর্ভুক্ত করা হল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের হাত ধরে আবার তার ভৌগোলিক চেহারার পরিবর্তন আসে। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এই গোটা ভৌগোলিক অঞ্চলকে বলা হত কাছাড় জেলা।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৩: ইতিহাসের পাতায় লাচিত বরফুকোন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৮: সুন্দরবনের তিন গাজী—রক্তান গাজী, তাতাল গাজী ও শতর্ষা গাজী

১৯৮৩ সালে করিমগঞ্জ পৃথক জেলা হয়। ১৯৮৯ সালে হাইলকান্দি মহকুমাও পৃথক জেলা হয়ে যায়। এই সম্পূর্ণ অঞ্চলের প্রধান নদী বরাক বলে এই ভূখণ্ডকে বলা হয় বরাক উপত্যকা। তবে করিমগঞ্জ জেলা হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চল বরাক উপত্যকা হিসেবে বেশি পরিচিত হয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজসিংহাসনের চেহারা যেমন বদলেছে, তেমনিই এই অঞ্চল কখনও এদিকে, আবার কখনও ওদিকে গিয়েছে। দেশ ভাগের হাত ধরে আবার এই অঞ্চলের রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক চেহারার পরিবর্তন ঘটল। এই সব কিছুর পরও বরাক উপত্যকা কিন্তু তাঁর নিজস্বতা বজায় রেখেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে রয়েছে সংস্কৃতি ও ইতিহাস। রয়েছে উনিশের অমরগাথা।

কাছাড় জেলা কাছাড়ি রাজার অধীনে ছিল। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, ষোড়শ শতকের বেশকিছুটা সময় পর্যন্ত সমতল কাছাড় ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোচ সেনাপতি চিলারায়ের নেতৃত্বে ত্রিপুরার রাজা বিজয়মাণিক্যর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে রাজা বিজয়মাণিক্য নিহিত হন এবং বরাক ভূমিতে ত্রিপুরা রাজের রাজত্ব শেষ হয়। যুদ্ধ জিতে নতুন জয় করা অঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোচরা একদল সৈন্য নিযুক্ত করে। তাদের প্রধানকে দেওয়ান বলা হত।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪৩: এ রি পবন ঢুন্ডে কিসে তেরা মন…

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

চিলারায় তাঁর ছোটভাই কমলনারায়ণকে দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি হলেন কাছাড়ের প্রথম স্বাধীন রাজা। কাছাড়ের শেষ কোচ রাজা ভীমসিংহের একমাত্র সুন্দরী কন্যা কাঞ্চনীর সঙ্গে বিয়ে হয় উত্তর কাছাড়ের রাজা কীর্তিচন্দ্রের কনিষ্ঠপুত্র লক্ষ্মীচন্দ্রের সঙ্গে। সেই সূত্র ধরেই কাছাড়ি রাজত্বের বিস্তৃতি ঘটে। কাছাড়িরা আহোমদের অধীনে ছিলেন না। কাছাড়ে বসবাস করা বর্মণ জনজাতি অসমের জনজাতিসমূহের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য।

যখন চুকাফা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অধিকার করেন, তখন কাছাড়িদের রাজধানী ছিল ডিমাপুরে। ডিমাপুর আহোমরা অধিকার করে ফেলেন। তখন কাছাড়ি ডিমাসারা নিজেদের রাজধানী বর্তমান ডিমাহাসও-এর মাইবংয়ে স্থানান্তরিত করেন। উত্তর কাছাড়ের ডিমাসা কাছাড়ি রাজা তাম্রধ্বজ ১৭০৬ সালে আহোমদের রাজত্ব অস্বীকার করে বিদ্রোহ করেছিলেন। তৎকালীন আহোম রাজা রুদ্রসিংহ কাছাড়িদের রাজধানী মাইবং অধিকার করে নিয়েছিল। তখন রাজা তাম্রধ্বজ সমতল কাছাড়ের খাসপুরে এসে রাজধানী স্থাপন করেন। ধীরে ধীরে খাসপুর হয়ে ওঠে কাছাড়িদের মূল এলাকা।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৫: সে ব্যাটা চড়ছে তেরো সেমি, তো পড়ছে চোদ্দো কিমি, ভাঙবে ঠ্যাং কি?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

আগে খাসপুরের নাম ছিল ব্রহ্মপুর। কাছাড়িদের উপর সেই সময় থেকেই বাঙালিদের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। তাঁদের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাও বাঙালিই ছিলেন। কাছাড়ের শেষ রাজা গোবিন্দ চন্দ্রের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাই তাঁর মৃত্যুর পর ডিমসা কাছাড়ি রাজার রাজত্বের অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের ঘাঁটি স্থাথপন করে।

বর্তমান খাসপুরে এই ইতিহাসের ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। শহর শিলচর থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৩২ কলমিটার দূরে অবস্থিত এই খাসপুর রাজা রানিদের সেই অতীতের দিনগুলির গল্প বলে। সেই গল্প শোনাতে গেলে এখানে বলতেই হয়, ডিমাসাদের সঙ্গে জড়িত মহাভারতের গল্পটিও।

ছবি সংগৃহীত।

বর্মণরা নিজেদের মহাভারতের ভীমের বংশধর বলে মনে করেন, অন্যদিকে নিজেদের হিড়িম্বার বংশধর বলে মনে করেন ডিমাসা কাছাড়িরা। কাছাড়ের বর্মণরা আসলে উত্তর কাছাড় পর্বতের ডিমাসা কাছাড়িদেরই একটি ভাগ। মহাভারতের গল্প অনুসারে পাণ্ডবরা যদুগৃহ দহনের পর আত্মগোপনের সময় হিড়িম্ব নামক রাক্ষসকে হত্যা করেন। তার ছোট বোন হিড়িম্বাকে পাণ্ডুপুত্র ভীম বিয়ে করেন। তাদের ছেলে ঘটৎকোচ মহাভারতের যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

ডিমাসা, বাঙালি, মণিপুরি আরও অনেক ভাষা ও সংস্কৃতির লোকদেরকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে দেখা যায় এই বরাক পাড়ে। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বরাক উপত্যকা তার নিজস্বতা বহন করে রয়েছে। ঝি ঝি পোকার আলোয় একদিকে যেমন বরাকের চা বাগানগুলি ঝুমুরের তালে তাল দেয়, তেমনি শোনা যায় লোকোসংগীতও। আর এখানেই তো আমাদের ভারতের আসল রূপ ফুটে ওঠে। বরাক উপত্যকার ইতিহাসের আরও অনেক গল্প বাকি রয়ে গিয়েছে। পর্বরতী পর্বে সে সব গল্প হবে।—চলবে।
ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক।

Skip to content