শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আমি এখন শতাব্দী এক্সপ্রেসে বসে আছি। এক কুড়ি-উনিশ মানে এটাই ট্রেনের নম্বর-১২০১৯ হাওড়া-রাঁচী শতাব্দী এক্সপ্রেস।

আগে রাঁচী বললে পাগলাগারদ মনে হতো। এখন মাহি বা মহেন্দ্র সিং ধোনির কথা মনে হয়। ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচিতে ধোনির জন্ম হয়েছিল। একটা মানুষের ব্যক্তিগত সাফল্য একটা গোটা এলাকার লেবেল বা তকমা বদলে দেয়? দেয় বৈকি। আমি যেখানে থাকি সেই বেহালা বললে আগে শহর কলকাতার কৌলিন্য পাওয়া যেত না। অথচ এখন বেহালা বললে লোকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা ভাবে।
সকাল ছ’টা পাঁচে ছেড়ে ঠিক পৌনে দু’ ঘণ্টায় ১৫৮ কিলোমিটার রাস্তা উজিয়ে ৭:৫০ নাগাদ দুর্গাপুরে পৌঁছব। ঘণ্টায় ৯০ থেকে ৯৫ কিলোমিটার গতিতে মাঝের ৪৪টা স্টেশন অগ্রাহ্য করে দুর্গাপুরে গিয়ে প্রথম থামবে এই ট্রেন। হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে যাওয়া মানুষের মতো চেনা পরিচিতদের ভিড় অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাবে নিজের নির্দিষ্ট গন্তব্যে। জানলার দু-ধার দিয়ে ছুটে যাবে মাঠ ঘাট খাল বিল বাড়িঘর লরি বাস মোটরগাড়িকে থমকে রাখা লেভেল ক্রসিং আর চেনাপরিচিত সেই স্টেশনগুলো। লিলুয়া বালি ডানকুনি বেগমপুর কামারকুন্ডু বেলমুড়ি গুড়াপ জৌগ্রাম খানা জংশন গলসি পানাগড়। দুর্গাপুর স্টেশন থেকে গাড়ি করে যাব ঝকঝকে পিয়ারলেস ইন হোটেলে। একেবারে সিটি সেন্টারের পাশে।

গাড়িতে মিনিট পনেরোর রাস্তা। দুপুরে নির্ভেজাল বিশ্রাম। সন্ধেবেলায় ওই হোটেলের ব্যাংকোয়েটে আমার অনুষ্ঠান। সেখানে নাকি প্রায় শ’দেড়েক লোক বসতে পারবে। এটা আমার প্রকাশকের একটা নতুন ধরনের চেষ্টা। কলকাতায় প্রাথমিকভাবে কয়েকটা এ ধরনের অনুষ্ঠানে সাড়া পাবার পর বাংলার জেলা শহরগুলোতে তারা এই ধরনের প্রোগ্রাম শুরু করেছেন। আমি আমার লেখা থেকে পড়ি। লোকেরা নাকি শুনতে খুব পছন্দ করছে। সেটা আমার লেখা না বলা, তা বুঝতে পারি না। আর বুঝে কাজও নেই। গল্প উপন্যাসের যখন বিক্রিবাটা নেই তখন এই ধরনের উদ্যোগ কিছু বইয়ের বিক্রি কিছু মানুষের সঙ্গে জানাশোনা নতুন জায়গায় নিখরচায় একটা বেরিয়ে আসার সুযোগ এসব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে এসব খুব চালু।

আমার প্রকাশকের ইচ্ছে অনুযায়ী ভারতের অন্যান্য রাজ্যে; যেখানে বাঙালিদের সংগঠন আছে, বাংলা গল্প উপন্যাস এখনও লোকে পড়ে, সেই সমস্ত পকেটে তিনি এই ধরনের অনুষ্ঠান করে ফেলেছেন এবং আরও করবেন। তিনি বিশ্বাস করেন যেকোনও প্রডাক্টের সঠিক মার্কেটিং হওয়াটা খুব জরুরি।
হোটেলে পৌঁছেই বেশ একটা উপাদেয় ব্রেকফাস্ট তৈরি ছিল। তার সদ্ব্যবহার করার পরেই একটু বিশ্রামের প্রয়োজন হল। ছটা পাঁচের ট্রেন ধরতে চারটের সময় ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে। বলা ভালো আমাকে গরম চা দিয়ে মা ডেকে তুলেছেন। কিন্তু এমন ভরপেট প্রাতরাশের পর মাথা কাজ করছে না।

ঘুম ভাঙলো টেলিফোনের শব্দে। আমার প্রকাশকের দুর্গাপুরের অঞ্চলের কাজকর্ম দেখে যে ছেলেটি সেই ফোন করছে। আমজাদ শেখ। ঝকঝকে সপ্রতিভ যুবক। সকালে দুর্গাপুর স্টেশন থেকে ওই আমাকে আনতে গিয়েছিল।

—স্যার পৌঁছে গিয়েছেন। এই হোটেলেই আছেন। আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন আপনি কি লাঞ্চ ঘরে করবেন? নাকি নিচের রেস্টুরেন্টে স্যারের সঙ্গে…

—না না আমজাম। আপনি দেবরাজবাবুকে বলুন আমি রেস্তোঁরাতেইএকসঙ্গে লাঞ্চ করব। জাস্ট আধঘণ্টা। আমি তৈরি হয়ে নিচে আসছি।

এই হোটেলের ঘরগুলো খুব সুন্দর। ওয়াশরুম ঝকঝকে। স্নানের জায়গাটা ধবধবে সাদা পলিথিনের পর্দা দিয়ে ঢাকা। ওয়াশবেসিনের দিকের মেঝেটা ভিজবে না। ছোট মাঝারি শিশিতে নানা রকমের শ্যাম্পু বডি ওয়াশ ক্রিম। সব বয়সের নারী যেমন পরিপাটি করে যে যার নিজের রুচি অনুযায়ী সাজতে জানে, ঠিক তেমনি আজকালকার হোটেলগুলো। আজকাল মোটামুটি ভদ্রস্থ সব হোটেলই প্রায় একই রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়। একই রকম ভাবে ঘর টয়লেট সাজানো। একেবারে কনকনে ঠান্ডা জলে চান করতে অস্বস্তি হয়।তাই জলটা অল্প গরম করে নেবার জন্যে গিজারের সুইচ টিপেছি।
আরও পড়ুন:

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৫: চেয়ারে বসতে গিয়ে নজর গেল বিছানায়, দেখি সেই পুতুলের সবুজ চোখ দুটো আমাকে দেখছে

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-১: কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়…

আমার সঙ্গে টুথব্রাশ টুথপেস্ট সবই আছে।কিন্তু হোটেলের দেওয়া জিনিসগুলোই খুলে ফেললাম। ব্রাশ টুথপেস্ট ব্যবহার করবার পর যাওয়ার দিনে ওয়েস্ট পেপার বক্সে ফেলে দেওয়াটা আমার অভ্যেস। যেমন সবকটা তোয়ালে ব্যবহারের পর টয়লেটের মেঝেতে ফেলে দিয়ে আসি। অন্য কাউকে দেবার আগে সেগুলো কাচতে দিতে বাধ্য হয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। শ্যাম্পু বডি ক্রিম বডি ওয়াশের ছোট ছোট শিশিগুলো আর চিরুনিটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসি।

সব সময় যে এই ধরনের ভালো হোটেলে এই জায়গা পাবো তার তো কোনও মানে নেই। আর এভাবেই যে পরস্মৈপদী খরচায় ঘোরাফেরা হবে তাও নয়। এই সঞ্চয় হল সেই আত্মনেপদী একাউন্টে পরিভ্রমণের বন্দোবস্ত। অন্য সবকিছু তো খরচা হয়ে যায়। চিরুনিটা জমে যায়। এই প্রায় একই ধরনের এটা নিয়ে ১৫ নম্বর চিরুনি। আজ হঠাৎ চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ানোর সময় মনে হল অসাবধানে মাথার চামড়ার খানিকটার নুনছাল উঠে গেল।

সস্তার চিরুনি। চিরুনির দাড়ার মুখগুলো যেন ভেটকি মাছের শিরদাঁড়ার শক্ত ধারালো কাটার মতো ফুটে যায়। খুব রাগ হলো। ফেলে দিলাম মাগনায় পাওয়া চিরুনি। অমন আমার অনেক আছে। হঠাৎ মনে হল আচ্ছা নুনছাল বলা হয় কেন। এমনিতে চামড়ার ওপর নুন পড়লে তো জ্বালা করে না। কিন্তু কোথাও চামড়াটা ছেঁচে গেলে বা ঘষটে একটু উঠে গেলেই সেখানে নুন দিলে জ্বালা করে। মানে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের থেকে যে চামড়া বা ছাল বাঁচায় সেটাই হল নুনছাল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৭: স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ‘সাগরিকা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৪: কিশোরের শুধু কণ্ঠই নয়, তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকেও গানের নেপথ্যে সুকৌশলে কাজে লাগাতেন পঞ্চম

নাকে একটা অদ্ভুত গন্ধ এল। জলে ভেজা কারো গা থেকে যেন মাইসোর স্যান্ডেল সাবানের গন্ধ পাচ্ছি। আমি সঙ্গে করে কোন সাবান আনিনি। হোটেলে দেওয়া সাবান বা বডি ওয়াশের গন্ধ এটা নয়। ঘরেও এই গন্ধটা পাইনি। হঠাৎ আয়নায় দেখলাম শাওয়ারের অংশে ঢাকা পর্দাটা একটু দুলে উঠল। ভিতরে কেউ সরে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমন। কেমন একটা হাতের ছায়া দেখলাম মনে হল। কারো ভিজে হাত। আরো স্পষ্ট করে বললে কোন নারীর ভিজে হাত। শুধু হাত নয়। গোটা শরীরটা। ভিজে প্লাস্টিক পর্দার ছুঁয়ে থাকা নাক-ঠোঁট দুহাতের আঙুলের ডগাগুলো। বাকি মুখ বা গোটা শরীরটা আবছায়া। আমি চমকে ফিরে তাকালাম। কেউ নেই তো। আমার মনের ভুল। আমি কি অলীক দৃশ্য দেখি। না কল্পনা করি। অনেক দিন আগে আমার এক পরিচিত ডাক্তার আমায় বলেছিলেন।

—একবার ভালো কোন সাইকোলজিস্ট এর কনসাল্টেশন নিয়ে নিন।

—আমাকে কি পাগল মনে হয়?

—আরে কি মুশকিল? চোখের সমস্যা হলে লোকে অপথ্যালমোলজিস্টের কাছে যায়- স্কিনের সমস্যা হলে ডার্মিটোলজিস্ট-এর কাছে যায়। কোন একটা সাইকোলজিকাল টার্বুলেন্স হচ্ছে। স্পেশালিস্ট ডাক্তারবাবু শুনবেন ডায়াগনসিস করবেন ওষুধ দেবেন ঠিক হয়ে যাবে।

আমি যাইনি। আসলে সব সময় মাথায় খুন, খুনের প্ল্যান, খুনি ধরার প্ল্যান, ভয় দেখানো ব্ল্যাকমেলিং এসব এসবের সঙ্গে যুক্ত চরিত্রেরা ঘুরতে থাকে। তাই আমি উদ্ভুতুড়ে স্বপ্ন দেখি নানান আগডুম বাগডুম চিন্তাও আসে। তাহলে মানসিক ডাক্তার দেখাবার কোন দরকার নেই।

মনের জোরে এনে এক হাতের টানে হুশ করে পর্দাটা খুলে ফেললাম। ভেতরে কেউ নেই। না থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার হোটেল রুমের ভেতরের টয়লেটে কোনও মহিলা স্নান করছিলেন? একদম আজগুবি। সমরেশ বসুর ছুটির ফাঁদে গল্পে হয়েছিল। সেটা একটা সার্কিট হাউস না গেস্ট হাউস কিছু ছিল। সেখানে হয়তো সম্ভব।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৩: বায়োপসি মানেই ক্যানসার

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

কিন্তু নাকে গন্ধটা আমি স্পষ্ট পেয়েছিলাম। ভেজা শরীরে থেকে সাবানের ঘ্রাণ। নিজস্ব নারীর শরীরের ঘ্রাণ কেমন হয় তা জানার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সেই কোন অতীতে আফিফার সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগেই সব শেষ। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘বৃষ্টিতে নিশিকান্ত’ বলে একটা গল্পে যেন পড়েছিলাম ঘামে ভেজা কিশোরীর শরীরে, কেমন একটা বুনোগন্ধ থাকে। সে গন্ধ কেমন তা জানিনা। তবে আজ আমার ভুল হয়নি।

রুমের টেলিফোনটা বাজছে। আমার সামনের বড় আয়নাটার পাশে দেওয়ালে লাগানো লাল টুকটুকে ছোট্ট ফোনটাও মৃদুস্বরে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। আমি জানি নিচের রেস্তোঁরা থেকে এখন আমজাদ ফোন করছে। দেবরাজবাবু বেশ খানিকক্ষণ এসে গেছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। এখন আর চান করে সময় নষ্ট করাটা শোভনীয় নয়। মাথা ঠান্ডা করে চানটা হয়তো করাও যেত না। ফোনটা কেটে যাবার আগেই চট করে ধরে ফেললাম।

—সরি সরি সরি। আসছি। জাস্ট পাঁচ মিনিট।

ওয়াশরুমের ফ্লোরে নজর গেল। সাদা ধবধবে মার্বেলের ওপর ভিজে পায়ের ছাপ। মেয়েলি ছোট ছোট পা যেমন হয়। ওয়াশরুম থেকে ঘরের দিকে গিয়েছে। এই ঘরটার ওয়াল টু ওয়াল টু কার্পেটে মোড়া।তাই সেখানে ভিজে পায়ের ছাপ নেই। —চলবে

হোটেলের পর্দাঘেরা স্নানের জায়গায় কে দাঁড়িয়ে?

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content