রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


দুবাইতে সব ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ একদিন আচমকা এসে ফিরোজ বাক্স-পেঁটরা গুছিয়ে নিয়ে বলল ইন্ডিয়া যেতে হবে। কেন? ঠিক এই কেনতে এসেই সব থেমে যাচ্ছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু আফিফার মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়, এ সন্দেহটা মনে আসছে। সেই সন্দেহ নিরসন করা যাবে কী করে?

আবার শবনমের কাছে শোনা পুরোনো কথাগুলো মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে। ফিরোজের মিনিমার্টের দোকানের অর্ধেক জায়গায় নতুন দোকানের সাজগোজ শুরু হয়েছিল। অন্য অর্ধেকে চলতে লাগলো ফুরিয়ে আসার স্টকের বিক্রিবাটা। এরপর এক শুভদিনে চালু হল ফিরোজ স্টাইল হাউস। মেয়েকে নিয়ে আফিফা গিয়েছিল দোকান উদ্বোধনের দিন। এ সব দোকানে ঝাঁ চকচকে সাজগোজ আলো ইন্টেরিয়র খদ্দের টেনে আনে। ফিরোজকে তার খুব পরিচিত এক শেখ সাহায্য করল। মীনাবাজারে ফিরোজ স্টাইল হাউস পরিচিত নাম হয়ে উঠলো।

সংসারে অর্থের আগমন বাড়ছে। ফিরোজের চালচলনে বদল এল। গাড়ি কিনে ফেললো ফিরোজ। ধীরে ধীরে শেখের টাকা শোধ করতে শুরু করল। ফ্যাশন জুয়েলারির দোকানকে বড় করতে গেলে বিজ্ঞাপন খুব জরুরি। ফিরোজের পরিচিত এই শেখের নিজস্ব অ্যাডভার্টাইজিং ইউনিট ছিল। তারা ফিরোজের দোকানের বিজ্ঞাপন শুরু করল ফিরোজ স্টাইল হাউসের ডিজাইনার জুয়েলারি পরে বিজ্ঞাপনে ধরা দিল লাস্যময়ী মডেলরা।
সেটা ভিডিও ক্যাসেট টপকে সিডির যুগ। দুবাইতে নানা ব্র্যান্ডের ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি। ফিরোজের বাড়িতেও ছিল বড় টিভি সিডি প্লেয়ার। মেয়ে কিছুটা বড় হয়ে গেছে। স্কুলে ভর্তি হবে। বাড়িতে এখন কাজকর্মের জন্য আগের মতো অত সময় লাগে না। কাপড় কাচা ঘর পরিষ্কারের মেশিন আছে। অবসর সময়ে আফিফা সিনেমা দেখত। সেদিন দুপুরবেলা। মেয়ে ঘুমোচ্ছে। দিলীপকুমারের কোন একটা সিনেমা চলছিল। দেখতে দেখতে আফিফার চোখ লেগে গিয়েছিল।

হিন্দি সিনেমার সংলাপ আবহসংগীতের একটা পরিচিত ধরণ আছে। আচমকা বিজাতীয় শব্দ শুনে চোখ খুলে চমকে ওঠে আফিফা। এসব কী চলছে সিডি-তে। তড়িঘড়ি সিডি প্লেয়ার বন্ধ করে। চোখ বুজিয়ে থাকে সে। ব্লু ফিল্মের সিডি তার বাড়িতে এল কি করে? সিডি বের করে দেখলো সিডির গায়ে অদ্ভুত কিছু অক্ষর আর সংখ্যা লেখা আছে।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১৯: বছর চারেকের ছোট্ট একটি মেয়েকে যেন সাদা চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৪: মুহূর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে, আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে

বিয়ের ঠিক পরে পরেই বাড়িতে প্রথম সিডি প্লেয়ার আনার পর ফিরোজ একবার এই ধরনের সিডি এনেছিল। আফিফা আপত্তি জানিয়ে বলেছিল তার এসব দেখতে ভালো লাগে না। তারপর থেকে এই ধরনের কোন সিডি তার বাড়িতে ছিল না। আর সবচেয়ে অদ্ভুত সিডির শুরুটা তো নির্দোষ হিন্দি ছবি।

ফিরোজকে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে সে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল—

— হতে পারে সিডি লাইব্রেরি থেকে আনা। অনেকে এই ধরনের সিডি পছন্দ করে, হয়তো ভুল করে চলে এসেছে। যা সিডি আছে আমাকে দিও আমি চেক করে নেব।

আফিফা অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করেছিল, সবকটা সিডির নাম দেখেই ফিরোজ তিনটে সিডি সরিয়ে নিল। সিডিগুলো চালিয়ে দেখার কোনও প্রয়োজন তার হলো না। ঠিক এখান থেকেই আফিফার মনে ভয় শুরু হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর

বুনিদের আসানসোলের বাড়িতে সেই রাত্রে ছাদের ওপর আমি যা যা দেখেছিলাম তা যদি সত্যিই মনের ভুল হয়ে থাকে এবং পুরোটাই আমার কল্পনাপ্রসূত হ্যালুসিনেশন হয় তাহলেও একটা প্রশ্ন থাকে। সেই প্রশ্নের উত্তরটা, আফিফা আর তার মেয়ের আগুনে পুড়ে মৃত্যুর আসল রহস্যটা আমাকে জানতেই হবে।

কলকাতায় মাকে নিয়ে ফিরে এসেছি কিন্তু মনে একটুও শান্তি নেই। লিখতে বসতে পারেনি। দেবরাজবাবু এর মধ্যে আমার নতুন লেখা নিয়ে অনেকবার তাগাদা করেছেন। নিরুপায় হয়ে একদিন ওঁর অফিসে গেলাম।

প্রায় বেশ খানিকক্ষণ আমার দিকে উনি তাকিয়ে রইলেন। ওঁর অফিসে একটা বেশ দামি চা খাওয়া যায়। যতক্ষণ চাটা খাচ্ছিলাম উনি আমার দিকে দেখছিলেন। দেখা শেষ হতে আমাকে বললেন—

— ব্যাপার কি বলুন তো? এত বছর আপনাকে চিনি এরকম অবস্থা কখনও দেখিনি তো!

আমি উত্তর দিচ্ছি না দেখে উনি টেবিলের উপর পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে ধীরে ধীরে বললেন।

— দেখুন আমি আপনার শুভানুধ্যায়ী। এত বছরের পরিচিতি। আপনার মনের দোটানা আমার কাছে খুলে বলতে পারেন। আমি যদি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি।

— ভালো প্ল্যানচেট করতে পারেন এমন কাউকে জানেন আপনি?
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৮: প্যায়ার করনে ওয়ালে প্যায়ার করতে হ্যায় শান সে— আশার কণ্ঠ ও আরডি-র সুর, অনবদ্য

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

দেবরাজবাবু বহুদিনের প্রকাশক। ব্যবসায়ী লোক। বহু মানুষের সঙ্গে তার ওঠা বসা। কিন্তু আমার মুখে কথাটা শুনে উনি হাঁ হয়ে গেলেন। থতিয়ে যাওয়া ভাবটা কাটাতেই আবার জিজ্ঞেস করলেন—

—কী? প্ল্যানচেট? মানে ওই আত্মা-টাত্মা নিয়ে ব্যাপার?

— হ্যাঁ।

সাহেবরা বলে সেয়ন্স!! বাংলায় প্রেতচর্চাকারী বলা যেতে পারে। দু’দিন বাদে সন্ধেবেলা দেবরাজবাবু আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাঁর কাছে গেলেন তিনিও মহিলা। দেবরাজবাবুর পরিচিত সব বিশেষজ্ঞই মহিলা কেন এটা সেই অবস্থায় জিজ্ঞেস করা হয়নি। তাঁর নাম ঈপ্সিতা চ্যাটার্জি। রোগাটে গড়ন। চেহারায় একটা আভিজাত্য আছে। যে ঘরটায় আমরা বসলাম সেই ঘরটাতে ঢুকলেই একটা অদ্ভুত অনুভুতি হয়। ঘরে সাজানো জিনিসপত্র বা দেওয়াড়ে টাঙানো ছবিতে খানিকটা তন্ত্রের প্রভাব। মহিলা যে অলংকার পরে আছেন সেগুলো হাড়ের অলংকার। প্রথমে এসে খানিকক্ষণ আমাকে দেখলেন তখনও কোন কথা হয়নি। যা কথা বলেছেন দেবরাজ বাবু। টেলিফোনে।

— যিনি মারা গেছেন তিনি আপনার কে হন ?

কথা বলামাত্র গলাটা শুনে বেশ সমীহ হল। একটু ফ্যাসফ্যাসে পুরুষালি কণ্ঠস্বর। এমন নয় যে প্রথম দিন পুরো ব্যাপারটা শুনে নিয়ে আবার আমাদের পরে একদিন আবার যেতে হবে। উনি সেদিনই আমাদের সময় দিয়েছেন এবং তার জন্য টাকা নিয়েছেন।
— না মানে আমার পরিচিত।
— আত্মীয়া নন?
— আঁজ্ঞে না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৪: কোন সকালে মুক্তির অপেক্ষায় ‘ত্রিযামা’

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles

ঈপ্সিতা আমাকে ঘরের অন্যদিকে ডাকলেন। সেখানে একটা তে-পায়া টেবিল। সে টেবিলের তিন দিকে তিনটে চেয়ার। আমার পরিচিতাকে যে দেবরাজ বাবু চেনেন না, সেটা আমি স্পষ্ট করে দিয়েছিলাম। তবু দেবরাজবাবু আমি আর ঈপ্সিতা বসলাম তিনটে চেয়ারে। তিনি টেবিলের ওপর রাখা একটা সুগন্ধি মোমবাতি জ্বাললেন – সেই টেবিলেই সম্ভবত সুইচ ছিল। সেখানে হাত রাখতে সমস্ত ঘরের আলো ক্রমশ কমে অন্ধকার হয়ে গেল।

— মেয়েটার নাম পরিচয় কিছুই জানাতে হবে না। আপনি তাঁর কথা ভাবুন। দুটো হাতে আমার আর দেবরাজ বাবুর হাত ধরুন। দেবরাজ বাবু অন্য হাতে আমার আরেকটা হাত ধরুন।

ঈপ্সিতার হাত স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে কি রকম একটা অনুভূতি হল। কেমন যেন বরফের মতো ঠান্ডা হাত। ঈপ্সিতা তাঁর ফ্যাসফ্যাসে গলায় ফিসফিস করে বললেন

— অন্য কিছু ভাববেন না আপনি সেই মৃতার ওপর কনসেন্ট্রেট করুন। দেবরাজ বাবু আপনি মনে মনে ভাবুন একটা শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভ্যাকুম নয় শূন্য মানে জিরো!
আরও পড়ুন:
আমি চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করতে- আফিফার কথা মনে করতে পারলাম না। আমার চোখে ভাসছে বুনিদের বাড়িতে সেদিনের রাতে দেখা সেই অদ্ভুত ঘটনাটা চাদরে ঢাকা একটা বাচ্চা মেয়ে বাঁচার জন্য ছটফট করছে।

আচমকা ঈপ্সিতা কথা বলে উঠল। এতক্ষণ শোনা গম্ভীর ফ্যাসফ্যাসে গলায় নয়, একটা বাচ্চা মেয়ের গলায় প্রথমে সে ইংরেজিতে কথা বলল –

— হোয়াই আর ইউ কলিং মি? হোয়াই?

তারপর একটু যেন ভাঙ্গা বাংলা উচ্চারণে—

— কেন ডাকছো আমায়? আমি কিছু বলবো না, আই‘ল নট স্পিক টু ইউ!

আচমকা দেবরাজবাবু কথা বলে উঠলেন। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরটা অবিকল ঈপ্সিতা ম্যাডামের মতো একটু গম্ভীর ফ্যাসফ্যাসে।

— কথা বলুন। স্পিক টু হার

আমি যেন কথা বলতে পারছি না, গলায় যেন শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে। কোনওক্রমে বললাম —

— তুমি কি মাসুদা? আর ইউ মাসুদা? হোয়ার ইজ য়োর মম? আফিফা কোথায়?

— শশ! চুপ! মাম্মা আসবে! শি উইল কাম নাও!—চলবে।

শশ, চুপ! ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content