শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অনেকক্ষণ নানান কিছু ভাবতে ভাবতে মনটা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এরপর অবশ্যম্ভাবী ভাবেই ঘুম এসে পড়েছিল। ঘুম না এলে মনে মনে ভেড়ার পাল গোনা বা উল্টো দিক থেকে ১০০-৯৯-৯৮ করে সংখ্যা গুনতে থাকা। এই সবই আসলে মনকে অন্যমনস্ক করা পদ্ধতি। মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তা ঘুরে ফিরে বেড়ালে মস্তিষ্কের কোষে কোষে অস্থিরতা জন্ম নেয়। তাই তখন তারা ক্লান্ত হয়ে থাকলেও বিশ্রাম নিতে পারে না। এই কারণেই চোখে আলো পড়লে কথাবার্তা চলতে থাকলে মশার গুনগুনানি কানে এলে ঘুম আসে না। এসব আমার ডাক্তারদের কাছ থেকে শেখা। বিশেষ করে আমার মনের চিকিৎসা যিনি করছেন তাঁর কাছ থেকে। মনের চিকিৎসায় উন্নতি করতে গেলে নিশ্চিন্তে ঘুমটা খুব জরুরি। তাই তিনি পই পই করে বলে দিয়েছেন যখন ঘুমোতে যাবেন তার অন্ততপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট আগের থেকে মোবাইল বন্ধ ল্যাপটপ বন্ধ। এমনকি বাড়ির ওয়াইফাই এর সুইচও বন্ধ করে দিতে হবে। মনকে শান্ত করতে হবে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে সিগারেট খাওয়া চলবে না।

আসলে আমার এই মানসিক রোগ ছাড়াও শারীরিক অসুবিধাগুলো তো আছেই আর ডাক্তারদের মতে, একটা পারিবারিক হার্টের সমস্যা রয়েছে। আমার ঠাকুরদা হৃদরোগে মারা গিয়েছিলেন। আমার বাবাও তাই।

কিন্তু সেদিন হঠাৎ কি যে হল মাথায় কারো একটা হাতের ছোঁয়ায় আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখলাম আমার শোবার খাটের ঠিক পাশের চেয়ারে আমার বাবা বসে আছেন। এতদিন পর্যন্ত আমি অচেনা বিদেহীদের দেখেছি। প্রথম যাকে চিনতে পেরেছিলাম সে হল আফিফা। এরপর আমাদের চারতলার মুখার্জিবাবু। আর এবার স্বয়ং আমার বাবাকে দেখলাম। পূর্ণিমা নয় কিন্তু জানালার বাইরের থেকে চাঁদের আলোর একটা হালকা প্রভাব ঘরটায় আলোছায়া করে রেখেছে। বাবা বসে আছেন। কিন্তু পিঠের পেছনে চেয়ারের ফ্রেমটা তাঁর চেহারার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে। ঠিক যেমন প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঢাকা জিনিস দেখা যায়। তেমনি বাবার শরীর ভেদ করে দেখা যাচ্ছে আরো দূরে আমার লেখার টেবিলটা। ঘরটায় পাখা চলছে, কিন্তু তার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি না। ঘরটার মধ্যে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা অনেকক্ষণ চলা এসি নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গেলে ঘরে যেমন একটা নিঃশব্দ ঠান্ডা পরিবেশ তৈরি হয় ঠিক তেমন।

—কেমন আছো?

কি অদ্ভুত! বাবা আগে কখনও আমার শোবার ঘরে এসে এরকম প্রশ্ন করলে আমি প্রথমেই ধড়মড় করে খাটে উঠে বসতাম। আজ কিন্তু আমি শুয়েই আছি। আমি স্বপ্ন দেখছি না! আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি এটাই ঘটছে।
বাবা যখন চলে গেলেন তখন আমি সবে কলেজ পাশ করেছি। বাড়িটা বাবাই করেছিলেন। অফিস যাবার সময় একদিন বাসের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডালহাউসি যাচ্ছিলেন। গরমকাল। প্রথমে লোকজন ভেবেছিল গরমের জন্য অসুস্থ হয়েছেন। কি ভাগ্যি সেই বাসেই দু’জন কম বয়সী ডাক্তার ছিলেন। তারা বেহালার বালানন্দ ব্রহ্মচারী হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার। চলন্ত বাসের মধ্যেই পিছনের লম্বা সিট খালি করে বাবাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল আর সেখানেই সেই দুই ডাক্তার বাবাকে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে হার্টের সমস্যা তখনই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। পাঠক পাড়ার বাসস্টপে বাবাকে নিয়ে তারা দু’জন এবং রাস্তার লোকজন হাতে হাত ধরে মানব-স্ট্রেচারে করে প্রায় দৌড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বালানন্দ ব্রহ্মচারী হাসপাতালে। এসব আমরা পরে জানতে পেরেছি। সেই দু’জনের তৎপরতায় বাবা সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর রিটায়ারমেন্ট হয়ে গেল। বাবা নিয়মিত হার্টের ওষুধপত্র খেতেন। তেল ঘি মসলা রেডমিট পাকা মাছের কড়াকড়ি হলো। খুব একটা সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করতেন না মানে খুব প্রয়োজন হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থেমে থেমে সিঁড়ি ব্যবহার করতেন।

এত কিছুর পরেও রিটায়ারমেন্টের পর বাবা বেশিদিন বাঁচেননি। কালীপুজোর রাত। ভয়ংকরভাবে বাজি ফাটছে। শব্দের বাছবিচার তখন ছিল না। এখন আইন থেকেও নেই। সাইলেন্সার ছাড়া ভয়ংকর শব্দ করে মোটরবাইক চালানোর মতোই জোর শব্দের বাজি পোড়ানোটা আসলে একটা মানসিক দুর্বলতা। নিজেকে সোচ্চারে প্রচার করবার একটা পথ বা পদ্ধতি। যত জোরে শব্দ মনে মনে তত নিজের “মূল্যহীন দাপটকে” নিজেই অনুভব করা।
সেদিনও তাই হয়েছিল। বাবা বারান্দার পাশের ঘরটাতেই শুয়ে ছিল। কাঠের খড়খড়ি দেওয়া জানলা বন্ধ ছিল। কিন্তু নিচের থেকে উঠে আসা একটা দো-দোমার অংশ আমাদের বারান্দায় এসে সশব্দে ফাটলো। সেই শব্দের জন্যই কিনা জানি না বাবার দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক করলো এবার আর তিনি ডাক্তার দেখানোর কোনও সুযোগ দেননি।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-২৩: লেখার অক্ষরগুলোতে লাল রংটা ক্রমশ শুকিয়ে খয়েরি হয়ে যাচ্ছে, তবে কি রক্ত?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

মায়ের আর্তচিৎকার শুনে আমি নিচের তলা থেকে ছুটে উপরে আসতে পেরেছিলাম এটাই সৌভাগ্য। বাবার হাতটা আমার হাতে আঁকড়ে ধরেছিলাম। ওই অবস্থায় মিনিট খানেকের মধ্যেই আমার হাতটায় একটা ঝাঁকুনি লাগলো। তারপর সবশেষ।

ঠিক এখন বাবা সেই ভাবেই আমার হাতটা ধরে আছেন। বাবা আজকে আমাকে কিছু বলতে এসেছেন? তাঁর কোনও না বলা কথা?

—আমি জানি তুমি খুব দুশ্চিন্তায় আছো? কিন্তু যে বিষয়ে তোমার কর্তব্য বা করণীয় কিছু ছিল না সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করাটাও যে অকারণ।

বাবা কি বলতে চাইছেন? আফিফার কথা?

—তোমার কিশোর বয়সের সম্পর্ক পরিণতি পেলে মেয়েটি বাঁচত না কি আরও কঠিন পারিবারিক দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাতো সেটা জানার আজ আর কোন উপায় নেই। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে যায়। সেদিন যেটা প্রায় অসম্ভব ছিল – আজ বাধা থাকলেও সেটা আর অসম্ভব নেই। আসলে সম্পর্কটা তো শুধুমাত্র দুজন মানুষের নয়, সম্পর্কটা পারিবারিক। সম্পর্কটা সামাজিক। দুটো পরিবার। দুটো পরিবারকে আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধতে পারা, দুটো ভিন্ন সমাজকে স্বাভাবিকভাবে মিলিয়ে দেওয়া যেখানে সম্ভব হয় না বাধা সেখানেই আসে। মধ্যবিত্ত সমাজের বিধি নিষেধ বা ট্যাব্যু অনেক বেশি। কিন্তু কৈশোরের সেই বাধার জন্য বাকি জীবনটা একা একা অবিবাহিত কাটাবার সিদ্ধান্তটা আমি মেনে নিতে পারি না। আবার তোমায় জোরও করতে পারি না।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৯: সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না?

বাবার কথা শুনতে শুনতে আমি মনে মনে একেবারে অন্য একটা জিনিস ভাবছি। সেদিন যদি সত্যি সত্যি আফিফাকে বিয়ে করতে চেয়ে বাবার মুখোমুখি হতাম বাবা কী বলতেন? বাবার কথা বললাম এই কারণে মাকে আমি রাজি করিয়ে নিতাম বাবা যদি হ্যাঁ বলতেন। কিন্তু বাবাকে রাজি করানোর ক্ষমতা আমার ছিল না। কিন্তু সে কথা সেদিন বলতাম যদি বাবা কী বলতেন?

—এখন এই দোনোমোনো মনের মধ্যে চেপে রেখে কোন লাভ নেই খোকা। তোমার মনের ভেতরে আর একটা অন্য অনিশ্চয়তা রয়েছে। তোমার ভেতরকার একটা সত্তা বলছে যে তুমি বোম্বেতে গিয়ে মেয়েটির সেই স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়াও এবং তার অন্যায়ের জন্যে তাকে জবাবদিহি করো। আর একটা সত্য বলছি, এখন এসব করে লাভ কী হবে।

বিদেহী আত্মারা মনের কথা যে উপলব্ধি করতে পারেন তার প্রমাণ আমি বারবার পেয়েছি। তাই আশ্চর্য না হয়ে আমি প্রশ্ন করলাম—

—সেদিন এক সংশয়ে আপনার কাছে প্রশ্নটা করা হয়নি তার দায় আমি আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। তাই আজ আপনার কাছে এই প্রশ্নগুলো করে আমি নিজেকে নিঃসংশয় করতে চাইছি। আমি কি বম্বেতে যাব? আমি কি ফিরোজের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াবো।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১৩: সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৫: রাক্ষসী মায়ায় ঘনাল কি বিপদের ছায়া

খানিক্ষণের নৈঃশব্দ্য। ধোঁয়া যেভাবে মিলিয়ে যায় ঠিক সেভাবেই বাবার চেহারার অবয়বটা পাশের চেয়ার থেকে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি সেই চেহারাটা এখন আমার লেখার টেবিলে ঠিক পাশটিতে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে বাবার জবাব আসে—

—একটা সিদ্ধান্তহীনতায় অশান্তি ভোগ করেছো। আরও একবার সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে সেই অশান্তি আরও বেড়ে যাবে। তুমি যদি মনে কর তুমি যে চাইছো তাই করতে পারলে তোমার মনের আক্ষেপ দুশ্চিন্তা ক্ষোভ কিছুটা লাঘব হবে তাহলে মনের কথা শোনো।

—না, আসলে মাকে নিয়ে আমার বড় দুশ্চিন্তা হয়। এর মধ্যে একদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তাতে মা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কলকাতার বাইরে কোথাও গেলেও একদিন বা দুদিনের বেশি আমি থাকি না। বম্বে গেলে তো একটা সপ্তাহ আমার কমপক্ষে লাগবে। সেটাও আর একটা সমস্যা।

—সেটা সমস্যা হবে না। মিটে যাবে।

—আঁজ্ঞে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

—আচ্ছা বুঝতে না পারার মতো কঠিন বিষয় তো কিছু নয়।

—বাবা আপনি ইঙ্গিত করছেন যে আমাদের কোন আত্মীয়-স্বজন এসে হঠাৎ করে থাকবেন? দিদিরা কেউ?

—আমি তো সেরকম কোন ইঙ্গিত দিইনি। তাছাড়া তোমার দিদিরা দুজনেই তাদের ছেলে-মেয়ে সংসার এসব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। আর তোমার মাকে তো তুমি খুব ভালো করে চেনো মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকার পাত্রী তিনি নন।

—তাহলে ?

—তুমি তো লেখ! তোমার সৃষ্ট চরিত্ররা এভাবে কথা বললে লেখক হিসেবে তুমি কি ইঙ্গিত পাও। নাকি লেখার সময় লেখক হিসেবে একটা দূরত্ব থেকেই সবকিছু দেখো। সেখানে ব্যক্তিগত ইমোশান কাজ করে না। তাই ভাবতে পারো । এক্ষেত্রে পারছো না। আমি তোমার মাকে নিতে এসেছি খোকা।—চলবে।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content