শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আমি ভাবতে পারছি না যে, সুইমিংপুলে সারাদিন কচিকাঁচা বাচ্চা ছেলেপুলে তাদের মাম্মি মাসি-আন্টি ফুল দিদিরা এবং দিনান্তে কাক্কু, মেসো ডাডা জেজু জলকেলি করে সেই জলের থেকেই আমি কোন বিদেহী রমণীকণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। বিদেহী মানে দেহ নেই বা সূক্ষ্মদেহী। ঠিকই তো আত্মার কোনও অবয়ব হয় না, দেহই হয় না। অস্তিত্বের ঝামেলাই নেই।

তাইতো যখন খুশি যেখানে খুশি যেতে পারে যাকে খুশি তার কাছে নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে পারে এঁরা। জীবন মৃত্যুর লড়াইতে মৃত্যুর হার হতে পারে। কিন্তু মৃত্যুর বিনাশ নেই। তার জয় অবশ্যম্ভাবী। তাই জীবিত দেহীর থেকে মৃত বিদেহীর ক্ষমতা বেশি।

কি সব ভুলভাল ভাবছি আমি? এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে একটু ভাববার চেষ্টা করি। আমি কি হ্যাল্যুসিনেশনে ভুগছি? শরীরে কি সোডিয়াম ব্যালেন্স কম হয়ে গেল? আবার তাকে অনুযোগের গলায় বলতে শুনলাম।

—পৃথিবীর সবকিছুই কিন্তু মনের ভুল বা হ্যাল্যুসিনেশন নয়।
চমকে উঠলাম। এক বুক হাওয়ায় ভর্তি হাপর দুটো যেন একসঙ্গে ভয়ে চুপসে গেল। আমার মনের ভাবনাও তো বুঝে ফেলছে।

—তাতে ভয় পাওয়ার কী আছে? খারাপ কিছু ভাবছো না। কাউকে ক্ষতি করার কথাও তো ভাবছো না।

আশেপাশে কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে কিনা দেখলাম। আশ্বস্ত হয়ে মৃদুস্বরে জলের দিকে তাকিয়ে বললাম।

—খারাপ কিছু ভাবলে বা ক্ষতি করতে চাইলে কী হতো?

—শাস্তি দিতাম।
কথাটা বলে সে খিলখিল করে হাসলো। এই হাসিকেই কি কবি সাহিত্যিক জলতরঙ্গের সঙ্গে তুলনা করে। যদিও লিখি কিন্তু আমি করি না। মানে আমার করার দরকার পড়ে না। আমি ক্রাইম উপন্যাস লিখি। সেখানে প্রবঞ্চনা আছে। প্রতিহিংসা আছে। নিষ্ঠুরতা আছে লোভ আছে। প্রেম নেই ভালোবাসা নেই। আমার উপন্যাসের যথেষ্ট কাটতি আছে। আমি কিশোর বয়স থেকেই ক্রাইম উপন্যাস পড়তাম। আমাদের কিশোরের বয়সে নিষেধের বেড়াজাল অনেক কঠিন ছিল। এখন মোবাইল ফোনের যুগে সেসবের বালাই নেই। তাই বড়দের বইয়ের প্রতি আমাদের একটা অমোঘ আকর্ষণ ছিল। তবে বড় হয়ে মানে চেহারায় নয় বোধে বড় হয়ে এটা বুঝেছি চিরকালই মানুষের নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ বেশি। নিষিদ্ধ আপেল না খেলে আদম ও ইভের প্রেম জাগতো না। আর আমরাও আসতাম না। সারা পৃথিবীতে নিষিদ্ধ ছবি নিষিদ্ধ বই নিষিদ্ধ কাহিনি নিষিদ্ধ সিনেমার আকর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর। রাস্তায় পড়ে থাকা পড়ার যোগ্য বইয়ে নজর রাখেন গুটিকয়েক আধপাগলা মানুষ। কিন্তু সুস্থ মানুষেরাই আড়চোখে বেশি বেশি অসুস্থতা খুঁজে বেড়ায়। বোধ এবং বয়স বাড়তে এটাও বুঝেছি পারভার্ট, অসুস্থ, মেন্টালি সিক, অসভ্য ইতর এসব শব্দবন্ধে সমাজে যাদের অলংকৃত করা হয় তারা আসলে হদ্দবোকা। তাদের ভদ্রতার মুখোশটা সস্তা ফুটো ছেঁড়ামোজার মতো। তারা ভাবে জুতোর আড়ালে ছেঁড়ামোজাতে দিব্যি কাজ চলে যাবে। কিন্তু কোনও কারণে জুতোর ঢাল খুলতে হলে ফুটো মোজার ভেন্টিলেটার দিয়ে ‘অসভ্য’ বুড়ো আঙ্গুল বা ‘পারভার্ট’ গোড়ালি যে বুদ্ধিমান সমাজের চোখে ধরা পড়ে যাবে সেটা তারা ভাবে না। যারা ভাবে তারা ধরা পড়ে না। দিব্যি শ্রদ্ধেয় গুরুগম্ভীর দাদা জেঠু কাকা মেসোমশাই বা বৌদি কাকিমা জেঠিমা, রাঙামাসি ফুলমাসি হয়ে সমাজজীবনে মিশে থাকে। সভ্যতার চিরুনি তল্লাশিতে তারা ধরা দেন না। হ্যাঁ, এখানে একটা কথা বলা খুব জরুরি। নিষিদ্ধ নজর ব্যাপারটা আক্ষরিক অর্থে নিখাদ গণতন্ত্রের মতোই জেন্ডার বায়াস নয়। স্ত্রী পুরুষ বা অর্ধনারীপুরুষ সকলেই এই জান্তব অনুভূতিতে সচেতন। কিন্তু তারা সকলেই সামাজিক মুখোশের নিয়মিত পরিচর্যা করেন। ফুটোফাটা থাকলে যত্ন সহকারে সারিয়ে নেন। তাই কপালের দোষে ধরা পড়ার আগে জানাই যায় না যে, দিকে দিকে সমাজকল্যাণে পরমদায়িত্ববান একবিশিষ্ট নাগরিক আসলে একটি আপাদমস্তক জোচ্চোর এবং লম্পট।

—ঠিক। মানুষ তো পোশাক-আশাক পরা ঠাট-বাট শেখা চতুস্পদ জন্তু। ওম্নিভোরাস। সবকিছু খায়।

বাঙালি ভূত ইংরিজি বলছে শুনে বেশ ভাল লাগল।
বুকজলে দাঁড়িয়ে বিদেহী বান্ধবীর কথা শুনতে লাগলাম।

—সংসারে সমাজজীবনে মানুষকে নিরন্তর অভিনয় করতে হয়। বাবা-কাকা-জেঠু- মা-কাকীমা-জেঠিমা বা স্বামী-স্ত্রী। গুরু-শিষ্য নেতা-চ্যালা অথবা বন্ধু-প্রেমিক-প্রেমিকা। অভিনীত চরিত্রের থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারলে কোন সমস্যা নেই। চরিত্রটাকে নিজে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করলেই সমস্যা। তখনই দুঃখ-কষ্ট মান-অভিমান জ্বালা-যন্ত্রণা।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১: জলের তলায় তার শরীরের কোনও অস্তিত্ব নেই!

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৯: উন্নয়নের কাণ্ডারী নির্ণয়ে পিতৃতান্ত্রিক পক্ষপাতিত্ব

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

গলা শুনে মনে হচ্ছে ২৫ থেকে ৩৫ কোথাও একটা বয়েস। তার এমন গভীর জীবনবোধ?

ঘণ্টা বেজে গেল। মানে সুইমিং পুল বন্ধের ঘণ্টা। আরব্য রজনীর গল্প মাঝপথে থামিয়ে সেদিন ফিরে আসতে হবে। শুধু কথা নয় গলা শুনেও বিদেহীর চেহারাটা দেখার বড় লোভ হচ্ছিল। গলার সঙ্গে চেহারা মেলে না এমন তো নয়। তনুজা বা শর্মিলা ঠাকুরের কণ্ঠস্বরের মতোই অপূর্ব তাদের শরীরী মাধুর্য্য।

অবশ্য গলা শুনে ঠকতেও হয়েছে। একটা সময় রেডিও নাটক খুব জনপ্রিয় ছিল। শুক্রবার রাত আটটায় রবিবার দুপুরের নাটকে বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চেহারা না জানলেও কন্ঠস্বরের প্রতিটি খাঁজ পরিচিত ছিল। সেলিব্রিটিদের তখন ক-খ-গ-ঘ নিউজ পোর্টাল মারফত প্রতি মুহূর্তে নিজেদের সেল করতে হতো না। চেহারা দেখানোর কোনও দায় ছিল না। ভক্তদের আড়ালে নিজেদের যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখা ছিল সেদিনের দস্তুর। সেই সময় এক অতি জনপ্রিয় অভিনেত্রীর গলা শুনে চেহারা সম্বন্ধে বেশ একটা নিটোল ধারণা হয়েছিল। কোন এক অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখলাম। মেজ পিসিমা মার্কা একটা ডালডার কৌটোর মতো চেহারা। মোটা ফ্রেমের চশমা। কপালে একটা আট আনা সাইজের লালটিপ। মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। চোখ বুজিয়ে ফেললাম। মনের পর্দায় ভেসে উঠলো মহাকবি কালিদাসের মেঘদূতমের সেই যুগান্তকারী রূপমাধুর্য্য বর্ণনা—
তন্বী শ্যামা শিখরি-দশনা পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী
মধ্যেক্ষামা চকিত-হরিণী প্রেক্ষণা নিম্ন-নাভি;!
শ্রোনীভারাদলস-গমনা স্তোক-নম্রা স্তনাভ্যাং
যা তত্র স্যাদ যুবতি-বিষয়ে সৃষ্টি রাদ্যের ধাতু;!
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১০: কিশোর কণ্ঠের উপর যেন এক অলিখিত দাবি ছিল পঞ্চমের

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৮: কোষার ভান্ডার ছররি থেকে কুঠাঘাট হয়ে কুরদার

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী

কালিদাসের এই শ্লোকের বাংলা মানে হল ‘সে তন্বী, সে শ্যামা, সুন্দর শিখর যুক্ত তার দন্তসারি, পাকা বিম্ব ফলের মতন তার ওষ্ঠ ও অধর, তার ক্ষীণ কটি, দৃষ্টি হরিণীর মত চঞ্চলা, গভীর তার নাভি, নিতম্বের গুরুভারে তার গতি শিথিল, স্তনের ভারে সে সামান্য আনত, তুমি এরকম যাকে দেখবে, তোমার মনে হবে যুবতী সৃষ্টিতে সে-ই বিধাতার আদর্শ।’

এই কালিদাসের জন্যই শেষমেশ আমার বিয়ে হয়নি। মানে কালিদাস পড়ার পর থেকে চোখ বোজালেই আমি যাকে দেখতাম যে আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াতো যার শরীরের সুগন্ধ পেতাম। আর চোখ খোলার পর যাদের দেখতাম তাদের কারও সঙ্গেই তার মিল পেতাম না। আমি খবরের কাগজের অফিসে বিজ্ঞাপন জোগাড়ের কাজ করতাম। সেখান থেকে কীভাবে ক্রাইম স্টোরি রাইটার হলাম সেটা একটা গোটা উপন্যাস। তবে একটা ওয়ান লাইনার দিতে পারি। আমাদের চিফ এডিটরের পুলিশমহলে এক হোমরা চোমরা বন্ধু ছিলেন। তার লেখক হবার খুব শখ। কিন্তু লেখার হাতটি একেবারেই কাঁচা। চিফ এডিটর আমার ডিপার্টমেন্ট হেডের বিশেষ বন্ধু। তিনি বন্ধুকৃত্য করতে আমায় লেখা আনতে পাঠাতেন। সেই কাঁচা তলতলে ছানা কাটা লেখাকে পাকা হাতের আঁচে গরম করতে করতে সুখাদ্য সন্দেশ বানাতেন এডিটর স্বয়ং। আর প্রতি হপ্তায় সেই পুলিশকর্তার নামে ধারাবাহিক লেখা ছাপা হতো। লেখা বয়ে আনার সুবাদে ছাঁচ বদলানোর আগের ও পরের চেহারা দুটোই আমি পড়তাম। আর অবাক হয়ে দেখতাম কতখানি খারাপ লেখাকে কলমের জোরে এত ভালো করে পরিবেশন করা যায়। বন্ধুত্ব ছাড়াও এডিটর সাহেবের আরেক উদ্দেশ্য ছিল সেটা হল রাজনৈতিক অলিন্দের স্কুপ জোগাড় করা।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৩: আচমকা রাতের পার্টিতে হাজির পুলিশ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৪: মাছের বাজারের দুনিয়ায় আলিপুরের ‘নেট বাজার’ তালিকায় শীর্ষে

ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে, বাচ্চা খেতে খেতে টিভি দেখে কিংবা ফোন ঘাঁটে?

কাগজের সম্পাদক সেই ‘অলেখক’ পুলিশকর্তাকে সেইকাজে ব্যবহার করতেন। একবার লেখা জোগাড় করতে দেরি হয়ে গেল। বিশেষ কোনও কাজে পুলিশ কর্তা ব্যস্ত থাকায় দুদিন গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে আমায়। মাঝে একটা ছুটির দিন। তারপরে দিনই লেখা ছাপতে যাবে। সম্পাদক চূড়ান্ত ব্যস্ত। কাঁচা লেখা কার্বাইড দিয়ে পাকানোর সময় আর নেই। তখন আমাদের বাড়িতে ল্যান্ডফোন নেই। বাড়ি গিয়ে দেখলাম সম্পাদক চিরকুট পাঠিয়েছেন। সে সব পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতেই সুইমিংপুলের ওয়াশরুম থেকে স্নান সেরে জামাকাপড় পাল্টে বের হলাম। এই বাড়তি সময় দেবার জন্যেই পুল বন্ধ হবার আধঘণ্টা আগে পুল ছাড়ার ঘণ্টা বাজে। আজ যখন পুল ছাড়লাম তখন ট্রেনার ছাড়া আর কেউ ছিল না। আমাদের এই পুলটা রাস্তা থেকে বেসমেন্টে সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নেমে এসে। নামার সময় দেখেছিলাম সিঁড়ির মাঝামাঝি আলোও জ্বলছে না সিঁড়ির মুখের অফিস ঘরটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে অফিস ঘরের আলোটাও এখন সিঁড়িতে এসে পড়ছে না। আনমনে উঠে আসছিলাম। হঠাৎ মনে হল আমার বেশ কয়েকটা ধাপ ওপরে স্পষ্ট কেউ একটা দাঁড়িয়ে। কোন মহিলা। এত রাতে পুল বন্ধ হওয়ার সময় কে এসেছে? চশমা লাগার মাঝবয়সটা পেরিয়ে এসেছি। চোখের চশমাটা খুলে টি-শার্টে মুছে আবার চোখে দিলাম। না, কেউ তো নেই। মিথ্যে বলবো না একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কপালে ঘাম জমে গিয়েছে জিভটা শুকনো। নড়তে পারছি না আমি। পেছনে পায়ের শব্দ। আরও চমকে তাকালাম।—চলবে

সিঁড়িতে কে দাঁড়িয়ে? ছবি: সংগৃহীত

* মিস মোহিনীর মায়া (Miss Mohinir Maya) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।।

Skip to content