রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

চায়ের ইতিকথা বলতে গেলে অনেক ছোট-বড় ঘটনা বলতে হয়। বহু মানুষের বহু বছরের আবেগ অনুভূতি জড়িয়ে রয়েছে এই চা শিল্পের সঙ্গে। অসমের অর্থনীতিতে চা ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হাজার মানুষের জীবিকা জড়িয়ে এই চা উদ্যোগকে কেন্দ্র করে। এখানে কমবেশি ৮৫০টি চা বাগান রয়েছে। এক সময় এই চা খাওয়ার অভ্যাস দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রায় ছিলই না। বরং চা-কে অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখে ছিল ভারতীয়রা।

শোনা যায়, উজান ব্রহ্মপুত্রে নাকি অনেক চা গাছ পাওয়া গিয়েছিল। রাজা পুরন্দর সিংহকে মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে রবার্ট ব্রুস এসেছিলেন। তখন ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে মণিরাম দেওয়ানের কাছ থেকে রবার্ট ব্রুস জানতে পারেন, স্থানীয় সিংফু আদিবাসীরা এক ধরনের গাছের পাতা থেকে বিশেষ ধরনের পানীয় তৈরি করে। ব্রবার্ট ব্রুস সেই সূত্র ধরে সদিয়া জেলায় চা গাচ আবিষ্কার করেন।

খুব অল্পদিনের মধ্যে ব্রবার্ট ব্রুসের মৃত্যু হওয়ায় অসমের চা উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হতে তিনি দেখে যেতে পারেননি। চায়ের প্রজাতি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করাও আর হয়ে ওঠেনি। পর্বরতীকালে তাঁর ভাই চার্লস ব্রুস কিছুটা চা গাছের পাতা এবং চা গাছের চারা কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে পাঠান পরীক্ষা করার জন্য। গবেষণার পর চায়ের চাষ শুরু হয়।
মণিরামবাবুকে নাজিরার চা উদ্যোগের দেওয়ান ঘোষিত করে ইংরেজরা। চা উৎপাদনে অসমের অধিবাসী হিসেবে প্রথমে এগিয়ে এলেন মণিরাম দেওয়ান। কিন্তু পর্বরতী সময়ে চা শ্রমিকদের উপর ইংরেজদের অত্যাচার এবং ভারত বিরোধী মনোভাবের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি দেওয়ান পদ ত্যাগ করে জোড়হাট জেলার সেংলাঙ এবং চিনামারাতে ১৮৪০ সালে নিজে দুটি চা উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে মণিরামের যাত্রাপথ খুব একটা সহজ ছিল না। ইংরেজরা তাঁকে নানা ভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করে। তিনিও ইংরেজদের কাছে মাথা নত করেননি। মণিরাম ভিতরে ভিতরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সৈন্য গড়ে নিচ্ছিলেন। তাঁর সিপাহীদেরকে অর্থনৈতিক সাহায্য করতে আহোম নেতা কন্দরপেশ্বর এগিয়ে এসেছিলেন। মণিরাম সারিং রাজা এবং জোড়হাট, শিবসাগরে অবস্থিত তাঁর বিশ্বাস যোগ্য কয়েকজন ব্যক্তিকে গোপন সাংকেতিক চিঠি পাঠান। যাতে ভারতীয় সৈনিকরা ইংরেজ শাসনের অধীনস্ত ছেড়ে দেশের হয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে। চিঠি পেয়ে কন্দরপেশ্বর খুব তাড়াতাড়ি প্রভাবশালী নেতাদের একত্রিত করে ফেলেছিলেন। কথা ছিল ২৯ আগস্ট, ১৮৫৭ সালে সিপাহীরা জোরহাটে আন্দোলন করে শিবসাগর ও ডিব্রুগড় অধিকার করে কন্দরপেশ্বরকে রাজা ঘোষণা করা হবে। কিন্তু ব্রিটিশরা কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে গ্রেফতার করে কলকাতার আলিপুর জেলে পাঠিয়ে দেয়।

এ দিকে কিছু দিনের মধ্যেই ইংরেজরা মণিরামকেও গ্রেফতার করে। শাস্তি হিসেবে ১৮৫৮ সালে তাঁর ফাঁসি হয়। মণিরাম দেওয়ানের ত্যাগের কথা অসম তথা গোটা দেশ কোনও দিন ভুলবে না। আসলে বিদ্রোহ ব্যাপারটা ঘটে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ইংরেজ সরকারের ভিতটাই তো ছিল স্বার্থপরতার উপর, অন্যায়ের উপর। সুতরাং সমগ্র যখন দেশে স্বাধীনতা সংগ্রমের আগুন জ্বলেছে তখন অসমের চা বাগানের শ্রমিকরাও নিজেদের সাধ্যমত তাতে যোগদান করেছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৭: চরগোলা এক্সোডাস

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩২: ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোয় গঙ্গাসাগর মেলা

চা উদ্যোগ শুরু করার সময় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিকদের প্রলোভন দেখিয়ে অসমে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল, “গাছ হিলায়ে গা তো পয়সা মিলে গা”। কিন্তু গাছের সঙ্গে যে কতটা অন্ধকার, অনিশ্চয়তা ছিল তা কেউ তাদের বলে দেয়নি। আর পয়সাই বা কত পেত! চরগোলা এক্সোডাস একটি বিরাট বড় আন্দোলন ছিল সেটা যেমন সত্যি, তেমনি ছোট-বড় অনেক বিদ্রোহ কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে ইন্ধন জুগিয়েছে। স্বদেশের জন্য হওয়া প্রত্যেকটি বিপ্লবই বৃহত্তর সংগ্রামের অংশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বরাকের বালাধন চা বাগানে নাগা সম্প্রদায়ের ইংরেজ বিরোধী ঘটনাটি।

খুব স্বম্ভবত সালটি ছিল ১৮৮০, বালাধন চা বাগানের তৎকালীন ম্যানেজারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল সেখানকার নাগা সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ম্যানেজারের বাংলোয় আক্রমণ করে, তাঁকে হত্যা করে। ম্যানেজারের স্ত্রীও গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এই ঘটনায় ১৭ জন শ্রমিকেরও মৃত্যু হয়। ঘটনাটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ইংরেজরা কিছুদের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে নাগাদের সেখান থেকে উৎঘাত করে দেয়। যদিও ইংরেজরা কোনও ভাবেই তাদের চরিত্র পরিবর্তন করেনি। সাধারণ ভারতবাসীকে শোষণ করা থেকে রত হয়নি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু

শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের উপর অত্যাচারও বন্ধ করেনি। শুধু যে শ্রমিকদের ওপর বাগান কর্তৃপক্ষ অত্যাচার করত তা নয়, স্থানীয় মানুষজনকেও তারা রেহাই দিত না। সেই সব ক্ষোভ থেকে ১৮৯৩ সালে বালাধন চা বাগানে আবার বিপ্লব ঘটে। স্থানীয় মণিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষ ম্যানেজারের বাংলোতে ডাকাতি করে তাঁকে হত্যা করে। এই ঘটনায় ম্যানেজারের স্ত্রীও গুরুতর আহত হন। এই ঘটনাটি ইংরেজ সরকারকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। *বিষয়টি পার্লামেন্টে পর্যন্ত উত্থাপিত হয়েছিল।* সিলেট হাই কোর্টে এই মামলা চলে। কিছুদিন পর কামিনীকুমার চন্দ আসামিদের হয়ে মামলা লড়েন। সেই মামলায় তিনি জয়ী হয়ে আসামিদের হাজত বাস থেকে মুক্ত করেন। কামিনীকুমারের প্রতি স্থানীয় মণিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষ কৃতজ্ঞ হয়ে প্রতি বছর তাঁর বাড়িতে ঢোল করতাল বাজিয়ে গান গেয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করত বলে শোনা যায়।

বরাক উপত্যকার চা বাগানের আরও একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হল, লক্ষ্মীপুর মহকুমার ‘বরাক টি কম্পেনি লিমিটেড’-এর দিলখোস চা বাগানে ১৯০১ সালে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন এসেছিলেন। লর্ড কার্জনের ভাতুষ্পুত্রী দিলখুস চা বাগানের ম্যানেজারের স্ত্রী ছিলেন। প্রথমে অসমের কাজিরাঙা, তেজপুর ও ডিব্রুগড় হয়ে তিনি আসেন দিলখোস বাগানে। ১৭ এবং ১৮ নভেম্বর তিনি এই বাগানে ছিলেন। বাগান কর্তিপক্ষ তথা শ্রমিকদের সঙ্গে একটি সভায় দেখাও করে শ্রমিকদের মজুরি ৬ আনা থেকে ৮ আনায় বৃদ্ধি করেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪৭: কাঁহি না জা আজ কাঁহি মত জা…

দাঁত তোলার পর আবার দাঁত সেট করছেন? সমস্যা ডেকে আনছেন না তো?

নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ধীরে ধীরে চা বাগানের শ্রমিকরাও সচেতন হয়। পারিশ্রমিক বাড়ানোর দাবি জানানোয়, বকুরা চওরা নামের এক শ্রমিককে শিবসাগর জেলার এক চা বাগানের ম্যানেজার ১৯৪৬ সালে ছুরিকাঘাত করে। এতে তাঁর মৃত্যু হয়। ম্যানেজারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এলাকায় চঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। সময়ের সঙ্গে এ সব ঘটনার কথা আমরা ভুলতে থাকি। আসলে যে কোনও পরিবর্তনের পিছনে অনেক ঘটনা কাজ করে। মূল স্রোতের সঙ্গে সেই সব ঘটনা মিশে গিয়ে ইতিহাসের পাতায় জমা হয়।

অসমের চা শ্রমিকরা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। কিন্তু সব ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়নি। তাই কিছু কিছু ঘটনা স্থানীয় মানুষদের স্মৃতিতেই রয়ে গিয়েছে। আর কিছু ঘটনা ইতিহাসের বইয়ে জায়গা করে নিতে পেরেছে।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক।

Skip to content