ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিস মোহিনীর মায়া
অন্তিম পর্ব
কথাটা বলার পরই যেন একটা অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতায় ভরে গেল ঘরটা। কোথাও আর বাবার অস্তিত্ব নেই। না শোবার খাটের পাশের চেয়ারে। না দূরের লেখার টেবিলের কাছে। আমার মাথার পেছনের খোলা জানলার পর্দাটা হাওয়ায় উড়ছে। ওদিকে বারান্দার দিকের দরজাটা বন্ধ কিন্তু পাশের জানলাটা খোলা সেখানে কোনও পর্দা নেই। একটানা মিনমিনে ঝিঁঝিঁর ডাক জানান দিচ্ছে রাত শেষ হয়ে এলেও আলো ফুটতে এখনও বাকি আছে।
বড়রাস্তার ধারে বাড়ি হলে ভোররাত থেকে গাড়ি চলাচলের শব্দ পাওয়া যায়। আমাদের এই জায়গাটা তেমন নয়। কাগজওয়ালা এসেই বোধহয় সকলের সকালের ঘুম ভাঙ্গায়। কিন্তু আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ভাবছি বাবা কথাটা কি বলে গেলেন। বিছানায় উঠে বসলাম। বুক-ভারি-করা একরাশ ভয়ে আর আশঙ্কা নিয়ে পাশের ঘরে গেলাম মাকে দেখতে। মা বিছানায় নেই। আমি নিশ্চিন্ত। ছোটবেলা থেকে মায়ের কাকভোরে কলঘরে যাওয়ার অভ্যেস।
আমাদের পুরনো ফ্ল্যাট বাড়ি। ছোট দু কামরা রান্নাঘরের ফ্ল্যাট হলেও কলঘর দুটো। মায়ের ঘরের সঙ্গে লাগোয়া কলঘর। আমার শোবার ঘরের বাইরে একদিকে রান্নাঘর অন্যদিকে বাইরের কলঘরটা মাঝে একটা চিলতে জায়গা ওটাই আমাদের ডাইনিং স্পেস।
মুখ হাত ধুয়ে ভেবেছিলাম লিখতে বসবো। ভাবনা বদলে মনে হল আজ চা করে মাকে একটু চমকে দিই। বাড়িতে মাঝে মধ্যে চা বা কফিটাই করি। তাই চা পাতা কফির কৌটো চিনি গুঁড়ো দুধ সসপ্যান এসব আমার নখদর্পণে।
পাতা চা ফুটিয়ে তোলা ঘন লিকারে গুঁড়ো দুধ চিনি গুনে বেশ জমিয়ে চাটা বানালাম। গলির মোড়ে হারুদার চায়ের দোকান। হারুদার রেসিপি মেনে চায়ের ওপরে অল্প করে ছড়িয়ে দিলাম কফির ছিটে । হারুদার দোকানে এই চাফি বেশ জনপ্রিয়। ট্রে-তে কাপ-ডিশ সাজিয়ে টোস্ট বিস্কুটের কৌটো বসিয়ে – মায়ের ঘরে গেলাম। কলঘর ছেড়ে এসে কি মা আবার শুলো?
অবাক কাণ্ড। বিছানা খালি। তার মানে মা এখনও কলঘরে? কী করছে?
দরজা ভাঙতে হয়েছিল। তেমন শক্তপোক্ত কিছু নয়। লাগোয়া ছোট্ট বাথরুম। মাঝে ভাঁজ করা দরজা ভিতরে খোলে। মাঝে একটা ছিটকিনির ভরসায় দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ কয়েকবার দরজা ধাক্কাধাক্কি করে মাকে ডাকার পরও যখন দরজা খুলল না তখন আমি দরজা ভেঙে ঢুকলাম। কাউকে ডাকাডাকি করতে হয়নি। বাবা যখন অসুস্থ হয়েছিলেন তখন এই কলঘরে কমোড বসানো হয়েছিল। মাসি সেই কমোডের ওপরে বসে ছিলেন। মাথাটা পিছনের দেওয়ালে হেলানো।
বড়রাস্তার ধারে বাড়ি হলে ভোররাত থেকে গাড়ি চলাচলের শব্দ পাওয়া যায়। আমাদের এই জায়গাটা তেমন নয়। কাগজওয়ালা এসেই বোধহয় সকলের সকালের ঘুম ভাঙ্গায়। কিন্তু আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ভাবছি বাবা কথাটা কি বলে গেলেন। বিছানায় উঠে বসলাম। বুক-ভারি-করা একরাশ ভয়ে আর আশঙ্কা নিয়ে পাশের ঘরে গেলাম মাকে দেখতে। মা বিছানায় নেই। আমি নিশ্চিন্ত। ছোটবেলা থেকে মায়ের কাকভোরে কলঘরে যাওয়ার অভ্যেস।
আমাদের পুরনো ফ্ল্যাট বাড়ি। ছোট দু কামরা রান্নাঘরের ফ্ল্যাট হলেও কলঘর দুটো। মায়ের ঘরের সঙ্গে লাগোয়া কলঘর। আমার শোবার ঘরের বাইরে একদিকে রান্নাঘর অন্যদিকে বাইরের কলঘরটা মাঝে একটা চিলতে জায়গা ওটাই আমাদের ডাইনিং স্পেস।
মুখ হাত ধুয়ে ভেবেছিলাম লিখতে বসবো। ভাবনা বদলে মনে হল আজ চা করে মাকে একটু চমকে দিই। বাড়িতে মাঝে মধ্যে চা বা কফিটাই করি। তাই চা পাতা কফির কৌটো চিনি গুঁড়ো দুধ সসপ্যান এসব আমার নখদর্পণে।
পাতা চা ফুটিয়ে তোলা ঘন লিকারে গুঁড়ো দুধ চিনি গুনে বেশ জমিয়ে চাটা বানালাম। গলির মোড়ে হারুদার চায়ের দোকান। হারুদার রেসিপি মেনে চায়ের ওপরে অল্প করে ছড়িয়ে দিলাম কফির ছিটে । হারুদার দোকানে এই চাফি বেশ জনপ্রিয়। ট্রে-তে কাপ-ডিশ সাজিয়ে টোস্ট বিস্কুটের কৌটো বসিয়ে – মায়ের ঘরে গেলাম। কলঘর ছেড়ে এসে কি মা আবার শুলো?
অবাক কাণ্ড। বিছানা খালি। তার মানে মা এখনও কলঘরে? কী করছে?
দরজা ভাঙতে হয়েছিল। তেমন শক্তপোক্ত কিছু নয়। লাগোয়া ছোট্ট বাথরুম। মাঝে ভাঁজ করা দরজা ভিতরে খোলে। মাঝে একটা ছিটকিনির ভরসায় দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ কয়েকবার দরজা ধাক্কাধাক্কি করে মাকে ডাকার পরও যখন দরজা খুলল না তখন আমি দরজা ভেঙে ঢুকলাম। কাউকে ডাকাডাকি করতে হয়নি। বাবা যখন অসুস্থ হয়েছিলেন তখন এই কলঘরে কমোড বসানো হয়েছিল। মাসি সেই কমোডের ওপরে বসে ছিলেন। মাথাটা পিছনের দেওয়ালে হেলানো।
বাবা এসে হয়তো আমাকে মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুত করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই ওই অবস্থায় হতবুদ্ধি না হয়ে মাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে দিয়েছিলাম।কী হতে যাচ্ছে আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমার চিকিৎসা যিনি করেন সেই ডাক্তারবাবু একটু দূরে থাকেন। আমাদের গলির মোড়ে এক ডাক্তারবাবু থাকেন যিনি বাবাকে মাঝেমধ্যে এসে দেখে যেতেন। মায়ের টুকটাক শরীর খারাপ হলে তাঁকেই ডাকতাম। আজ তাঁকেই ফোন করলাম। তিনি এসে জানালেন মা, খানিক আগেই চলে গিয়েছেন। তবে বহুদিনের পরিচিত ডাক্তার বাবু তাই ডেথ সার্টিফিকেট বলবার আগেই লিখে দিলেন। সুমন্তকে খবর দিতে হয়নি। নিজেই এসেছিল। খবর পেয়ে দেবরাজবাবু নিজে ছুটে এসেছিলেন। আমাকে বিশেষ কিছু করতে হয়নি।
মুখার্জিবাবুকে যেখানে নিয়ে গিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই সিরিটির শ্মশানঘাটেই গিয়েছিলাম আমরা। শুধু ইলেকট্রিক চুল্লিতে দাহকার্যের আগে করনীয় কাজ করতে বড্ড একা লাগছিল। গনগনে লাল আগুনের গহবরে মা যখন অদৃশ্য হয়ে গেল ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করতে করতে চুল্লির লোহার ঢাকনাটা নেমে এসে মাকে চিরকালের মতো ‘জীবন ও মরণের সীমানা’ পার করে দিল ঠিক তখন মনে হল আমার আর নিজের বলতে কেউ রইল না। আত্মীয়স্বজন লেখার জগতের বন্ধুবান্ধব সকলেই আগের মত ছিল। কিন্তু সে থাকা বোধহয় নিজের কেউ থাকা নয়।
মুখার্জিবাবুকে যেখানে নিয়ে গিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই সিরিটির শ্মশানঘাটেই গিয়েছিলাম আমরা। শুধু ইলেকট্রিক চুল্লিতে দাহকার্যের আগে করনীয় কাজ করতে বড্ড একা লাগছিল। গনগনে লাল আগুনের গহবরে মা যখন অদৃশ্য হয়ে গেল ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করতে করতে চুল্লির লোহার ঢাকনাটা নেমে এসে মাকে চিরকালের মতো ‘জীবন ও মরণের সীমানা’ পার করে দিল ঠিক তখন মনে হল আমার আর নিজের বলতে কেউ রইল না। আত্মীয়স্বজন লেখার জগতের বন্ধুবান্ধব সকলেই আগের মত ছিল। কিন্তু সে থাকা বোধহয় নিজের কেউ থাকা নয়।
আরও পড়ুন:
গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-২৪: পিঠের পেছনে চেয়ারের ফ্রেমটা তাঁর চেহারার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর
শ্রাদ্ধশান্তির কয়েকদিন আগেই বুনি এল বম্বে থেকে।আর আমি অবাক হলাম এই প্রথম পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে বুনির সঙ্গে তার স্বামী অশোকবাবুকে আসতে দেখে। আলাপ হতে বেশ চমকে গেলাম। অবাক হয়ে ভাবলাম এই মানুষটার সম্বন্ধে আমি না জানি কত কিছু ভেবেছি। বুনি চিরকাল বড় চুপচাপ। তাই আমি ধরেই নিয়েছিলাম সে বোধহয় সুখে নেই। মনের কষ্ট সে মনে চেপে রেখেছে মুখে প্রতিবাদ না করে। এবার আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারলাম দাম্পত্য ব্যাপারটা ঠিক আন্দাজ করে বোঝা যায় না। বাইরে খুব উচ্ছল খুব হাসিখুশি, খুব হই-হুল্লোড় করা স্বামী-স্ত্রী’র দরজার আড়ালে ভাঙ্গা আয়নার মতো টুকরো সম্পর্ককে আন্দাজ করা যায় না। বুনির স্বামী অশোক আমার সমবয়সী। কিছু লোক আছে পরিচিতি না হলে সহজ হতে পারে না। অশোক ঠিক তেমন।
আমি যে বিয়ে’থা করিনি, যে মাকে নিয়ে একলা থাকতাম তিনি চিরকালের মত চলে গেলেন এটা জানতে পেরেই অশোক অফিসের জরুরি কাজকর্ম সামলে টানা দশ দিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছে। এর আগে আত্মীয়স্বজনের বহু বিয়ে শ্রাদ্ধ কেটে গেছে। বুনি একা এসেছে। অশোক আসেনি। সেই পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে তার না এলেও চলত। লৌকিকতা বজায় রাখতে বুনির আসাটাই যথেষ্ঠ। কিন্তু আমার ক্ষেত্রটা অন্য। বুনির থেকে অশোক এলে এই মানসিক অবস্থাতেও আমার ভালো লাগবে। তাই সে এসেছে।
নিয়মভঙ্গের কাজ দুপুরে মেটার পর রাতে যখন – বসে মায়ের গল্প করছি – তখন অশোক আমাকে জানালো দু’দিন বাদে ওরা বম্বে ফিরে যাবে। আর ওদের সঙ্গে আমিও যাচ্ছি অন্তত মাস দুয়েকের জন্য। এখানে যাদের যা জানাবার তাদের যেন আমি মনে করে বোম্বের অশোকের বাড়ির ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়ে দিই। কিছু কিছু দাবিতে আপত্তির কোন সুযোগই থাকে না। অশোকের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আমি বুনির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে খালি মিটিমিটি হাসছে।
আমি যে বিয়ে’থা করিনি, যে মাকে নিয়ে একলা থাকতাম তিনি চিরকালের মত চলে গেলেন এটা জানতে পেরেই অশোক অফিসের জরুরি কাজকর্ম সামলে টানা দশ দিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছে। এর আগে আত্মীয়স্বজনের বহু বিয়ে শ্রাদ্ধ কেটে গেছে। বুনি একা এসেছে। অশোক আসেনি। সেই পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে তার না এলেও চলত। লৌকিকতা বজায় রাখতে বুনির আসাটাই যথেষ্ঠ। কিন্তু আমার ক্ষেত্রটা অন্য। বুনির থেকে অশোক এলে এই মানসিক অবস্থাতেও আমার ভালো লাগবে। তাই সে এসেছে।
নিয়মভঙ্গের কাজ দুপুরে মেটার পর রাতে যখন – বসে মায়ের গল্প করছি – তখন অশোক আমাকে জানালো দু’দিন বাদে ওরা বম্বে ফিরে যাবে। আর ওদের সঙ্গে আমিও যাচ্ছি অন্তত মাস দুয়েকের জন্য। এখানে যাদের যা জানাবার তাদের যেন আমি মনে করে বোম্বের অশোকের বাড়ির ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়ে দিই। কিছু কিছু দাবিতে আপত্তির কোন সুযোগই থাকে না। অশোকের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আমি বুনির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে খালি মিটিমিটি হাসছে।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২০: অক্টোবর মাসের ষোলো, কী হল! কী হল?
অশোক জানে বুনিকে দিয়ে জানালে আমি সম্ভবত বোম্বেতে ওদের বাড়িতে যাওয়াটা এড়িয়ে যাবো। তাই সে নিজে এসেছে। যাতে আমার মাথায়- না বলার কথাটাও না আসে। নামকরা কোম্পানীতে হিউম্যান রিসোর্স সামলায়। হিউম্যান সাইকোলজী খুব ভালো বোঝে।
অশোকরা বহুদিনের প্রবাসী বাঙালি। পৈতৃক বাড়ি চেম্বুরের মৈত্রী পার্ক বলে একটা জায়গায়। চারদিক যখন উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটে ভরে গেছে তখন এই জায়গাটাতে ছড়ানো ছেটানো এক দু তলা বাড়ি । অশোকের বাবা বোম্বেতে রিফাইনারিতে চাকরি করতেন। তখন ওরা চেম্বুরের কাছেই রিফাইনারি কোয়ার্টারে থাকতো। সম্ভবত পরিচিত বন্ধুবান্ধব এবং তাদের আরো কিছু লোকজন মিলে এখানে প্লট করে বাড়ি করেছিলেন। আজকে সেই এলাকার দাম কোটি কোটি টাকা। বুনিদের বাড়ির একটু আগেই ঐতিহাসিক আর কে স্টুডিও। পৃথিবী বিখ্যাত রাজ কাপুরের সেই স্টুডিও আজ আর নেই। জায়গাটার হেরিটেজ ভ্যালু বাড়াতে আর কে স্টুডিওর সেই বিখ্যাত গেটটুকু আছে। ভেতরের শুটিং ফ্লোর ভেঙে সেখানে তৈরি হয়েছে গোদরেজ আর কে এস। বিরাট মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং কমপ্লেক্স।
বম্বে পৌঁছবার পর অশোক বলল রবিবারগুলো সে আমাকে নিয়ে ঘুরবে কিন্তু বাকি দিনগুলো তাকে অফিস করতে হবে। আমার জন্য সে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল। বলল যখন যেখানে যাবার দরকার হবে আপনি গাড়িটা ব্যবহার করবেন। আপনার বোন সংসার নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত। সে হয়তো সব দিন আপনাকে সময় দিতে পারবে না। আপনি যেখানে যাবার ইচ্ছে হবে ড্রাইভারকে বললে সে নিয়ে চলে যাবে। রাস্তায় কখনও কোথাও কোনও অসুবিধা হলে আমার পার্সোনাল মোবাইল নম্বরে ফোন করবেন।
এতকিছুর পরে খুব স্বাভাবিকভাবে আমি বুনির কাছে জানতে চেয়েছিলাম অশোক কি আফিফার ব্যাপারে কিছু জানে? বুনি জানিয়েছিল না। আমাদের ওখানের মতোই এখানেও কেউ কিচ্ছু জানে না।
আমার মনে হল এভাবে সবকিছু সম্ভব হচ্ছে কি করে? এটা কি আফিফা চাইছে বলে? নেরুল জায়গাটা আমি চিনি না অবশ্য বুনিও জানে না। ফিরোজ কেমন লোক সেটা আন্দাজ করতে পারছি। তাই বুনিকে সঙ্গে না নিয়ে আমি একাই ফিরোজের বাড়ি খুঁজে বের করার চেষ্টায় নেরুলে পৌঁছোলাম।
একটা সুবিধা ছিল যেখানে আশেপাশে সবই ফ্ল্যাটবাড়ি সেখানে বাংলো খুঁজে পাওয়াটা সোজা। অবশ্য যদি না ফিরোজ এতদিনে বাড়ি বদলিয়ে থাকে। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গেল বাংলো অনেক পেলাম সেখানে ফিরোজ নামে কেউ থাকেন না।
তখন আমি ভাবতে শুরু করেছি যে সত্যি সত্যি আমি ফিরোজের সঙ্গে দেখা করেই বা কি করব? তাকে শাস্তি দেবার কোন ক্ষমতা তো আমার নেই। এতদিন বাদে পুলিশের কাছে গিয়ে সব জানালেও কোনও লাভ তো হবেই না উল্টে আমাকে নিয়ে হয়ত তারা টানাটানি করবে।
অশোকরা বহুদিনের প্রবাসী বাঙালি। পৈতৃক বাড়ি চেম্বুরের মৈত্রী পার্ক বলে একটা জায়গায়। চারদিক যখন উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটে ভরে গেছে তখন এই জায়গাটাতে ছড়ানো ছেটানো এক দু তলা বাড়ি । অশোকের বাবা বোম্বেতে রিফাইনারিতে চাকরি করতেন। তখন ওরা চেম্বুরের কাছেই রিফাইনারি কোয়ার্টারে থাকতো। সম্ভবত পরিচিত বন্ধুবান্ধব এবং তাদের আরো কিছু লোকজন মিলে এখানে প্লট করে বাড়ি করেছিলেন। আজকে সেই এলাকার দাম কোটি কোটি টাকা। বুনিদের বাড়ির একটু আগেই ঐতিহাসিক আর কে স্টুডিও। পৃথিবী বিখ্যাত রাজ কাপুরের সেই স্টুডিও আজ আর নেই। জায়গাটার হেরিটেজ ভ্যালু বাড়াতে আর কে স্টুডিওর সেই বিখ্যাত গেটটুকু আছে। ভেতরের শুটিং ফ্লোর ভেঙে সেখানে তৈরি হয়েছে গোদরেজ আর কে এস। বিরাট মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং কমপ্লেক্স।
বম্বে পৌঁছবার পর অশোক বলল রবিবারগুলো সে আমাকে নিয়ে ঘুরবে কিন্তু বাকি দিনগুলো তাকে অফিস করতে হবে। আমার জন্য সে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল। বলল যখন যেখানে যাবার দরকার হবে আপনি গাড়িটা ব্যবহার করবেন। আপনার বোন সংসার নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত। সে হয়তো সব দিন আপনাকে সময় দিতে পারবে না। আপনি যেখানে যাবার ইচ্ছে হবে ড্রাইভারকে বললে সে নিয়ে চলে যাবে। রাস্তায় কখনও কোথাও কোনও অসুবিধা হলে আমার পার্সোনাল মোবাইল নম্বরে ফোন করবেন।
এতকিছুর পরে খুব স্বাভাবিকভাবে আমি বুনির কাছে জানতে চেয়েছিলাম অশোক কি আফিফার ব্যাপারে কিছু জানে? বুনি জানিয়েছিল না। আমাদের ওখানের মতোই এখানেও কেউ কিচ্ছু জানে না।
আমার মনে হল এভাবে সবকিছু সম্ভব হচ্ছে কি করে? এটা কি আফিফা চাইছে বলে? নেরুল জায়গাটা আমি চিনি না অবশ্য বুনিও জানে না। ফিরোজ কেমন লোক সেটা আন্দাজ করতে পারছি। তাই বুনিকে সঙ্গে না নিয়ে আমি একাই ফিরোজের বাড়ি খুঁজে বের করার চেষ্টায় নেরুলে পৌঁছোলাম।
একটা সুবিধা ছিল যেখানে আশেপাশে সবই ফ্ল্যাটবাড়ি সেখানে বাংলো খুঁজে পাওয়াটা সোজা। অবশ্য যদি না ফিরোজ এতদিনে বাড়ি বদলিয়ে থাকে। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গেল বাংলো অনেক পেলাম সেখানে ফিরোজ নামে কেউ থাকেন না।
তখন আমি ভাবতে শুরু করেছি যে সত্যি সত্যি আমি ফিরোজের সঙ্গে দেখা করেই বা কি করব? তাকে শাস্তি দেবার কোন ক্ষমতা তো আমার নেই। এতদিন বাদে পুলিশের কাছে গিয়ে সব জানালেও কোনও লাভ তো হবেই না উল্টে আমাকে নিয়ে হয়ত তারা টানাটানি করবে।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১০: রাজ ও স্প্যানিশ
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৬: শ্রীমায়ের সাধনা
ইতিমধ্যে বুনি একবার ফোন করে জানতে চেয়েছে ফিরোজের বাড়ি খুঁজে পেয়েছি কিনা। আমার কাছে না শুনে এসে বলেছে যে রাস্তায় রাস্তায় না ঘুরে বাড়ি ফিরে আসতে। আমিও যখন আশা ছেড়ে প্রায় ফেলবার কথা ভাবছি তখন হঠাৎ আমাদের ড্রাইভার বলল তার এখানে জানাশোনা ড্রাইভার আছে একবার ফোন করে তার কাছে জিজ্ঞেস করে দেখছে। ফোনে যে জায়গাটার নির্দেশ পাওয়া গেল সেটা লোকালয় থেকে একটু দূরে গাছপালা ঘেরা একটা পুরনো বাংলো। সে বাড়ির সামনে একটা মারুতি জেন দাঁড় করানো আছে। আমি কেমন যেন নিশ্চিত হয়ে গেলাম এই বাড়িটাই ফিরোজের। এই গাড়িটাও ফিরোজের । ড্রাইভারকে একটু দূরে দাঁড় করাতে বললাম। আমি গাড়িতে বসে রইলাম ড্রাইভারকে বললাম গিয়ে বাড়ির সামনে কোন নেমপ্লেট আছে কিনা দেখে আসতে। সে এসে জানালো আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি। নেমপ্লেটের নাম লেখা আছে। ফিরোজ রহমান। গাড়িটা স্টার্ট করা আছে।
আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আফিফা এবং মাসুদা দুজনেই চাইছে আমি ফিরোজের মুখোমুখি হই। কিন্তু আমার ঠিক কী করনীয় সেটা এখনও আমি বুঝতে পারিনি । ঠিক এই মুহূর্তে আমি ফিরোজকে দেখতে পেলাম। অবিন্যস্ত বড় চুল দাড়ি। একটা সিল্কের পাজামা পাঞ্জাবি পরে হাতে একটা ভারি জেরিকেন নিয়ে গেট বন্ধ করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট।
মনে পড়ে গেল আফিফার কাছে শুনেছি এই ভয়ংকর জেরিকেনের কথা।
আচমকা আমার ড্রাইভার হিন্দিতে বলে উঠলো—
—ওই ক্যানে নিশ্চয়ই পেট্রোল আছে। লোকটার মুখে জলন্ত সিগারেট!
এই কথার মধ্যেই ফিরোজ একহাতে গাড়ির ডিকি খুলল। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট – হাতে ঝুলন্ত জেরিকনটা ডিকেতে বসাতে গিয়ে টাল খেয়ে অসাবধানে জেরিকেনের ঢাকনাটা সম্ভবত ভেতরের পেট্রোল ভেপারের চাপে ছিটকে খুলে গেল। আতঙ্কে চমকে উঠতেই ফিরোজের ঠোঁট থেকে সিগারেটটা খসে পড়ল মুহূর্তে একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণ। বেশ খানিকটা দূরে হলেও আগুন আর হাওয়ার ঝাপটা লাগলো আমাদের গায়ে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে আমার ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাকে বেশ খানিকটা ব্যাক গিয়ারে পিছিয়ে নিল। আমি তার পিঠে হাত রাখতে গাড়ি দাঁড় করালো। আমি গাড়ি থেকে নেমে দেখতে লাগলাম অনেকটা দূরে আফিফা কি ভয়ংকর ভাবে তার প্রতিশোধ নিলো। আফিফা চেয়েছিল আমি স্বচক্ষে এটা যেন দেখতে পাই। এবার মুক্তি পাবে ওরা। হয়ত আমিও। আমাকে ফিরে বুনিকে সব বলতে হবে। এ বার নিশ্চিন্তে কলকাতা ফিরবো। ভাবতে হবে বাকি জীবনটা কীভাবে কাটাবো?—শেষ।
আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আফিফা এবং মাসুদা দুজনেই চাইছে আমি ফিরোজের মুখোমুখি হই। কিন্তু আমার ঠিক কী করনীয় সেটা এখনও আমি বুঝতে পারিনি । ঠিক এই মুহূর্তে আমি ফিরোজকে দেখতে পেলাম। অবিন্যস্ত বড় চুল দাড়ি। একটা সিল্কের পাজামা পাঞ্জাবি পরে হাতে একটা ভারি জেরিকেন নিয়ে গেট বন্ধ করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট।
মনে পড়ে গেল আফিফার কাছে শুনেছি এই ভয়ংকর জেরিকেনের কথা।
আচমকা আমার ড্রাইভার হিন্দিতে বলে উঠলো—
—ওই ক্যানে নিশ্চয়ই পেট্রোল আছে। লোকটার মুখে জলন্ত সিগারেট!
এই কথার মধ্যেই ফিরোজ একহাতে গাড়ির ডিকি খুলল। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট – হাতে ঝুলন্ত জেরিকনটা ডিকেতে বসাতে গিয়ে টাল খেয়ে অসাবধানে জেরিকেনের ঢাকনাটা সম্ভবত ভেতরের পেট্রোল ভেপারের চাপে ছিটকে খুলে গেল। আতঙ্কে চমকে উঠতেই ফিরোজের ঠোঁট থেকে সিগারেটটা খসে পড়ল মুহূর্তে একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণ। বেশ খানিকটা দূরে হলেও আগুন আর হাওয়ার ঝাপটা লাগলো আমাদের গায়ে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে আমার ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাকে বেশ খানিকটা ব্যাক গিয়ারে পিছিয়ে নিল। আমি তার পিঠে হাত রাখতে গাড়ি দাঁড় করালো। আমি গাড়ি থেকে নেমে দেখতে লাগলাম অনেকটা দূরে আফিফা কি ভয়ংকর ভাবে তার প্রতিশোধ নিলো। আফিফা চেয়েছিল আমি স্বচক্ষে এটা যেন দেখতে পাই। এবার মুক্তি পাবে ওরা। হয়ত আমিও। আমাকে ফিরে বুনিকে সব বলতে হবে। এ বার নিশ্চিন্তে কলকাতা ফিরবো। ভাবতে হবে বাকি জীবনটা কীভাবে কাটাবো?—শেষ।
ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।