শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আজও খেতে বসে হাবিজাবি অনেককিছু ভাবছিলাম। ভাবছিলাম আমার কথা। মায়ের কথা। বাবার কথা। এই বাড়ির কথা। ছোটবেলার কথা। অনেকক্ষণ লক্ষ্য করে করে মা এবার ধমক দিলেন।

—আচ্ছা কী খাচ্ছিস, কেন খাচ্ছিস তোর কি কিছুই খেয়াল থাকে না। মানছি লেখালেখি করিস। মাথার মধ্যে নানান রকমের ভাবনা ঘোরে। এত বছর ধরে তোকে দেখছি। কিন্তু খাবার সময়টাতো মন দিয়ে খাবি। এই বয়সে যে তোর জন্য রান্না করেছি কোনটা কেমন হয়েছে তার কোন হুঁশই নেই খেতে হয় খাচ্ছিস চিবোতে হয় চিবোচ্ছিস।

—না, না। ভালো হয়েছে। নুন ঝাল তেল মশলা একদম পারফেক্ট। এদিকে কোনও সমস্যা নেই বলেই না এদিকে মন নেই! না হলে তো তোমাকে বলতুম এটা ভালো হয়নি ওটা ভালো হয়নি।

মা কথা বলার পর মনে পড়ল। গোটা সন্ধেবেলা সুইমিংপুল থেকে রাস্তা থেকে বাড়ি যা যা ঘটেছে সেগুলো তো খুব অস্বাভাবিক। কিন্তু সবই আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। আবার সেগুলো একটু একটু করে মাথার মধ্যে ফিরে আসছে। মায়ের কথার সূত্র ধরে ফিরে আসছে। এর কোনওটাই আমি ভুলিনি। আগের ভাবনাগুলো বিছানায় বেডকভারে চাপা দেওয়া বেডশিটের মতো সাময়িকভাবে মনের আড়ালে চলে গিয়েছিল। কী অসাধারণ সৃষ্টি ঈশ্বরের!
খাবার পরে এই যে কথাগুলো এখন আমি ভাবছি, সেটা কিন্তু ওই পুতুলটা হাতে নিয়ে। অথচ এতক্ষণ পুতুলটা আমার মাথার মধ্যে ছিল না। পুতুলটার দিকে তাকিয়ে আবার মনটা কি রকম অস্বস্তিতে ভরে গেল। চোখ দুটো কি অদ্ভুত রকমের সবুজ। দোকানে দেখা সাধারণ পুতুলের চোখের মতো রং করা নয়। একটু বেশি জ্বলজ্বলে। কোন কোন লোকের চোখের দিকে তাকালে কেমন একটা অন্যরকম লাগে। তার তাকানোর ভঙ্গি। তার স্থির চোখদুটো। মনে হয় ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। চোখের দিকে চোখ রেখে তাকানো যায় না।

এই পুতুলের চোখ দুটো ঠিক সেরকম। পুতুলের মুখটা বিছানার দিকে উল্টো করে রেখে দিলাম। পরিষ্কার বুঝতে পারছি যে ভুলবশত এটা আমার ঠিকানায় চলে এসেছে। ইচ্ছে করে ভুল হয়ত কেউ করেনি। অনলাইন ডেলিভারির সময় ভুল প্যাকেটে আমার ঠিকানাটা চিপকে দিয়েছে কেউ। আমার কাছে হয়তো অন্য একটা প্যাকেট আসার কথা ছিল, আমি কিছু অর্ডার করিনি। কিন্তু বন্ধুবান্ধব চেনা পরিচিত কেউ হয়তো কিছু অর্ডার করেছে আমার নামে। আমার ঠিকানায়। যার কাছে পুতুল যাবার কথা ছিল তার কাছে হয়তো সেটা গিয়ে পৌঁছেছে। নিশ্চয়ই ফেরত নিতে লোক আসবে।
আরও পড়ুন:

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৪: পুতুলের মাথায় কোঁচকানো সোনালি চুল, চোখ দুটো কেমন যেন অদ্ভুত, কিন্তু এটা আমায় কে পাঠালো?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৬: আবার নুনিয়া

এতক্ষণ বাদে বেশ একটু যুক্তিযুক্ত ভাবনা ভেবেছি বলে মনে হল। কিন্তু সন্ধে বেলায় সুইমিংপুলে যদি আমার এটা মনের ভুলও হয়। ভুল বলতে আমি কল্পনার কথা বলছি। এই কল্পনাটাই তো আমাকে দিয়ে লেখায়। যে লেখা থেকে আমার রোজগার। আমার আর মায়ের দু’ জনের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। সেই কল্পনা থেকেই রাস্তা ভুল করে অন্য রাস্তায় চলে যাওয়া। এইসব মেনে নিলেও আমার বাড়ির সামনে যে মহিলাকে আমি দেখলাম। সেটা এত বড় ভুল! মায়ের এতক্ষণে খাওয়া হয়ে গেছে। এই আমাদের মায়েরা কোনদিন একসঙ্গে খায় না। সাহেবরা যেমন গল্প করতে করতে নিজেরাই খাবার তুলে নিয়ে খায়। আমাদের তেমনটা নয়।

আমরা খাই কেউ আমাদের পাতে খাবার তুলে দেয়। কোন খাবার বেশি ভালো লাগলে বেশি বেশি খেয়ে ফেলে খাবারটা যে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে খেয়াল আমরা রাখি না। সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই আমাদের মায়েরা আমাদের সঙ্গে খান না। আমাদের খাওয়া হয়ে গেলে আমাদের তুলে দিয়ে থেকে যাওয়া আজকের খাবার। থেকে যাওয়া পুরনো খাবার মিলিয়ে মিশিয়ে নিজের খাবারটা শেষ করেন। সেই কোন ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। অবশ্য আমি তো বড় হইনি। সেই আমি সেই মা। এতগুলো বছর এভাবেই চলছে। মা আমাকে মাঝে বড় করার জন্য বিয়ে দিতে চেয়েছিল। বিয়ে হয়ে গেলে নাকি ছেলেপুলেরা বড় হয়। আমার বড় হওয়া হয়নি। কারণ কাকে বিয়ে করলে আমি ভালো থাকবো। আমার মা আমার পারিবারিক বন্ধন ভালো থাকবে। সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। আরও একটা ভয় ছিল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৩: ‘ওই দেখ, রাহুল দেব বর্মণের বাবা হেঁটে যাচ্ছেন’

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২২: সামাজিক প্রতিবন্ধকতার দ্বিচারিতা

আমার লেখালেখি থেকে রোজগারটা এমন সাংঘাতিক কিছু নয় যাতে আমি আমার একটা সংসার। স্ত্রী সন্তান-সন্ততি আরও নতুন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটিয়ে দেবো। আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকেই আর এগোনো হয়নি। সবসময় মনে হয়েছে এতগুলো নতুন সম্বন্ধ-সম্পর্ক সামলে চলাটা বোধহয় আমার দ্বারা হবে না। আমার মতো অনেক মানুষকে আমি চিনি জানি। তারা নতুন রাস্তায় হাঁটতে ভয় পায়। পুরোনো চেনারাস্তায় আটকে থাকতে ভালোবাসে। ওই যেমন আজ আমি সুইমিং পুল থেকে বাড়ি ফেরার চেনাপথ হারিয়ে ফেলে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তেমন একটা ভয় তাদের তাড়া করে ফেরে। তবে মাকে নিয়ে আমার দিব্যি কেটে যাবে এই আত্মবিশ্বাসটা ছিল।

মাথাগোঁজার ঠাঁই বাবা করে গিয়েছিলেন। এলাইসিতে চাকরি করতেন। হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেটা জীবনে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারবে না। নিজের চাকরি থেকে সংসার খরচ, বাড়ি কেনার ধারবাবদ মাসে মাসে কিস্তি শোধ করেও মায়ের নামে বেশকিছু নামি কোম্পানির শেয়ার কিনে রেখেছিলেন। সেকালের সে ‘কোম্পানির কাগজ’ থেকে এখনও বছরে বছরে মায়ের নামে মোটা টাকা আসে। অনেকে সেগুলো বেচে দেবার বুদ্ধি দিয়েছিলেন। আমি এসব বুঝি না তাই সে সবে কান দিইনি।

—বেশি রাত কোরোনা, সকালে উঠে লিখ।

—হ্যাঁ, তুমি শুয়ে পড়ো। আমি এ ঘরে আলো নিভিয়ে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে নিচ্ছি।

আলো নিভিয়ে দিতে জানলা দিয়ে আসা বাইরের আলোয় ঘরটা অন্যরকম লাগছিল। খোলা জানালা দিয়ে নিচে রাস্তাটা দেখতে গেলাম। নিশ্চুপ। নিঃসঙ্গ।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭: ঝুঁকি না নিলে জীবনে বড় কিছুই অর্জন করা যায় না

এলইডি আলোতে অন্যরকম লাগছে। আমার চেনার রাস্তাটা। হঠাৎ গেটের দিকে নজর গেল। রাস্তার পাশে মেনগেটটা খোলা। আমি বন্ধ করেই ঢুকেছিলাম স্পষ্ট মনে আছে। রাতে ফেরার কেউ বাকি ছিল? সে দেরিতে এসেছে। রাস্তার গেটটা খেয়াল না করে বন্ধ করেনি? হতে পারে। হয়তো খেয়াল করেনি। সিঁড়ির গেটটা যখন চাবি দিয়ে খুলেছে তখন বন্ধ তো নিশ্চয়ই করবে। জানলা থেকে ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম আজকে কি কিছু লিখব। এখনও সেরকম কোনও তাগিদ অনুভব করছি না। অচেনা একজন লেখক আমায় বলতেন, খিদে পাওয়া ঘুম পাওয়ার মতো লেখাও পায় মনের কথা লিখতে বাধ্য করে। যতক্ষণ না ভেতর থেকে এই চাপটা বাইরে আসতে চায় ততক্ষণ লেখা উচিত নয়। লেখাটা ভালো হয় না। আমি কি ছাইপাঁশ লিখি আমি নিজেই জানি না।

টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে টেবিলে রাখা বাক্সটার দিকে নজর গেল। আমার ঠিকানাটা স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আগে যেটা লক্ষ্য করিনি সেই অদ্ভুত জিনিসটা এবার নজরে এল। আমার ঠিকানা ছাপা কাগজটা বাক্সটার উপরে চিপকানো আছে। চিপকানো কাগজটার একটা কোণের বেশ খানিকটা উঠে আছে। সেখানে হাত দিয়ে অল্প টান দিতেই আমার ঠিকানা ছাপা কাগজটা আলতো ভাবে উঠে এলো। পেছনে ঠিক একই রকমের একটা কাগজ। তাতে ছাপানো ঠিকানাটা দেখে আমি চমকে উঠলাম। বারোর পাঁচ কে ডি সাহা রোড। এলাকার পিন কোড একই। কোনও নাম নেই, শুধু ঠিকানাটা। এটা কী করে সম্ভব? ওই আগুনে পোড়া বাড়িতে তো আজ বহু বহু বছর কেউ থাকেন না।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতে যাব বিছানায় নজর গেল। সেই পুতুলের সবুজ চোখটা আমাকে দেখছে। কিন্তু এটা অসম্ভব আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি পুতুলটাকে নিজে বিছানার দিকে উল্টো করে রেখেছিলাম।—চলবে

বারো/ডি, কে ডি সাহা রোডের পোড়াবাড়ি। ছবি: সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content