রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


আমার এক কাকা গ্রহতারকার চর্চা করতেন। লাল্টু কাকা বাবার খুড়তুতো ভাই। আলিপুরে দলিল রেজিস্ট্রেশন অফিসে চাকরি করতেন। ঘনঘন তারাপীঠ যেতেন। কপালে লালসিঁদুরের ফোঁটা লাগিয়ে অফিস যেতেন। হাতে নানান আংটি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কেউ বিশেষ ঘাঁটাত না। লাল্টুকাকা বলত মাঝেমাঝে কেতু নাকি এমন হয়রান করে। আমার গ্রহতারকার এখনকার অবস্থান আমি জানি না। আর লাল্টু কাকা আজ আর বেঁচে নেই তাই সে খোঁজখবর নেবারও আজ আর উপায় নেই। কিন্তু আমার বদ্ধমূল ধারণা আজ এই সব ঘটনা ঘটার কারণটা বোধ হয় আমি জানি। অথচ জেনে বুঝেও মনে আনতে চাইছি না। কিন্তু আমি চাই বা না চাই ঘটনাটা আমার মনের ভিতরে জায়গা করে নিয়েছে। আমার শরীর ঘামে ভিজে উঠছে। জোরে হাঁটছি বলে নাকি অন্যকিছু। রাস্তাটা আজ অস্বাভাবিকভাবে ফাঁকা।

কি অদ্ভুত, অন্যদিন রাস্তা ফাঁকা থাকলে মানুষ বা ট্রাফিকের চাপ কম থাকলে মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। আজ সেই আমি সেই রাস্তা কিন্তু পরিস্থিতি অন্য। আমার ফ্ল্যাট বাড়ির সেই চেনা বাইলেন আজ আলো-আঁধারিতে অন্যরকম লাগছে। কেমন যেন অচেনা গা-ছমছমে। বেহালার একটু ভিতরে আমাদের ফ্ল্যাট। একটু কমশহুরে। না গ্রাম বলছি না। পুকুর-মরাই-সব্জিবাগান কিছুই নেই। কিন্তু শহুরে ঠাট নেই। রাতে ট্যাক্সি ঢুকতে চায় না। এঁকেবেঁকে আমাদের পাড়ার গলি কোথাও পৌঁছয় না।

একটা সময় নিজেই খেই হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমাদের সাবেকি পাড়া আমাদের গলি, আমরা একে কানাগলি বলি না। একটু দূর থেকে ঠিক আমাদের চারতলা ফ্ল্যাটের গেটের সামনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। না, চেনা চেহারা নয়- অচেনা। দেখে মহিলা বলে মনে হয়। হয়তো আমাদের প্রতিবেশী কারও বাড়ির আত্মীয় বা বন্ধু কোনও পরিবার। সঙ্গের মানুষটি হয়ত গাড়ি পার্ক করতে গিয়েছেন। তাই অপেক্ষা করছেন। সরু গলি। আমাদের ফ্ল্যাটের নিচে গাড়ি রাখা যায় না।
নর্দমার লাইন অফ কন্ট্রোল ঘেঁষে বুক বরাবর ইঁটের সরু পাঁচিল। বহুদিন আগে এই ফ্ল্যাট বাড়ি যখন তৈরি হয়েছিল তখন এফএসআই বা ফ্লোর স্পেস ইনডেক্স নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। কত জমিতে কতটা খালি রাখতে হবে আর কতটা ইটের গাঁথনি এসব নিয়মকানুন না থাকার পুরোপুরি সুবিধা নিয়ে ছিল আমাদের বিল্ডার। ফলে রাস্তার ধারে ড্রেন থেকে আমাদের বাড়ির ভিতরের গেট ওই একটা ফালি চিলতে, সেইটুকুই যা ওপেন স্পেস। সেখানেই ঠাসাঠাসি করে রাতে কয়েকটা স্কুটার, বাইক রাখা থাকে ব্যাস।

আমাদের ফ্ল্যাটের দুটো প্লট পরেই সেনবাবুদের পুরোনো বাড়ি ছিল। রাস্তা থেকে একটু ভিতরে সরে ওখানে রাতবিরেতে কেউ এসে গেলে গাড়ি রাখে। ওঁরা আপত্তি করেন না। আর একটু এগিয়ে গেলে বারোর পাঁচ। কেউ থাকে না। পোড়োবাড়ি। অনেকদিন আগে মাঝরাতে আগুন লেগে গোটা বাড়িটা আগুনে পুড়ে যায়। বাড়ির বাসিন্দারা নাকি আশ্চর্য ভাবে প্রাণে বেঁচে যান। তারা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। বহুবছরের চেষ্টাতেও বাড়ি বিক্রি করা যায়নি। অগ্রিম নিয়েও শেষ মূহূর্তে মালিকানা বদলে বাধা এসেছে। এই প্রোমোটারি যুগেও জমি-বাড়ি কোন অলীক কারণে একইভাবে জনমানসহীনভাবে থেকে গিয়েছে। কে মালিক? কারা থাকতেন? সেসব ইতিহাস বিস্মৃতিতে তলিয়ে গিয়েছে। শুধু রয়ে গিয়েছে, বাড়ির নম্বর বারোর পাঁচ।

কী আশ্চর্য…! কেউ তো গেটে দাঁড়িয়ে নেই! কিন্তু আমি যে স্পষ্ট দেখেছি। বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাতে এখন নিয়ন ল্যাম্পের বদলে কম পাওয়ারের এলিডি আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। তাতে কিন্তু আলোর বিস্তার এক থাকলেও তীব্রতা কম। তবে কি আলোছায়ায় চোখের ভ্রম! কিন্তু যেখানটায় আমি দেখলাম সেখানে আলোছায়ার কোনও ইলিউশন নেই। এতক্ষণের স্বাভাবিক হয়ে আসা মানসিক অস্বস্তিটা আবার যেন বেড়ে গেল। আমাদের চারতলা ফ্ল্যাটের জন্যে বিল্ডার লিফট বসানোর বদান্যতা দেখাননি। আমরা থার্ড ফ্লোরে থাকি। এখন নির্জন গেট দিয়ে ঢুকতে অদ্ভুত ভয় লাগছে।

—এটা কি বারোর পাঁচ কে ডি সাহা রোড?

মহিলা কণ্ঠস্বর। চমকে পিছনে ঘুরলাম। একটু দূরে ঘোমটা দেওয়া এক মহিলা। মুখ দেখা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন:

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৩: এরকম ভুল হল কী করে? তবে কি আমাকে কিছুতে বশ করেছে?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৫: আর্য কোথায়?

আজ পর্যন্ত কেউ কখনও আমায় এই প্রশ্ন করেনি। ছোট থেকে বড় হয়েছি আজ পর্যন্ত কেউ বারোর পাঁচের কথা জানতে চাইনি। সন্ধে থেকে একটার পর একটা ঘটনা আমাকে ভেতরে ভেতরে দুর্বল করে দিচ্ছিল। জানতে চাইলাম।

—আপনি কোথা থেকে আসছেন? বারোর পাঁচে তো কেউ থাকেন না। বহুবছর।

—ও তাহলে বোধহয় আমি ঠিকানাটা ভুল শুনেছি। বা হয়তো রাস্তার নামটা অন্য।

কিছু বলার আগেই ফোনটা বেজে উঠলো। আমি জানি কে ফোন করছে? ওপরে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের বারান্দার আলোটা জ্বলল কানে ফোন নিয়ে মা কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এসেছে। মা একটু রেগেই বললো—

—কী হল কোথায় তুই এত রাত্তির হয়ে গেল ফেরার নাম নেই?

—আরে বাবা চটে যাচ্ছ কেন মা? নিচে দেখো নিচে। এই যে! এসে গেছি। এক্ষুনি আসচি।

ফোনটা কেটে ফিরে তাকাতেই অদ্ভুত ব্যাপার। মহিলা একেবারে উবে গেছেন। মুহূর্তের মধ্যে পুরোনো অস্বস্তিটা আবার ফিরে এলো। আমাদের বাড়ির গেটটা ভেজিয়ে সিঁড়ির দরজাটার কাছে পৌঁছতেই ঘোষবাবুর সঙ্গে দেখা। বনমালী ঘোষ। চারতলায় থাকেন। আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ীটার চারতলায় আটঘর। ঘোষবাবু এলাইসিতে চাকরি করতেন। স্বামী-স্ত্রী। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের পোর্শান্টার ঠিক ওপরে থাকেন।

—সাঁতার থেকে ।

—আপনি কোথাও যাচ্ছেন?

—নানা। এ হপ্তাটা গেটে তালা দেওয়ার ডিউটি আমার।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১২: হঠাৎ স্নানঘর থেকে পঞ্চমের চিৎকার ‘মিল গয়া মিল গয়া’, সৃষ্টি হল সেই জনপ্রিয় গান ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

আমাদের আট শরিকের ছোট আবাসিক। নিচে গ্রিলের দরজা দেওয়া গেট। ভিতরে চারজোড়া লেটার বক্স। আর জালবন্দি চারজোড়া মেনসুইচ আর মিটার বক্স। সরস্বতী পুজো হয়। গেটে দারোয়ান বা পাম্প অন/অফ করার আলাদা লোক নেই। পালা করে আবাসিকদের গেট খোলা বন্ধ করতে হয়। পাম্প চালু বন্ধ করতে হয়। মাসে চার সপ্তাহে চারবার, এখন যেমন চারতলার ঘোষবাবুর গেট খোলা বন্ধ আর উল্টো মুখে চার তলারই নবীন মুখার্জির ডিউটি চলছে পাম্প চালু বন্ধ। অবশ্য নবীন মুখার্জীর বাড়িতে তার ছোটশালা সুমন্ত থাকে। সেই মুখার্জিবাবুর প্রক্সি দেয়। মিথ্যে বলবো না আমাকে কখনোই গেট খোলা-বন্ধ বা পাম্প চালাতে হয়নি। আমার ডিউটিটাও সুমন্ত প্রক্সি দিয়ে দেয়। নবীন মুখার্জির শ্বশুর মশাইয়ের পাবলিকেশনের ব্যবসা ছিল। তাই আমি লেখালেখি করি বলে বাড়ির সকলের সঙ্গে নবীনবাবুরাও আমাকে বিশেষ সম্মান করেন। আমি যে একজন পরিচিত লেখক হয়েও এখনও এই আবাসন ছেড়ে যাইনি। এটাই নাকি তাঁদের সকলের কাছে একটা পরমপ্রাপ্তি। কিছু কিছু ভুল ধারণা ভাঙতে নেই। সেই অর্থে লেখালেখি করে সেরকম বিপুল একটা অর্থ উপার্জন হয় না যাতে কলকাতা শহরে আবার একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় খুঁজে নেওয়া যায়। কিন্তু এই উচ্চ ধারণার উপরি পাওনাটা ছাড়ে কে?

নবীনবাবুই এখন আমাদের আবাসিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। এই প্রতিতলার বাসিন্দাদের পাম্প চালু বন্ধ বা গেট খোলা বন্ধের নিয়ম কানুন নবীনবাবুরই তৈরি করা। যাতে কোনও একটি ফ্লোরের বাসিন্দারা না থাকলে তাদের ফ্লোরেরই অন্য বাসিন্দা তাদের কাজটুকু সেরে দিতে পারেন। প্রত্যেক ফ্ল্যাটেই সিঁড়ির সামনের এই গেটের তালার চাবি রয়েছে। কেউ বেশি রাতে ফিরলে বা বেশি ভোরে বের হতে হলে নিজস্ব চাবি দিয়ে সিঁড়ির সামনের এই গ্রিলগেটের তালা খুলতে পারেন। মেনগেটে কোন চাবি দেওয়া হয় না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই ঘোষবাবু তালা বন্ধ করে দু’ বার হাত দিয়ে টেনে দেখে নিলেন।

—যাক। একটা দিন ভালোয়-মন্দোয় কেটে গেল। কাল একটা নতুন দিন । নতুন সম্ভাবনা। নতুন দুশ্চিন্তাও বটে।

—তা যা বলেছেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২১: ক্যানসার মানেই মৃত্যু?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২১: ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট ও সমৃদ্ধি কামনা

ঘোষবাবুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই মনের অস্বস্তিটা যেন এক্সট্রা পাওয়ার ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। মনটা এখন অনেক ফুরফুরে ঝরঝরে ভাতের মতো সাদা ধবধবে। দুশ্চিন্তার দাগটুকুও নেই।

আলু পটল আর পাতলা মাছের ঝোল এর সঙ্গে গরম ভাত খাওয়ার মধ্যে একটা ফুরফুরে ঝরঝরে অনুভূতি আছে। একটা পরম শান্তি আছে। হ্যাঁ, মানছি ডায়াবেটিস আছে। আলু ভাত দুটোই মানা। ডাক্তার ‘না না’ বলবে, তবু মন মানে না। সেরকম গোঁড়া রাবীন্দ্রিকরা আমাকে হাতের সামনে পেলে মারধর করবেন। তবু বলব গুরুদেবের এই গানটার সঙ্গে ডায়াবেটিক রোগীর মিষ্টি আলু চিনি ভাত খাওয়ার গভীর ইচ্ছে আর ডাক্তারবাবুর মানার বোধহয় একটা কাকতালীয় সম্পর্ক আছে।

“ও যে মানে না মানা / আঁখি ফিরাইলে বলে, ‘না, না, না।’

জোয়ান মুখে দিয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে লেখার টেবিলে বসতে যাব। হাতে একটা লম্বাটে বাক্স নিয়ে মা এসে বলল—

—দ্যাখ তো, কি একটা বাক্স এসেছে।

—কখন? নাঃ! আমি তো অনলাইনে কিছু আনতে দিইনি।

—তোর নাম নেই দেখে আমি না বলেছিলুম। পোস্ট পিওন বলল আমাদের ঠিকানাই লেখা আছে।

—আমি তো বিকেলবেলায় সাঁতারে গেলাম। তখনও তো আসেনি ।

—এইতো একটু আগে সন্ধ্যেরাতে এলো। বেল শুনে ভাবলাম তুই ফিরে এলি। খুলে দেখি পোস্ট পিয়ন। চেনা লোক বলেই দরজা খুলে নিলুম। চিঠিচাপাটি হলে তো নিচে লেটার বক্সেই ফেলে যায়। বাক্স বলেই…

আমি ততক্ষণে মায়ের বর্ণিত সেই বাক্সটা কাঁচি দিয়ে খুলে ফেলেছি। ভেতরে জিনিসটা দেখে চমকে উঠলাম। ফ্রক পরা একটা মোটাসোটা ডল। মাথায় কোঁচকান সোনালি চুল। চোখ দুটো কেমন যেন অদ্ভুত। এটা আমায় কে পাঠালো? কেনই বা পাঠালো? —চলবে

এই সাধারণ পুতুলটার চোখদুটো এমন কেন? ছবি: সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content