শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আমি আর ভাবতে পারছি না। মাকে কী করে বোঝাই যে আমি নিজে চোখে মুখার্জিবাবুকে যেতে দেখেছি। তার মানে আমি কি আত্মা দেখতে পাচ্ছি? এতদিন অচেনাদের দেখেছি। মানুষজন শব্দটা এসে গিয়েছিল—আবার আত্মাজন লিখতেও মন চাইল না। এখন তো চেনাদের দেখছি। ঠিক কী হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না।

আমি গিয়েছিলাম। মার কথা রাখতে সুমন্তর সঙ্গে নবীন মুখার্জির ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই সুমন্তর দিদি মুখার্জিবাবুর স্ত্রী কান্নাকাটি করছিলেন। মুখার্জিবাবুর দুই মেয়ে। দু’ জনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড়জন কলকাতায়। সল্টলেকের বাসিন্দা। ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে চেন্নাইতে। সুমন্ত ফোন করে ভাগ্নিদের খবর দিচ্ছিল। তারা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নবীন মুখার্জির বড় জামাই সম্ভবত পিস হ্যাভনে মুখার্জি বাবুর শবদেহ রেখে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। ঘরের মধ্যে আমি বড় অস্বস্তিতে ছিলাম। একে একে আবাসিকদের সকলে মুখার্জিবাবুর ফ্ল্যাটে এসে ভিড় জমাচ্ছে। কী করে হল কীভাবে হল সেই সমস্ত জমা খরচের হিসেব দিচ্ছিল সুমন্ত। আমি আর চোখে দেখছিলাম নবীন মুখার্জির দিকে। চোখ দুটি বোঝা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। মুখে কোনও বিকৃতি নেই।

ডাক্তার হয়তো কোনও ইনজেকশন দিয়েছিলেন তার প্রভাবেই চিরঘুমের যাবার মুহূর্তটা খুব কষ্টকর হয়নি। শরীরের উপর একটা সাদা চাদর পাতা আছে। চোখের উপর তুলসী-টুলসীগুলো হয়তো পরে দেওয়া হবে। কপালে চন্দন পরিয়ে দেবে মেয়েরা। পায়ে লাল আলতা মাখিয়ে পায়ের ছাপ তুলে নেবে পুত্রসম শ্যালক সুমন্ত। সুমন্ত সেরকম স্থায়ী চাকরিবাকরি করে না। বিয়ে থা এখনো হয়নি। দিদি জামাইবাবুর কাছেই থাকতো।

নবীন মুখার্জি বা তার স্ত্রী দু’ জনেরই বয়স হয়েছে। এমন বয়স্ক দম্পতির কাছাকাছি একজন কম বয়সী ছেলে থাকাটা তো বল ভরসা বটেই। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিলাম। নিচে আবছা যাকে দেখেছিলাম তার সঙ্গে নবীনবাবুর কোন মিল পাচ্ছি কিনা। আসলে গোটা শরীরটা সম্ভবত তখন একটা সাদা চাদরেই ঢাকা ছিল সেটাও স্পষ্ট বুঝতে পারিনি। সবকটা অবয়ব এমনকি নবীনবাবুও তখন কেমন যেন কুয়াশাভরা আবছায়া অস্পষ্ট।
নবীন মুখার্জির বড় মেয়ে সেই রাতেই পৌঁছে গিয়েছিল। ছোট মেয়ে পৌঁছলো পরের দিন বেলা প্রায় এগারোটা নাগাদ। বেহালার মানুষজনের জন্য শিরিটির শ্মশান কাছাকাছি পড়ে। জেমস লং থেকে রায় বাহাদুর রোড ধরে গেলে টেম্পোতে মাত্র মিনিট দশেক। তবে আমি গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে নবীন মুখার্জি দুই মেয়ে ও জামাইরা ছিল। সুমন্ত পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে টেম্পোতে গিয়েছিল। নবীর মুখার্জির বাড়িতে তার সদ্যবিধবা স্ত্রীর কাছে অন্যান্য আবাসিকদের মা-বৌদের সঙ্গে আমার মা-ও ছিলেন।

একজন সজ্জন মানুষ চলে গেলেন। পাশে টালিনালার দিকটা নোংরা হলেও শ্মশানচত্বর বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। টালিনালার ওপারে টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো। ওপারে স্বপ্নগড়া হয়, এপারে স্বপ্নের পরিসমাপ্তি। নবীনবাবুর সব স্বপ্নপূরণ হয়েছে? নবীনবাবুর শ্বশুরমশাই-এর পাবলিকেশনের রমরমা ব্যবসা ছিল। শ্বশুরমশাই-এর দুই মেয়ে একটিই ছেলে। সুমন্ত। নবীন বাবুর স্ত্রী বড় মেয়ে। ছোট মেয়ে মানে নবীনবাবু ছোট শালির বিয়ে হয়েছে আমেরিকায়। বিয়ের পর বেশ কিছুদিন আসা-যাওয়া ছিল। তারপর এখন আর তাঁরা আসেন না। আমেরিকায় তাঁদের রোজগারপাতি যথেষ্ট। সুমন্তর মাসির দুই ছেলে দুই মেয়ে। চারজনেই খুব সফল।

যাইহোক নবীন বাবুর শ্বশুর পাবলিকেশনের ব্যবসাটা নবীনবাবুকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার আগে নবীনবাবু কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে শ্বশুরমশায়ের ব্যবসাতে মন দিয়েছিলেন। শ্বশুর শাশুড়ি বছরখানেকের মধ্যে মারা গেলেন। তখন মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। শ্যালা সুমন্ত’র বয়স কম। তাই তাঁকে নিজের কাছে এনে রাখলেন নবীনবাবু। মানিকতলায় তিনতলা বাড়ি। আমেরিকায় শালির সঙ্গে কথা বলে সে বাড়ির কাগজপত্র সব সুমন্তর নামে লেখাপড়া করিয়ে দিলেন। ওপরের পোর্শানটা রেখে নিচের দুতলা ভাড়া দিয়ে সামনের দোকান ঘর সব ভাড়ার ব্যবস্থাও করে দিলেন।

সুমন্ত’র একটা বাঁধা রোজগারের ব্যবস্থা হল। কিন্তু তাকে নিজের বাড়িতে ছেলের মতোই রাখতেন নবীনবাবু ও তাঁর স্ত্রী। জানতেন কমবয়সী ছেলে হাতে পয়সা পেলে বখে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তার তো একটা ভবিষ্যতের ব্যাপার রয়েছে। এসব মায়ের কাছে শুনেছি।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১৬: আচমকা আমার শীত করছে, কোনওক্রমে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

এ যুগে এমন সজ্জন ভদ্রমানুষ পাওয়া ভার। সুমন্ত তার দিদি জামাইবাবুকে বাবা মার মতই শ্রদ্ধা করত। নবীনবাবুর হয়তো সুমন্তর একটা বিয়ে দিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল।বড় মেয়ের কোলে নাতিকে তিনি দেখে গেছেন। ছোট মেয়ের কোলে এখনও নাতিনাতনি আসেনি। হয়তো সে ইচ্ছে ছিল। জীবনের জ্বালাযন্ত্রণা অনেক কিন্তু প্রাপ্তি বা আকাঙ্খার শেষ নেই। তাই যেতে চাইলেই সকলে যেতে পারে না। শেষ মুহূর্তে হয়তো যেতে মন চায় না।

আফিফা কি চলে যেতে চেয়েছিল? আফিফা কি সুইসাইড করেছিল? আফিফার এমন ভয়ংকর মৃত্যুর জন্যই কি আমি ক্রমাগত পোড়া চামড়া পোড়া মাংসের গন্ধ পেতাম। নিজেকে নিজে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ংকর কষ্ট আফিফা সহ্য করলে কী করে। আফিফার বাজিতে খুব ভয়। পায়ের কাছে চরকি ঘুরলে ভয় লাফালাফি করত! সেই আফিফা আগুনের জ্বালা আগুনের ভয়ঙ্কর তাপ সহ্য করলে কী করে? দুর্ঘটনাটা আত্মহত্যা না হলে পুলিশ অন্য কিছু ভাবছে কেন? বুনির কাছ থেকে সব জানতে পারলাম।
আরও পড়ুন:

পাখি সব করে রব, পর্ব-২: দুর্লভ পরিযায়ী পাখি ল্যাপউইং

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৫: কোন আলো লাগলো ‘পুত্রবধূ’-র চোখে

দাহ করে ফিরলাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে । পাড়ার কয়েকজন এসেছেন আত্মীয়-স্বজন যাতায়াত করছে। বাড়ির গেট খোলা ছিল। রাত বাড়তে মা আমাকে চাবিটা দিয়ে বলল—

—খোকা যাও এবার নিজের চাবিটা তুমি দিয়ে এসো আজ।

—আমি?

—হ্যাঁ, বাবা এ সপ্তাহে আমাদেরই পালা। সুমন্ত গেট বন্ধ করার সময় প্রতিবার আমাকে বলে যায় “মাসিমা চিন্তা করবেন না। গেট বন্ধ করে দিয়েছি আমি।” আজ তাদের শোকের বাড়ি। আর নবীন বাবু তো সুমন্তর কাছে তার বাবার মতই ছিল। আজ কি সে ছেলেকে কিছু বলা যায়?

কী আশ্চর্য আমার ফ্ল্যাটের কবে গেট বন্ধ কবে পাম্প চালানোর কথা আমার এসব খেয়াল থাকে না কিন্তু মায়ের সব খেয়াল থাকে। যদিও সেটা আমার হয়ে সুমন্ত এতদিন করে এসেছে। কাজকর্ম মিটে গেলে আবার হয়তো সেই করবে। মেয়েরাই সুমন্তকে বলেছিল মুখাগ্নি করতে। শ্রাদ্ধ শান্তি সেই সবকিছু করবে। টাকা পয়সার জন্যে লোক ঠকানো লাঠালাঠি খুনোখুনি সম্পত্তির জন্য কেসকাছারি চারদিকে এসব দেখতে দেখতে মনটা যখন বিষিয়ে ওঠে তখন একটা দুটো এরকম নির্ভেজাল সৎ স্বাভাবিক সুন্দর পরিবারকে দেখলে মনটা যেন পবিত্র হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০: সুন্দরবনের রক্ষয়িত্রী বনবিবি

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১১: মশ্যা রে তুঁহু মম শ্যাম-সমান

চাবিটা নিয়ে নিচে গেলাম। অনেকটা রাত হয়ে গেছে। পাড়াটা রাস্তাটা নিঝুম হয়ে আছে। রাস্তার ধারে পাঁচিলের সঙ্গে লাগানো হাফ গেটটা টেনে দিয়ে সিঁড়ির সামনের গ্রিলগেটের কাছে আসছি হঠাৎ মনে হল আমার পেছনে যেন কেউ আসছে। ঘুরে তাকালাম। কেউ তো নেই। টেনে দেওয়া গেটটা একটু ফাঁক হয়ে গিয়েছে। গেটের মুখটা আমি লাগিয়ে দিয়েছিলাম স্পষ্ট মনে আছে। নাকি লাগাইনি।

এবার কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। আবার ফিরে গেটের কাছাকাছি এসে গিয়েছি। কিন্তু কেমন যেন একটা আতঙ্কে আর ঘুরে পিছনে ফিরতে পারছি না। গেটটা ভেজিয়ে দিয়ে চাবি দেবার জন্য তো আমাকে ঘুরতেই হবে। দম বন্ধ করে কোনগতিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। রাস্তার ধারের হাফগেট আর আমার সামনে গ্রিলের গেট তার মধ্যে জায়গাটায় মাঝামাঝি সাদা রঙের একটা অবয়ব। চেহারায় লম্বায় অবিকল যেন নবীন মুখার্জি। মুখের কাছটায় আলো-আঁধারিতে অস্পষ্ট। সাদাকালো ছবিতে কিছুটা জল বেশি পড়ে গেলে যেমন রংটা ধুয়ে যায় ঠিক তেমন। বাঁহাতটা তূলে আমায় দেখালেন। এতদিনে এই প্রথম আমার হাতটা কাঁপছে। কোনক্রমে তালাটা গেটের থেকে চাবি দিয়ে খুলেছি। আমার কাঁধে একটা ঠান্ডা হাত। —চলবে।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content