শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


এখন আমি শাওয়ারের তলায়। কোথায় যেন পড়লাম প্রতিনিয়ত শাওয়ার ব্যবহার করলে তাড়াতাড়ি মাথার চুল পড়ে যায়। আচ্ছা চুলের যখন এমন দশা সে জলে ধুয়ে যাচ্ছে সে চুল থাকার থেকে না থাকা ভালো। যার যাবার সে যাবেই! তাকে আটকায় কার সাধ্য!

আমি যতই মনকে অন্যত্র পাঠিয়ে খানিক আগে আচমকা পাওয়া মনের ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে চাই। সেটা আমি পারছি না। ‘ইউসিএলএ’র হেলথ জার্নালে এই জানুয়ারি মাসের টাটকা খবর ‘ডিপ বাথ ইন কোল্ড ওয়াটার’ মানে ঠান্ডা জলে কষে চান করতে পারলে নাকি গুনে গুনে ছ’ ছটি উপকার। তবে সেটি বলার আগে আমার নিশ্চয়ই বলা উচিত যে ইউসিএলএ কী?

এটা অ্যাব্রিভিয়েশনের যুগ। কিন্তু সকলেই সব অ্যাব্রিভিয়েশনের জানবেন সেটা আইনসভায় পাস হওয়া কোনও আইন নয়। করোনাকালে ওয়ার্ক ফ্রম হোম খুব চলত, লোকে তাকে ‘ডবলুএফএইচ’ বলা শুরু করল। আমার পরিচিত এক নাট্যকার বাংলা হিন্দি ডাবল ভার্সন নাটক লিখলেন বাংলায় বাথেকা। হিন্দিতে ঘসেকা। নাম শুনে নাট্য পরিচালকদের ভিরমি খাওয়ার দশা।সে বললে, খুব সোজা। বা-থে-কা ‘বাড়ি থেকে কাজ’ আর ঘ-সে-কা ‘ঘর সে কাম’। এই কারণে অ্যাব্রিভিয়েশন খুবই সাংঘাতিক।

তবে ‘ইউসিএলএ’ হল ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জলস। তাদের প্রকাশিত তালিকায় দ্বিতীয় নম্বর রয়েছে ঠান্ডা জলে কষে চান করলে মনের বিষাদ বা ডিপ্রেশন কেটে যায়। আর পাঁচটা হল ঠান্ডা লাগার ধাপ যাদের তাদের প্রতিষেধক ক্ষমতা বাড়ে। রক্ত চলাচল বাড়ে। পাচন শক্তি বাড়ে হজম ভালো হয়। মাংসপেশির ফোলা ভাব কমে খ্যাঁচকা লাগা ব্যথা নাকি কমে যায়। ইউসিএলএ’র প্রেসক্রিপশন কিন্তু হেলাফেলার নয়। অলিম্পিকের পদকজয়ী নোবেলের পদকজয়ী দেশে-বিদেশে গুণী জ্ঞানী অনেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ বহন করছেন।
তবে তফাত একটা আছে সাহেবরা যে চৌকোণা শাওয়ার থেকে চান করে এখন নামিদামি শাওয়ারের বিজ্ঞাপনে টিভিতে দেখা যায়। সেখান থেকে পড়া জলধারা হল সলিল চৌধুরী, লতা মঙ্গেশকরের অমর সৃষ্টি “ও ঝরঝর ঝর্না ও রুপালী বর্ণা”। অমন ঝর্নার জলে চান করলে গানের কথা মেনে অবশ্যই মনপ্রাণ হারিয়ে যেতে পারে। যেটা সলিল চৌধুরী বহুবছর আগেই বলেছিলেন সেটাই মার্কিন সাহেবরা এখন বলছেন। কিন্তু আমার মন থেকে অস্থিরতা যাচ্ছে না, কারণ আমার বাড়ির শাওয়ার এবং জলের প্রেসার এতই কম সেটা টিপ টিপ বরষে পানি।

মাথা মুছে পোশাক পাল্টেই বুনিকে ফোন করলাম।

— এবার খুলে বল তো ঠিক কী হয়েছিল? আর দুবাইয়ের খবর তুই বা পেলি কি করে?

— বছর পাঁচেক আগে আফিফারা বম্বেতে চলে এসেছিল। দুবাইতে ওর স্বামীর যে ব্যবসা ছিল সেটা নাকি ভালো চলছিল না।

— বম্বেতে। তার মানে তো তোর সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো।

— না আমার সঙ্গে দেখা কখনও হয়নি। ফোনেও কথা হয়নি। আফিফা আমাকে ফেসবুকে খুঁজে মেসেজ করেছিল। ওই ফেসবুকেই কখনো কখনো মেসেজে কথা হতো।

— এক শহরে থাকতিস দুজনের অথচ দেখা সাক্ষাৎ ছিল না? অথচ এত বন্ধুত্ব ছিল তোদের?

— এখনও মেয়েরা ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছু করতে পারে না। অনেক না বলা বাধা থাকে।

— তুই আফিফার কাছে ফোন নম্বর চাসনি।

— চেয়েছিলাম। ও বলার আগেই আমার ফোন নম্বরও দিয়েছিলাম। ও ফোনও করেনি ওর ফোন নাম্বারও দেয়নি। নিশ্চয়ই কোন অসুবিধে ছিল।

— কিন্তু তুই মৃত্যুর খবরটা পেলি কি করে?

— কাগজে পড়ে?

— কাগজে? আফিফার মৃত্যুর খবর কাগজে দিয়েছিল। কই কলকাতার কাগজে তো কোথাও

— লোকাল নিউজ পেপারে বেরিয়েছিল। অস্বাভাবিক মৃত্যু তাই পোস্টমর্টেমও হয়েছে। পুলিশ ইনভেস্টিগেট করছে?

— থানায় কি কেউ কমপ্লেন করেছে?

— না না। আসানসোলের বাড়ির সঙ্গে আফিফার কোন যোগাযোগ ছিল বলে আমার মনে হয় না। লোকাল থানা নিজেরাই কেস করেছে।

— সুয়োমোটো। তোর বাড়ি থেকে কত দূর?

— আমরা কান্দিভেলি থাকি। কান্দিভেলি ওয়েস্ট। আফিফা থাকতো নেরুল। নভি মুম্বইয়ে।

— আমার কাছে সবটাই হিব্রু। আমার প্রকাশকের কল্যাণে ভারতের অনেক জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু বম্বেতে যাওয়া হয়নি। বম্বের বাঙালিরা বোধহয় বাংলা গল্প উপন্যাস বাঙালি লেখক এসব নিয়ে খুব একটা উৎসাহী নয়। কিন্তু আগুনে পোড়ার ব্যাপারটা কী হল?

— নেরুলে ওদের বাংলো বাড়ি। আগেই বলেছিল। কিচেনটা আলাদা। সেখানে আগুন লেগে ও মারা যায়। শ্বশুরবাড়ি ফ্যামিলি স্টেটমেন্ট দিয়েছে এক্সিডেন্ট। পুলিশ অন্য কিছু সন্দেহ করছে। মানে কাগজে সেরকমই লিখেছে।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১৪: বাদামি চোখ দুটোয় জ্বলন্ত আগুনের আভা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

আর বলার কিছু ছিল না জানার কিছু ছিল না ফোন নামিয়ে রেখেছিলাম।
ছোটবেলায় আইডেন্টিটি থাকে না। তাই কোন কাজের আগে সিদ্ধান্ত নিতে হয় না ভাবতে হয় না। যখন যেটা মন চায় তখনই সেটা করা যায়। আইডেন্টিটি হল এই গণ্ডি। কক্ষপথ। অরবিট। এই গণ্ডিটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। ছোটবেলায় বুনির সঙ্গে সব কথা হতো। এখন তো হয় না। বুনি সেই বুনিই আছে আমি সেই আমিই আছি। অথচ আমরা কেউ কারও গণ্ডি থেকে বের হতে পারছি না।

তবে বয়স বাড়তে বাড়তে ক্রমশ রাস্তার শেষ মুখটা চোখে পড়বার সময় আবার বোধহয় এই গণ্ডি কক্ষপথ অরবিট সবকিছু ভেঙে যায়। এটা আমার অনুমান। এই ধরনের মানুষকে দেখে আমার সেটাই মনে হয়েছে। তবে নিজে সেই বয়সটাই পৌঁছলে অনুমানটা কতটা ঠিক সেটা বুঝতে পারব। জীবনের এক এক সময় এক একটা জিনিস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রায়োরিটিস বদলে যায়। চাহিদা বদলে যায়। সহজে কোন কিছুই পাওয়া যায় না। কারও ক্ষেত্রেই নয়।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

আমরা সকলেই যে যেখানে শুরু করেছিলাম। যেদিকে এগোবো বলে শুরু করেছিলাম। আর আজ যেখানে এসে পৌঁছলাম ক’জনের ক্ষেত্রে সেটা মেলে। তাই জ্ঞানী-গুণী সকলেই বলেছেন জীবনে যা পেয়েছো সেটা নিয়ে খুশি থাকো সুখে থাকো আনন্দে থাকো। এই কথাটার মানেই হচ্ছে সবার সব আকাঙ্ক্ষা একজীবনে পূর্ণ হয় না। তাই আক্ষেপ করে লাভ নেই। জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী অনেক প্রেমে গদগদ দম্পতি মনে মনে একে অপরের দিকে ছুটতে ছুটতে সেই মারকাটারি হিট ছবির গান গেয়ে বলেন যুগে যুগে আমি তোমারি…সঙ্গী সঙ্গী…আমরা অমর সঙ্গী! টিভির রিয়ালিটি শো’তে সেলিব্রেটি দম্পতিরা কেউ কেউ বলেন আমাদের মধ্যে কখনও কোনওদিন মনোমালিন্য হয় না। আমরা একে অপরকে ভীষণ ভালো বুঝি। আগে আমরা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু তারপরে দম্পতি। আর টিভি দেখতে দেখতে তাঁদের ঘনিষ্ঠ চেনা পরিচিত জন মুচকি মুচকি হাসেন। কারণ তারাই এই দম্পতির পরস্পরের ব্যক্তিগত এবং স্বাধীন নষ্টামিতে বীতশ্রদ্ধ। তাঁরাই সেই একে অপরকে বোঝা, ভালোবন্ধু জনপ্রিয় বিশিষ্ট দম্পতির উন্মুক্ত দোষারোপ এবং কুৎসিত মারামারির সাক্ষী। এদেরই মধ্যে আবার অনেক প্রৌঢ় দম্পতি খোলাখুলি বলেন সকাল থেকে রাত প্রায় প্রতিদিন স্বামী-স্ত্রীতে জমিয়ে ঝগড়া করতে না পারলে সত্যি সত্যি শরীর খারাপ হয়। এটাই বোধহয় তাদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও দাম্পত্যের জমাট ভিত্তি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮: সুন্দরবনের নিশ্চিহ্ন প্রাণী

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১: ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির এক অনন্যসাধারণ কোচ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ

মনের অস্থিরতাটা কিছুতেই কমছে না। তাই অনেকদিন পর সন্ধ্যেবেলা সুইমিংপুলে গেলাম। জলে নেমে দেখলাম অনেকদিনের অনভ্যাসের ফলে অসুবিধা হচ্ছে। একটুতে হাঁপিয়ে যাচ্ছি। আজ আমি সুইমিংপুলে কেন এসেছি আমি নিজেই জানিনা। আমি কি মোহিনীর মুখোমুখি হতে এসেছি? জানতে এসেছি একের পর একই ঘটে যাচ্ছে আমার সঙ্গে? কেন আমি এতদিন ধরে বারবার পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। চামড়া পোড়া। মাংস পোড়া গন্ধ!!

— আমি এমনটাই চেয়েছিলাম।

চমকে উঠলাম। এ কার গলা? এত মোহিনীর গলা নয়। এ কণ্ঠস্বর আমার চেনা। ভীষণ চেনা। ফিরে তাকাতে আমার দুটো পা স্থির। আমি আর নড়তে পারছি না। কিছুদিন আগে প্রথমবার তাকে দেখেছিলাম যেভাবে। চোখটুকু জলের ওপরে বাকি শরীরটা জলের ভেতরে অদৃশ্য। ঠিক সেভাবেই আমার থেকে কয়েক হাত দূরে আমার ফেলে আসা অতীত। কিশোরী নয় আমার শেষ দেখা যুবতী আফিফা। সেভাবেই এক দিকে ফেলে চুল। ঠিক সেরকম বাদামী রঙের চোখ আমাকে বিদ্ধ করছে।

— আমি তোমার কাছে পৌঁছোতে চেয়েছিলাম। জানতাম না বুনি তোমায় খবরটা দেবে কিনা। তাই আমরা তোমার কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলাম।—চলবে।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content